• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
 বাংলাদেশ, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

বাংলাদেশ, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা

  • হাসান আজিজুল হক
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০২১

বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে পাঁচশালা, দশশালা পরিকল্পনার মতো একটা সংস্কৃতি প্রণয়নের কথা উঠতে পারে না বা এ নিয়ে কোনো সরকারের পক্ষেই নির্দিষ্ট মত প্রচার করার কথাও ওঠে না। দেশ থাকলেই তার একটা সংস্কৃতি থাকে, সেই সংস্কৃতির প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, মান বা উৎকর্ষ যেমনই হোক না। বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল ভূখণ্ডে হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ বসবাস করে এসেছে। কত বিচিত্রভাবে বেঁচেছে তারা, কত অদ্ভুত পথে জীবিকা খুঁজেছে; জমিতে ফসল ফলিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, মন্দির-মসজিদ তৈরি করেছে, উঠোনে ফুল ফুটিয়েছে, মাটির পাত্রে, কাঠের গায়ে, ধাতুতে নকশা তুলেছে, গান গেয়েছে, কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। এসব বাদ দিয়ে কি মানুষ বাঁচতে পেরেছে? এসবের স্মৃতিতে ভরা যে ইতিহাস, এসবের নিদর্শনে পরিকীর্ণ যে মানবভূমি তা কি ফুঁৎকারে উড়ে যাবে, একটা অধ্যাদেশ জারি করলেই ধোঁয়া হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাবে? সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, মানুষের বাঁচার ইতিহাস, মানুষ বাঁচতে বাঁচতে বাঁচাকে সুন্দর করে তুলতে চায় আর তা করতে গিয়ে যা কিছু তৈরি করে টিকিয়ে রাখে—যেমন সংগীত, সাহিত্য, যেমন শিল্প, যেমন ঘটপট, বাড়িঘর, দালানকোঠা মন্দির মসজিদ—এসব কৃতিই তো মানুষের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিও তাই কোনো আজগুবি ব্যাপার নয়। কোনো ফতোয়ার মুখাপেক্ষী নয়। কোনো ফরমানে সেটা তৈরি হয় না। বাঙালি সংস্কৃতি হচ্ছে যারা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে তাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে সঞ্চিত হয়ে থাকা যাবতীয় কৃতি ও কর্ম। হতে পারে এই বিশাল সংস্কৃতির পুরো পরিচয় জানা হয়নি। যুগে যুগে কালে কালে কত স্তরে সে বিভক্ত ছিল, কত বিচিত্র অবস্থার ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে জানা যায়নি। জানা যায়নি তার বিকাশের সূত্রগুলো কি ছিল, কোন নিয়মে কখন সে অধঃপতনের পাঁকে আটকেছে। এসব বিচারের হয়তো সবই বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু মেনে তো নিতেই হবে যে বহু শতাব্দীর পাত্রে সঞ্চয় নেহাত কম নয়।

প্রসঙ্গটি এবার একটু অন্যপাশ থেকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতি সীমানা কি সংস্কৃতির সীমানার সঙ্গে সব সময়ই দাগে দাগে মেলে? আমাদের পরিচিত আজকের পৃথিবীর গত একশ বছরের ইতিহাস চোখের সামনে রাখলে মুহূর্তে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচয় একটা হিসেবে খুবই ক্ষণস্থায়ী; রাষ্ট্রীয় সীমানা ও রাজনৈতিক চৌহদ্দি বারবার মুছে মুছে যাচ্ছে; রাষ্ট্র জন্মাচ্ছে, রাষ্ট্র মরছে, মিশে যাচ্ছে, নতুন রাজনৈতিক পরিচয় দেখা দিচ্ছে, লোপ পাচ্ছে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, একটি মানুষের জীবনসীমার মধ্যেই উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পরিচয় যেভাবে বদলেছে তাতে বলতে হয় রাষ্ট্রের আয়ু সব সময়ই দীর্ঘ নয়। অন্যদিকে জাতি আর সংস্কৃতি সম্বন্ধে কি সে কথা বলা চলে? একই ভূখণ্ডে রাষ্ট্র নাম বারবার বদলাচ্ছে। বলতে গেলে পৃথিবীর ইতিহাসই তাই। প্রাচীন পৃথিবীর রাষ্ট্র বিন্যাসের চিহ্নমাত্র আর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই ভেবে দেখতে হয়, সংস্কৃতির সীমানা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সীমানার আনুগত্য করছে, না, বার বার সে সীমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে? অন্যভাবে বলা চলে, পৃথিবীর মানচিত্র এটাই প্রমাণ করে যে একই সংস্কৃতির বিশাল সীমানার মধ্যে নানা প্রয়োজনে মানুষ রাষ্ট্রীয় গণ্ডি টানে। প্রাচীন গ্রিসে হেলেনীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত ছিল কতগুলি রাষ্ট্র? তাদের তো সীমা সংখ্যা নেই। অথচ রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের কি বিভিন্নতাই না সেখানে ছিলো? কিন্তু তাদের সকলের জায়গা হয়েছিল গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতায়। হেলেনীয় সংস্কৃতির প্রসারভুক্ত ভূখণ্ডের আজকের রাজনৈতিক পরিচয় কী? তার সীমান কি শুধুই আজকের গ্রিস? কাজেই দেখতে পাচ্ছি এক সংস্কৃতির এলাকা ও অধিবাসীদের নানারকম ভাগ করে নানা রাষ্ট্রের উদ্ভব যেমন ঘটতে পারে, এক রাষ্ট্র একাধিক সংস্কৃতিকেও তেমনি জায়গা দিতে পারে।

সাড়ে তিন দশক ধরে বিচার করা যাক। ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত যে ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, অবিকল সেই ভূখণ্ডেই আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এই ভূখণ্ডে যারা বাস করছে তাদের জাতি পরিচয়, ভাষা পরিচয়, ধর্ম পরিচয় কোনো কিছুই বদলায়নি, বদলেছে শুধু রাষ্ট্র পরিচয়। এখন রাষ্ট্র শাসকগণ চাইলেই কি এই জাতি পরিচয়, ভাষা সংস্কৃতি ধর্ম পরিচয় বদলে ফেলা যাবে? সেটা কখনোই সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র সেটাই চেয়েছিল। তার আবদার ছিল ভাষা পরিচয় ভুলতে হবে, জাতি পরিচয় ত্যাগ করতে হবে, সংস্কৃতি পরিচয় বর্জন করতে হবে, ইতিহাস ভুলতে হবে, সব ঐশ্বর্য ছেড়ে দিয়ে ভিখিরি হয়ে শুধু একটা ধর্মপরিচয় গড়ে তুলতে হবে, একটা সম্প্রদায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। এই অস্বাভাবিক অভিপ্রায় পূরণ করতে দেওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা আজ সুচিন্তিত। ওপরের প্রসঙ্গ ধরে যদি প্রশ্ন করা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মতোই তার সংস্কৃতির সীমানাও কি একই রকম সুচিন্তিত, তাহলে তার জবাব কী হবে? বাংলাদেশের সংস্কৃতির সীমানা অবিকল তার রাষ্ট্রীয় সীমানার সঙ্গে এক ও অভিন্ন এই কথা বললে ইতিহাস ভুলতে হচ্ছে, অতীত ভুলতে হচ্ছে, ভাষাসাহিত্য শিল্প স্থাপত্য সংগীত ধর্ম সবই ভুলতে হচ্ছে। ভুলতে হচ্ছে বড় বড় জনগোষ্ঠীর অনন্য স্বতন্ত্র কীর্তি। সেই যৌথ ও সমন্বিত কর্মসৃষ্ট ইতিহাসের দিকে একবার নজর দিলেই বিশাল যে ভূখণ্ড আমাদের চেতনায় ভেসে ওঠে তার মধ্যে কোথায় বা বাংলাদেশ, কোথায় বা পশ্চিমবঙ্গ? রাজনৈতিক টানাহেঁচড়ায় কত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, কত রাষ্ট্রের লোপ পেয়েছে, তার ঠিকানা পাওয়াই দায়। কত বিভিন্ন নাম এই ভূখণ্ডের নানা অংশের—সমতট, গৌড়, বরেন্দ্র, পু্ল, রাঢ়। বৃহৎবঙ্গ বলতে আজ আমরা আবছাভাবে পূর্ব ভারতের যে বিশাল ভূভাগ বুঝি তার মধ্যে একই সময়কালে বা নানা সময়ে কতো অসংখ্য রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিলয় ঘটেছে, তার পুরো ইতিহাস এখনো অজানা। বাংলাদেশ নামে পরিচিত যে রাষ্ট্র সেকি চিরকাল একটিই রাষ্ট্র ছিল? কখনোই নয়। তাহলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নের মীমাংসা কী? একটা মীমাংসা হতে পারে যে বাংলাদেশের অতীত নেই বা থাকলেও সেটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম যেদিন থেকে তার সংস্কৃতির জন্মও সেদিন থেকে, তার সংস্কৃতির হিশেবনিকেশও হবে সেদিন থেকে। এ কথা বর্বরের পক্ষেই বলা সম্ভব যদিও কপালগুণে তেমন বর্বর আজকাল খুব যে কম চোখে পড়ে তা নয়। অন্য মীমাংসা হতে পারে এই যে আজকের বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের মধ্যে যতো ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল তাদের সকলের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বাংলাদেশ পেয়েছে। প্রাণপণে সরকারি সংস্কৃতি চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও আজ পর্যন্ত কোনো সরকার এই উত্তরাধিকার খোলাখুলি অগ্রাহ্য করতে সাহস পায়নি। ময়নামতি অঞ্চল, মহাস্থান বা পণ্ড্র অঞ্চল, গৌড় ও সোনারগাঁও অঞ্চলের সংস্কৃতি যে বাংলাদেশেরও সংস্কৃতি, মিনমিন করে হলেও একথা সবাইকে স্বীকার করতে হয়। যেসব বিচিত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিল এসব অঞ্চলে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম যুগে, তাদের ইতিহাস বাঙালি জাতির ইতিহাস। এটা একটা অতি সাধারণ কথা। আমাদের পক্ষে এই ইতিহাসটা হওয়া উচিত ছিল নিঃশ্বাস বায়ুর মতো সুলভ, স্বাভাবিক, সুপ্রচুরও অনায়াস।

মানুষেরা বেঁচে ছিল যাদের রাষ্ট্র বিপ্লবে অংশ নিতে হয়েছে দারিদ্র্যে দুঃখে অনাহারে শোষণে পীড়নে প্রাণ দিতে হয়েছে, কখনোবা ধর্মের সাম্প্রদায়ের বিরোধিতার হানাহানিতে মেতে উঠতে হয়েছে। কি সব বিচিত্র রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এসব মানুষ গেছে। অতীতের দিকে চেয়ে বিরোধ বলি, সে সবই সত্য, আবার তার কিছুই তো সত্য নয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল ভান্ডারে সম্ভবপর সবরকম বর্ণনার ছোট-বড় ধারা মিশে শেষ পর্যন্ত এক ধারার যে মহাকল্লোল সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই কি চরম সত্য নয়? যে পোড়ামাটির শিল্প মসজিদের প্রাচীরগাত্রে দেখি, সে কি নির্ঘাত মুসলমান শিল্পীর কাজ? এবং তা হলেই বা কি এসে যায়? মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ কি অবশ্যই হিন্দু শিল্পীর এবং তা হলেই বা কি? আমাদের সামনে মন্দির মসজিদের অপূর্ব পোড়ামাটি শিল্পের ঐশ্বর্য— মহামূর্খ ছাড়া এই ঐশ্বর্যের জাত খুঁজে বেড়ায় কেউ? মসজিদে মন্দিরে হিন্দু মুসলমান শিল্পী একসাথে কাজ করেছে, শিল্পী প্রতিমায় চক্ষুদান করেছে, মৃৎপাত্রে নকশা কেটেছে, কাঁসার ধাতুপাত্রে সৌন্দর্য ফুটিয়েছে, কাঠের কাজে অপার্থিবকে ধরে এনেছে দৃষ্টির সীমানায়, কাঁথায় মানুষের আত্মা বিছিয়ে দিয়েছে মেয়েরা— এসবের যত খুশি বিশ্লেষণ করা যায়, নানাস্তরে ভাগ করা যায়, বহুভাবে ব্যাখ্যান করা যায়, কিন্তু অস্বীকার করা যায় কীভাবে? যে বাঙালি আজ বসবাস করছে বাংলাদেশে, স্থান আর কালের গণ্ডির মধ্যে, সে তো ছড়িয়ে বিছিয়ে আছে বর্তমান থেকে সুদূর অতীতে। এই চেতনাটুকু তো লাভ করতেই হবে।

রাষ্ট্রসত্তা প্রবল আকর্ষণে ব্যক্তিকে টানে। যে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ—সেই রাষ্ট্রের সব দাবি তার অধিবাসীদের মেটাতে হবে, জন্ম জীবন মৃত্যু তার মধ্যে, তার জন্য প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু তাকে কোথাও অতিক্রম না করেও বাংলাদেশের মানুষ বিশাল বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার দাবি করবে, তাকে আত্মস্থ করবে, তার বর্তমানকে জীবন্ত, পরস্ফুিট, চলন্ত করতে চাইবে তার অতীত দিয়ে এতো খুবই স্বাভাবিক। কে কবে চিন্তা করতে পারে যে আজকের পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মানুষরা কাণ্ট হেগেলের দাবি নিয়ে মারামারি করছে? রাষ্ট্রীয় সীমা বিবেচনা করে বিটোভেন বর্জন করেছে?

পাকিস্তানি আমলে প্রধান যে দুটি মসলা দিয়ে সংস্কৃতি রান্না হতো, সে মশলা হচ্ছে ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতা। এতদিন পরে ঐ দুটি মসলারই তীব্র ঝাঁজ আবার পাওয়া যাচ্ছে। এই ইসলাম এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ইসলাম নয়, ধর্মের সঙ্গে প্রকৃতপ্রস্তাবে তার কোন যোগই নেই। এ ইসলাম হচ্ছে রাজনীতির ইসলাম, যোগ যার ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে।

স্বাধীনতার চিন্তা চেতনা, সপক্ষের মানুষেরা আজ ক্ষমতায়। এখনই চিন্তা করা দরকার জঞ্জাল উপড়ে ফেলবে নাকি যত্ন নেবে। দেশ উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে যাক, অতিক্রম করুক এই তো চাওয়া।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads