• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলা কবিতার কিংবদন্তি

কবি আল মাহমুদ

ছবি : সংরক্ষিত

সাহিত্য

আল মাহমুদ

বাংলা কবিতার কিংবদন্তি

  • বকুল আশরাফ
  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

১৯৬৩ সালে ‘লোক লোকান্তর’ দিয়ে কবিতার যাত্রাপথে চলমান এই বলিষ্ঠ কবি বর্তমান সময়ে এসেও ‘তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে’র মতো কাব্য উপহার দিয়ে চলেছেন। যাত্রাপথে— বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধিকারের আন্দোলন এবং সর্বোপরি মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তার উত্তরাধিকারী কবি আল মাহমুদ। মৌলিক সৃষ্টিকর্মে পরিপূর্ণ কবি তিনি। সময়ের বাঁক-বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতা অনিবার্যরূপে ক্রিয়াশীল থেকেছে, গতিশীল থেকেছে। সময়ের পথ ধরে আল মাহমুদ কবি হয়ে উঠতে গিয়ে নিজস্ব কাব্যদর্শনও নির্মাণ করেছেন। কিন্তু মৌলিকত্ব থেকে কখনো সরে আসেননি। নদীমাতৃক ও গ্রামকেন্দ্রিক সমাজে আল মাহমুদের বেড়ে ওঠা। সুতরাং সেই জনপদ, প্রকৃতি, মানুষ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির মিশ্রণ ইত্যাদি তার কবিতায় প্রাণবন্তভাবে উপস্থাপিত হতে দেখি। বাংলা, বাঙালি, স্বাধীনতা, বাংলা ভাষা— এসবের সঙ্গে আল মাহমুদের কবিসত্তা অবিভাজ্য। বাংলা কবিতার আধুনিক ধারাকে অগ্রগতির পথে যে কজন সমকালীন কবি ধাবিত রেখেছেন আল মাহমুদ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

 

কবিতায় জীবন ও প্রকৃতির শৈল্পিক শব্দ সম্ভার ছড়িয়ে দিয়েছেন, তৈরি করেছেন কাব্যময়তা। বর্তমানকে ইতিহাস করেছেন আর অতীতকে বর্তমানের মানসপটে এঁকেছেন। সময়ের পূর্বাপর সম্পর্ককে উপস্থাপন করেছেন পাঠকের হূদয়ে। তাই কবি ইতিহাস থেকে ছেঁকে নিয়েছেন রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতিবোধ, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং আবার করেছেন মানুষের সন্ধান।

 

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন এই কবি। গ্রামীণ জীবনকাঠামো, জীবনসংস্কৃতির সহজ-সরল অভিজ্ঞতার ভেতরে থেকে আজীবন তাকেই লালন করেছেন। তাঁর কবিতায় নিজস্ব নির্মাণ হচ্ছে বাংলাদেশের ভূগোল। এই ভূগোল তার কবিতার মানচিত্র। তার নিজস্ব ভাষাশৈলী। নাগরিক যন্ত্রণা থেকে ফিরে আসা। এক ধরনের প্রত্যাবর্তন। যে প্রত্যাবর্তনে কোনো লজ্জা নেই। আর যদি থাকেও তা মাকে জড়িয়ে ধরে ঘষে ঘষে তুলে ফেলার মতো। এখানেই একজন কবি পূর্বসূরিদের পথ থেকে বাঁক নিয়ে সৃষ্টি করেন নিজস্ব বাঁক। নদীর মতো ছুটে চলা সমুদ্রের খোঁজে। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক/কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,/এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক/নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।” [সোনালী কাবিন]

 

কবি আল মাহমুদ সহজ সচ্ছল শব্দ ব্যবহারের কবিত্বশক্তির অধিকারী। তার ‘সোনালী কাবিন’ অনবদ্য এক কাব্য যা বাংলা কবিতা সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে থাকবে অনন্তকাল ধরে। সমকালের প্রভাব কবির মধ্যেও আলোড়িত। সময়কে এঁটে দিয়েছেন তিনি কবিতার পিক্তমালায় শব্দ গাঁথুনিতে, বাংলাদেশের কবিতার দেয়ালে। রয়ে যাবে এই নিজস্বতা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হয়ে। কবিতা সম্পর্কে কবির নিজস্ব ভাবনা এরকম : ‘আমার ব্যক্তিগত জীবনে কবিতা হলো আশা ও বিশ্বাসের মধ্যে বেঁচে থাকার অবলম্বন। সমাজের রুচিবোধ ও আধ্যাত্মিকতার নির্মাতা হিসেবে এক একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে কবির আবির্ভাব হয়। কবি তার জাতীয় ভাষার শব্দরাজির প্রচলিত অর্থকে পরিবর্তিত করে নতুন অর্থের মহিমা দান করেন।’

 

নারী, কাম, যৌনতা, নারীর অবয়ব, প্রেম বার বার ফিরে এসেছে কবি আল মাহমুদের কবিতায়। নারী একটি নির্দিষ্ট অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বা কবিতায় দখল নিতে পেরেছে। কবি নিজেই বলেন, ‘আমার কবিতায় বাস্তব অর্থে নারী একটা প্রধান স্থান দখল করে আছে।... বাস্তব অর্থে মানব জীবন যেমন, তার আচরণ যেমন, তার সম্বন্ধসূত্র যেমন, তার যৌনতা যেমন, সবগুলো নিয়েই সাহিত্য হয়।’ তার প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে নারীস্তোত্র নিয়মিতভাবে এসেছে। আবার কখনো সামাজিক অবস্থা বর্ণনায় নারীর অসহায়ত্বকে কবি চিত্রিত করেছেন। কোথাও নদী, নারী ও কবিতা মিলেমিশে গেছে। আবার প্রকৃতি ও নারী হয়েছে একাকার, ‘সঙ্গমসুখী রাতের পাখিরা/শব্দ করে/আমাদের প্রতি জানাল তাদের/অবোধ ঘৃণা;/তুমিও বুকের বোতাম বাঁধন/আলগা করে/বললে নীরবে, আমাকেও করো লজ্জাহীনা।” [স্মরণ, লোক লোকান্তর]

 

তার কবিতাসুলভ বৈশিষ্ট্যে রঞ্জিত, শব্দের ঝংকারে ঝংকারিত, অভাবিত চিত্রকল্প অনুপ্রয়াসকে সঙ্গী করে চলে। কবিতায় কবিতার সংজ্ঞা আঁকেন কবি বিভিন্ন অনুষঙ্গে, যেন জীবন্ত এক গ্রামীণ পটভূমিতে বেড়ে ওঠা সাধারণ পরিবার। আর এভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার কবিতায় এসেছে আঞ্চলিক শব্দের কারুকাজ। বাংলার আঞ্চলিক ভাষার সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার থেকে বহু শব্দরাজি কবি তুলে এনেছেন। আধুনিক সাহিত্যকে যে আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহার আরো সমৃদ্ধ করতে পারে, তার প্রমাণ রেখেছেন কবি আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে।

             

অন্যদিকে লিরিকই আল মাহমুদের কবিতার প্রধান ফোয়ারা। কবিতাকে প্রাণোজ্জ্বল করে তুলেছে। তবে তার রয়েছে বেশকিছু সনেট ও সনেটপ্রতিম কবিতা যা একটি স্বতন্ত্র স্বাদ তৈরি করেছে। বেশিরভাগই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। নদীপ্রধান এই বাংলাদেশের নদীগুলো শীর্ণকায় রূপ নিচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে, জেগে উঠছে চর। খরস্রোতা বহতা আর নেই। ‘দোয়েল ও দয়িতা’ কাব্যে এমনই এক নদী পদ্মা/গঙ্গা নিয়ে আল মাহমুদের প্রতিবাদী সনেট। একদিন যার ছিল অজগরী স্বভাব ফুঁসে উঠত বর্ষা এলেই। যার ফণায় বিদ্ধ কত জনপদ। বিলীন কতশত বাড়িঘর। যার প্রবল ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গ্রাম আর গ্রাম। আবাদি ফসল। সেখানে এখন আর জলের বিচরণ নেই। ফারাক্কার জাদুমন্ত্রে সে নদী আজ দড়ির মতো শীর্ণ আকার নিয়েছে। নদীর অভাবে খাঁ খাঁ বিরান আজ বিস্তৃত অঞ্চল। অথচ নদীর গর্জনে যারা জেগে উঠত তারা অপেক্ষায়। তবে একদিন কি আবার খরার ফাটল বেয়ে নেমে আসবে সেই জলধারা! কোথায় সেই পৌরাণিক মুনি যিনি গঙ্গাকে পান করে হাঁটু দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। কোথায় তার আদরের কন্যা জাহ্নবী, গঙ্গার নামে যার নাম। কেন সে ধেয়ে আসে না তরঙ্গ নূপুর বাজাতে বাজাতে। এই জলধারা সবার। কারো একার নয়। তবে আসুক। নেমে আসুক আবার গঙ্গার জলস্রোত সব ভেঙে-চুরে। থাকুক নদী সচল নিরবধি।

 

পুরাণের ঐরাবত বেঁধে রেখে জীবনের প্রাণপূর্ণ ধারা

শুয়ে আছে গতিপথে অহঙ্কারে উচ্চে তুলে শুঁড়,
কোথা সেই জহ্নুমুনি ছিঁড়ে ফেলে অন্যায় পাহারা
ফেরাও তোমার কন্যা জাহ্নবীর তরঙ্গ নূপুর।

নদীর গর্জন শুনে প্রাণ পাক এ দেশের বিরান অঞ্চল

খরার ফাটল বেয়ে আবার নামুক গঙ্গা। সকলের জল। 

                                 [খরা সনেটগুচ্ছ-৫, দোয়েল ও দয়িতা]

 

কাব্য নির্মাণে যত্নবান কবি আল মাহমুদ। শহুরে জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে গ্রামের শ্যামল স্নিগ্ধ স্বাভাবিকতা জুড়েই তার কাব্য-ভাবনা। শব্দের গাঁথুনি দিয়ে আঁকা তার কবিতা-চিত্রকল্প অন্যের চেয়ে আলাদা বলেই কবির স্বতন্ত্রতা মুগ্ধ করে অগণিত বাংলা কবিতার পাঠকদের।

 

বকুল আশরাফ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads