• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
আগস্টেই নিষ্পত্তি হচ্ছে গ্রেনেড হামলার বিচার

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা

ফাইল ফটো

আইন-আদালত

আগস্টেই নিষ্পত্তি হচ্ছে গ্রেনেড হামলার বিচার

  • নাজমুল আহসান রাজু
  • প্রকাশিত ০৪ আগস্ট ২০১৮

ভয়াবহ ও নৃশংস একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার নিষ্পত্তির অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। চলতি বছরে আসতে পারে বিচারিক আদালতের রায়। আর মাত্র একজন আসামির যুক্তিতর্ক শেষ হলে রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করবেন আদালত। ধারণা করা হচ্ছে চলতি মাসের ২১ আগস্ট ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনই হতে পারে এ রায়।

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার যুক্তিতর্ক চলছে। আগামী সোমবার ৬ আগস্ট থেকে টানা তিন দিন এ মামলার যুক্তিতর্কের দিন রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্তিতর্কের পর্যায়ে এসেও কালক্ষেপণ থেকে রেহাই মিলছে না। বিচার বিলম্বিত করার পথে হাঁটছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। মামলার প্রাসঙ্গিক যুক্তির বাইরে টালবাহানার অবতারণা করছেন তারা। আদালত বার বার প্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তুতে থাকার তাগিদ দিলেও থামানো যাচ্ছে না। শুধু যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০৪ দিন। আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে লাগছে আট মাসেরও বেশি সময়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৭ ডিসেম্বর সরকারপক্ষে এ মামলার আসামি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ৪৯ আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে সরকারপক্ষ। ইতোমধ্যে এ মামলার আলোচিত আসামি তারেক রহমানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আইনত পলাতক দেখিয়ে তার পক্ষে সরকার নিযুক্ত আইনজীবী এ কে এম আখতার হোসেন খালাস চেয়ে তার যুক্তি পেশ করেন। যুক্তিতর্কের ৯৭তম দিনে গত ২৩ জুলাই শুরু হয় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। সেদিন থেকে সাত কার্যদিবস ধরে যুক্তি উপস্থাপন করছেন তার আইনজীবী রফিকুল ইসলাম ও এস এম শাহজাহান। এরপর তিনি নিজে ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন যুক্তি পেশ করেছেন। আবদুস সালাম পিন্টুর যুক্তি শেষ হলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হবে। এটি শেষ হলেই তখন আদালত রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন। সে হিসেবে চলতি মাসেই একুশে আগস্টের কালো দিনেই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত রায়ের দিন।

আসামিপক্ষে যুক্তিতে ঘুরেফিরে আদালতে বলা হয়েছে, এজাহার এবং একাধিক জিডির একটিতেও আসামিদের নাম ছিল না। প্রথম অভিযোগপত্রেও নাম না থাকার পর অধিকতর তদন্তে একরকম জোর করে নাম যুক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। পুলিশের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্র বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। তাতে সত্যের প্রতিফলন ঘটেনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আসামিদের সুনাম ধ্বংস করতে তাদের মামলায় জড়ানো হয়েছে।

আসামিপক্ষের অভিযোগ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অধিকতর তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেক আগে তিনি অবসরে গেলেও বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার জন্য তাকে অবসরোত্তর পদোন্নতি দিয়ে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশেষ মহলের চাপে আবদুল কাহার আকন্দ প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন।

অন্যদিকে সরকারপক্ষে প্রধান কৌঁসুলি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান গত ২৭ ডিসেম্বর ২৫ কার্যদিবসে সাক্ষীদের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর থেকে সরকারপক্ষে যুক্তি পেশ শুরু হয়। সরকারপক্ষের ২২৫ জন সাক্ষী (পিডব্লিউ) ও আসামিপক্ষের ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য (ডিডব্লিউ) পর্যালোচনা করে যুক্তিতর্ক শেষ করেন রেজাউর রহমান।

তারেক রহমানের পক্ষে পেশ করা যুক্তিতে বলা হয়েছে, অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের সব ধরনের প্রশাসনিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারেক রহমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো হামলার ঘটনার সময় তারেক রহমান বিএনপি কিংবা চারদলীয় জোট সরকারের এমন দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ ছিলেন না যে তিনি এ ধরনের আশ্বাস দিতে পারেন এবং দিলেও তাতে আস্থা রেখে কেউ এ ধরনের হামলা চালাতে পারেন। তা ছাড়া মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণে সরকারপক্ষ কোনোভাবেই এ ঘটনার সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারেনি। তাই এটা পরিষ্কার যে এ মামলায় তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়ানো হয়েছে।

সরকারের প্রধান আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, ‘সেদিন হামলার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। ঘটনায় জড়িতরা নিষ্কৃতি পেতে পারেন না। বিচার সঠিক পথেই এগুচ্ছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে এ মামলায় জড়ানো হয়নি। তারেক রহমান তার বনানীর হাওয়া ভবনে ষড়যন্ত্র বৈঠক করেছিলেন। অপরাধের সম্পৃক্ততার ভিত্তিতেই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আসামি হয়েছেন। গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আসামিরা যে জড়িত, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আরজি জানিয়েছি আদালতে।’

বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী। সেদিন হামলার শিকার অনেকে এখনো শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।

সেনাসমর্থিত জরুরি অবস্থার আমলেই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে মামলার অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। এ মামলায় সরকারপক্ষে ২২৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন আদালতে। ২০১৭ সালের ৩০ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের জেরা সমাপ্তির মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।

মামলা চলাকালে এ মামলার তিন আসামির মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধে এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাই এ মামলার আসামির তালিকা থেকে তারা বাদ পড়েছে। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯। জামিনে রয়েছেন ৮ এবং কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন। জামিনে থাকা আসামিরা হলেন- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম। কারাগারে আছেন লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২৩ জন। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন আহমদ, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারসহ ১৮ জন এখনো পলাতক। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট নোটিশ জারি রয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads