• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
কবিতার এক রাজপুত্র

কবি আল মাহমুদ

ছবি : সংরক্ষিত

সাহিত্য

আল মাহমুদ

কবিতার এক রাজপুত্র

  • সৈয়দ শিশির
  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

১১ জুলাই ছিল বাংলা কবিতার রাজপুত্র কবি আল মাহমুদের ৮৩তম জন্মদিন। পুরো একটি জীবন কবিতার পথে কাটিয়ে যিনি এখন প্রায় গোধূলিলগ্নে। সেই কবিজীবনের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে আছে বাংলাদেশের বাঁক-বদলের ইতিহাস। স্বদেশের শক্তি বুকে নিয়ে যিনি ৮৩ বছরে পা রেখেও শব্দ জাদুময়তার ভেতর দিয়ে পাঠকদের চমকিত করে চলছেন সমান তালে। সোনালী কাবিন আল মাহমুদকে এনে দিয়েছে তুমুল কবিখ্যাতি। কবিতার পাশাপাশি যিনি পাঠকের কাছে চমৎকার ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্প, উপন্যাস।

আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের মোড়াইলের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। বাবা মীর আবদুর রব ও মা রওশন আরা মীর। স্ত্রী মরহুমা সৈয়দা নাদিরা বেগম। শৈশবেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—বাল্যশিক্ষার বাইরেও বইয়ের একটি বিশাল জগৎ আছে। তাই কিশোর বয়সেই পড়ে নিয়েছিলেন ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি, ইতিহাসের ধারা ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ বিষয়ক বইগুলো। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথগুলো তার কখনোই সহজ ছিল না। বরং বলা যায়, নানা ধরনের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হয়েছে তার শিল্পী-মানস।

১৯৫৪ সালের এক শীতের সকাল। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ১৮ বছরের এক যুবক। গায়ে ছিল খদ্দরের পিরহান, পরনে খদ্দরের পাজামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল আর বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা একটি ভাঙা সুটকেস। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন কবি হতে। ঢাকায় আসার পর আল মাহমুদ পরিচিত হন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গে। জীবিকার প্রয়োজনে দাদাভাই তাকে দৈনিক মিল্লাতে প্রুফ রিডারের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীকালে তিনি সাপ্তাহিক কাফেলা ও দৈনিক ইত্তেফাকে চাকরি করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে কবি আল মাহমুদ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। ১৯৭৩ সালে কারাবরণের পর তিনি ১৯৭৫ সালে মুক্তিলাভ করেন। তিনি জেলে থাকাবস্থায় গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেওয়া হলেও ততদিনে তার কবিখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল রাষ্ট্রপতির বাসভবন পর্যন্ত। যে কারণে কারামুক্তির পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চাকরি দেওয়া হয় এবং ১৯৯৩ সালে তিনি পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন।

কবিতাকে একেকজন সংজ্ঞায়িত করেছেন একেকভাবে। আল মাহমুদ ‘কবিতা এমন’-এ চমৎকারভাবে বিধৃত করেছেন বিমূর্ত এ ধারণাকে- ‘... কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস/ ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর/ গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর/ কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ দু-চার পিক্ত পাঠেই বোঝা যায় আল মাহমুদের কবিতায় রয়েছে গ্রামীণ আবহের বর্ণচ্ছটা। লোকজ উপাদান ব্যবহার করে চমৎকার বয়ন-কৌশল; ইসলামী মিথ এবং পুরাণের ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে। এভাবেই রবীন্দ্র-পরবর্তী তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় তিনি একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। প্রসঙ্গত, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে একটি চিঠি। কবিতা পত্রিকার জন্য আল মাহমুদ তিনটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন, তারই প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু এভাবে- ‘প্রীতিভাজনেষু, তোমার কবিতা পেয়েছি, একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে বলে মনে হচ্ছে’ এই একটিমাত্র বাক্য। পরবর্তীকালে চৈত্র সংখ্যায় আল মাহমুদের তিনটি কবিতাই ছাপা হয়েছিল। উল্লেখ্য, একই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ পঞ্চাশের শক্তিমান কবিদের কবিতা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি আল মাহমুদকে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য লোক লোকান্তর এবং ১৯৬৬ সালে কালের কলস। এ দুটি কাব্যের ভেতর দিয়েই আল মাহমুদ নিজেকে সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব ঘরানার কবি হিসেবে প্রকাশ করেন। তার তৃতীয় কাব্য সোনালী কাবিন প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।

কবিতায় শব্দ-ব্যবহারের ক্ষেত্রে আল মাহমুদ সম্পূর্ণ শুচিবায়ুমুক্ত। লোকজ গ্রামীণ শব্দ থেকে শুরু করে ইংরেজি, আরবি-ফারসি, এমনকি অন্য অনেক আধুনিক কবির সযত্নে এড়িয়ে-চলা প্রাচীন সংস্কৃত ও সাধুভাষার শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন এবং প্রয়োগকৌশলে জুতসই করে তুলেছেন। লোকজ শব্দভান্ডার থেকে ‘পাইলা’ (পাতিল), ‘টুম’ (কলার), ‘হগল’ (সকল), ‘আজকা’ (আজ), ‘লও’ (রক্ত), ‘সুখটান’ (বিড়ি বা সিগারেটের শেষ টান), ‘ঠিল্লা’ (কলসি), ‘জেয়র’ (অলঙ্কার) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে তাঁর কবিতার ভাষায় নতুনত্ব আরোপ করেছেন। আধুনিক কবিদের পরিত্যক্ত সাধু ভাষার ও কেতাবি শব্দ ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারেও তিনি শুচিবায়ুমুক্ত, যেমন ‘নারি’ (পারি না), ‘ছলবে’ (ছলনা করবে), ‘লক্ষি’ (লক্ষ করিয়া), ‘রাখি’ (রাখিয়া) ইত্যাদি শব্দের দ্বিধাহীন ব্যবহার তাঁর কবিতার ভাষাকে ভিন্নতা দান করেছে এবং আধুনিকতাকেও আবহমানতার সঙ্গে অন্বিত করেছে। তার কবিতায় রয়েছে উপমা ও উৎপ্রেক্ষার প্রাধান্য। প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। কাব্যে গ্রিক পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, বাংলা সাহিত্যের লৌকিক দেব-দেবীর কাহিনী এবং কোরআন-হাদিসের নানা প্রসঙ্গ মিথ হিসেবে ব্যবহার করে আল মাহমুদ কাব্যবোধে নতুনত্ব আনয়ন করতে সমর্থ হয়েছেন। ধর্মীয় পুরাণ, ধর্মীয় নৈতিক কাহিনী, পুরনো মূল্যবোধ ভেঙে নতুন মূল্যবোধ তৈরিতে কবি আল মাহমুদ অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্য হচ্ছে লোক লোকান্তর, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, আমি দূরগামী, সোনালী কাবিন প্রভৃতি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আল মাহমুদ সোনালী কাবিন-এর কবিই হয়ে আছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এটি সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় কাব্য। এছাড়া রয়েছে তার ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ রচনা এবং ভ্রমণ সাহিত্য। ১৯৭৫-এ তার প্রথম ছোটগল্পের বই পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয় এবং বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। বলা যায়, চিত্রকল্প নির্মাণে তার অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় কাব্যসম্ভার ছাড়িয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’-তেও পরস্ফুিটিত। গত এক দশক ধরে ঔপন্যাসিক হিসেবেও কম আলোচিত নন। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা তার উপন্যাস কাবিলের বোন ও উপমহাদেশ উপন্যাস দুটি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে শুধু ঋদ্ধই করেনি সংযোজন করেছে ভিন্নমাত্রা। সন্দেহ নেই ‘কাবিলের বোন’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত অধ্যায়ের শব্দরূপ।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জয়বাংলা পুরস্কার, হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার, সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ কবি আল মাহমুদ অর্জন করেছেন দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। আল মাহমুদের সৃষ্টিসম্ভার বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে, এখনো করছে। সচল থাকুক এ মহৎ শিল্পীর হাত। জন্মদিনের শুভেচ্ছা ‘সোনালী কাবিন’-এর কবিকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads