• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
করোনাযুদ্ধের মা-বাবারা

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

বিষাদ কাব্য

করোনাযুদ্ধের মা-বাবারা

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ১১ এপ্রিল ২০২০

‘মায়ে আমার কত কাছ রয়-
হঠাৎ পাইলে আঘাত ঘটলে বেঘাত মা শব্দটি মুখে হয়-
মায়ে আমার কত কাছে রয়-
পুত্র যদি রয় বিদেশে মায়ের চোখের জলে বুক যে ভাসে গো,
ওরে পুত্র আমার কেমন আছে- ঘুরে ঘুরে সংবাদ লয়
মায়ে আমার কত কাছে রয়--------।’

এটি একটি মাতৃভক্তির গান। এ গানটির আরো তিনটি চরণ রয়েছে। আলোচনার সংক্ষিপ্ততার জন্য ওই তিনটি চরণ উল্লেখ করলাম না। ছোট বেলায় গানের আসরে ভারি পরিবেশে মাঝেমধ্যে এ গানটি গাইতাম। সুযোগ হলে এখনো গাই। সুযোগ না হলেও মরমের দরদ গুণগুণ করে প্রায়ই গেয়ে চলে দেহের শিরায় শিরায়।

সভ্য দুনিয়ায় আপদকালে মানুষ তার ঘনিষ্ঠজনদের স্মরণ করেন। যাদের বেশি বেশি স্মরণ করেন, তাঁরা হলেন মা-বাবা। আমরা সবাই জানি, বাবা মায়ের কাছে সবচেয়ে আপনজন হল তার সন্তানেরা। আর সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপনজন হলো তাদের মা-বাবা। শুধু মানুষ কেন, মমতার এই চিরায়ত বন্ধন আমরা অন্যসব প্রাণীর মধ্যেও দেখতে পাই। মমত্বের এই বিশালতা নিয়েই চলছে আমাদের জীবনচক্র। যদ্দিন পৃথিবী থাকবে তদ্দিন এই মমতা জড়িয়েই বেঁচে থাকবো আমরা। সন্তানদের জন্য মা-বাবার প্রতিটি নিশ্বাস আকুলতায় তপ্ত হয়ে থাকে। আবার প্রতিটি নিশ্বাস সিক্ত হয়ে থাকে। ‘তপ্ত’ থাকা আর ‘সিক্ত’ থাকা নির্ভর করে চাওয়া পাওয়া আর সুখ-দুঃখের আবেশকে ঘিরে।

গত দুদিন থেকে আমার সবকটি নিশ্বাস যেন বুকপুড়ে তপ্ত হয়ে বেরুচ্ছে। একইভাবে এমন তপ্ত নিশ্বাস বেরুচ্ছে সব মা-বাবাদেরও। পৃথিবীজুড়ে করোনার ছোবলে মৃত্যুর মিছিল যখন লাখ পেরিয়েছে, আমি তখন আমার মাকে আরো কাছে পেতে চাইছি। কারণ আমিও এই মহাবিপদের মুখে পরেছি। আমার মত দেশের কোটি কোটি সন্তানেরাও। সব মায়েরাও সন্তানকে কাছে থেকে আগলে রাখতে এখন মরিয়া। এমন দুঃসময়ে যারা মা-বাবার থেকে দূরে আছেন- তাদের অনুভুতি নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম নয়।

পৃথিবীজুড়ে হঠাৎ কেন এমন মানবিক বিপর্যয়? এই প্রশ্ন এখন কোটি কোটি বিবেককে তাড়িত করছে। অনেকেই বলছেন- এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রকৃতির ওপর, নিজেদের ওপর অত্যাচারের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে মানুষ।

গোলক পৃথিবীর গায়ে- দুলছে দূষিত জলরাশি। মাটিরভাগে শেল বল্লমের মত গেঁথে গেঁথে আছে অনৈতিক প্রাচুর্য। অমানবিকতার জোয়ারে পুতিদুর্গন্ধ হয়ে ঘুরছে চারদিকের বাতাস। এমন বিচ্ছিরি গোলকের গায়ে-গায়ে এখন সাদা কাফনের সারি সারি লাশ! অগনিত লাশ! প্রতিদিন টেলিভিশনে মর্মন্তুদ এই করোনা দুঃসংবাদের খবর শুনতে শুনতে এক প্রতিবেশির শোকার্ত সংলাপ। তিনি বললেন- ‘চাঁন কান্দে, সুরুজ কান্দে, কান্দে আসমান-জমিন’। পৃথিবীর সব দেশই যেন ডুবে গেছে এই শোকের আঁধারে।

আক্রান্ত দেশগুলোর বেঁচে থাকারা- লাখো স্বজনকে হারিয়ে শোকে শোকে এখন যেন নিথর পাথর। শোকের আঁধার পার হয়েছে দু-একটি দেশ। কিন্তু বিধাতা সবেমাত্র আমাদের দেশে শুরু করেছেন। কত প্রাণের বিনিময়ে আমরা এই আঁধার পার হতে পারব, তা ঠিক জানা নেই। তবু অনুমাণ করি, নেহায়েত কম নয়। আমাদের অনেক স্বজনকেই হারাতে হবে। কারণ আমরা অচেতন বাঙালি। এখনো লকডাউন দেখতে ভিড় জমাই। তবু আমাদের বাঁচতেই হবে।

মুক্তিযুদ্ধে যেমন স্বেচ্ছায় অগনিত প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে বাঙালি। তেমনি করোনা যুদ্ধেও বৃহত্তর স্বার্থে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। যারা এই রোগে আক্রান্ত হবেন বা হচ্ছেন, তারা আমাদেরই মা-বাবা, আমাদেরই সন্তান-সন্ততি। ওদের বাঁচাতে দেশের চিকিৎসক সমাজকে শহীদ হওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সরকার, চিকিৎসক, সেবক-সেবিকাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই আমাদের একমাত্র ভরসা। আক্রান্তদের জন্য একেকজন চিকিৎসককে হতে হবে ‘বাবা’। একেকজন সেবিকাকে হতে হবে ‘মা’। মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের মহানুভবতাই এমন দুঃসময়ে জাগিয়ে তুলতে পারে আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads