• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে আন্দোলন-রিটের প্রস্তুতি

ছবি : সংগৃহীত

আইন-আদালত

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে আন্দোলন-রিটের প্রস্তুতি

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট সাধারণ শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের দাবির মুখে প্রতিষ্ঠানটিতে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে বুয়েট কর্তৃপক্ষের ঘোষণার বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আদালতে রিট করার প্রস্তুতিও নিচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো। ১৯৬১ সালের যে আইনে বর্তমানে বুয়েট পরিচালিত হয়, সেই আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন করে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির সুযোগ করে দেওয়ার দাবিও জানাবেন সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।

রাজনীতির মাঠে নানা মতবিরোধ থাকলেও বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল একই অবস্থান নিয়েছে। বুয়েটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের পক্ষে আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বুয়েটে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের শাখা কমিটি না থাকলেও সেসব দলও প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্ররাজনীতি ফেরাতে কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিচ্ছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা ও নীতিনির্ধারকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বাংলাদেশের খবরকে জানান,  বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তারা মানেন না। সে কারণেই গত ১১ অক্টোবর বুয়েটের উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার পর সাত দিন পেরিয়ে গেলেও ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল  নিজেদের বুয়েট শাখা কমিটিও ভাঙেনি। সংগঠনগুলো কমিটি ভাঙবে না বলেও দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেয়। রাজনীতির সুযোগ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বুয়েট উপাচার্যের কাছে ছাত্রলীগ শিগগিরই আবেদন জানাবে। একই আবেদন ছাত্রদল ও কয়েকটি বাম সংগঠনের পক্ষ থেকেও জানানো হবে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট অশান্ত পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে ছাত্রসংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি পালন শুরু করবে বলে জানা যায়।

ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের দাবি, বুয়েটে ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য ছাত্রলীগের গত প্রায় ১১ বছর ধরে নির্যাতন, অন্যায় ও অনিয়মই দায়ী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির হলে হলে ছাত্রলীগের নেতাদের টর্চার সেল ও ছাত্রদের ওপর নির্যাতনসহ নানা কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ছাত্রলীগের একচ্ছত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও দখলদারির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে সেখানে মৌলবাদী ও জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পাশাপাশি প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে বলেও ছাত্রসংগঠনগুলোর আশঙ্কা।

ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ইতোমধ্যে এর বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বুয়েট কর্তৃপক্ষ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের (বহিষ্কৃত) হলের কক্ষ সিলগালা করে দেয়। সিলগালা করা হয় ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হলের একটি কক্ষও। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে। কারণ ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মীর নির্যাতনে শিক্ষার্থী আবরার নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি সৃষ্ট হওয়ায় ছাত্রলীগের কার্যালয় কক্ষ সিলগালা করার বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে মৌলবাদী ও জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যাবে, যা মোটেও শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর হবে না। সিদ্ধান্তটি তাই অযৌক্তিক। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েটে বর্তমানে সৃষ্ট সংকট সমাধান করা যাবে না। তাই এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিগগিরই বুয়েট প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হবে। সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্রলীগ।’

ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন জানান, ‘স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে অস্বাভাবিক রাজনীতির বিস্তার ঘটে। বুয়েটেও তাই হতে পারে। বুয়েট কর্তৃপক্ষের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত তাই আমরা মানি না। বুয়েটে আমাদের যে কমিটি রয়েছে, তা ভাঙা বা বিলুপ্ত করার প্রশ্নই আসে না। কমিটি তখনই ভাঙা হবে, যখন নতুন কমিটি দেওয়া হবে।’

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হবে। আর এর জন্য ছাত্রলীগই দায়ী থাকবে। কারণ তারাই ক্যাম্পাসগুলোতে দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি চালু করেছে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে প্রশাসনের স্বৈরাচারিতা বাড়বে। আমরা বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে নই।’

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাকে ‘একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ বলে দাবি করেন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কথিত ছাত্ররাজনীতি বন্ধ আছে, সেখানেও প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ ও গোপনে ছাত্রশিবিরের তৎপরতা আছে। এছাড়া প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র সেখানে প্রবল মাত্রায় চালু থাকবে।’

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে পাঁচটি বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট। জোটের অভিযোগ, বাস্তবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ছাত্ররাজনীতির ওপর নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার বিষয়টি ‘ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রতারণা’ বলেও জোটের দাবি। 

তবে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করা থেকে ছাত্রসমাজকে দূরে রাখতে বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত স্বস্তিদায়ক। ছাত্ররাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চলছে, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তার অবসান হওয়া জরুরি। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনেই রাজনীতির নামে গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সংঘাত ও  সহিংসতাসহ নানা অপকর্মে শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে। নিজেদের অধিকার কিংবা দাবি নিয়ে তারা অবশ্যই কথা বলবেন, তবে তা হতে হবে দলীয় ব্যানারের বাইরে থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হওয়ার প্রবণতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে। তারা রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পেছনে অনেক সময় শিক্ষকদেরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সায় থাকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads