• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
শিল্পী রশিদ চৌধুরী

শিল্পী রশিদ চৌধুরীর আঁকা শিল্পকর্ম, ইনসেটে শিল্পী

সাহিত্য

শিল্পী রশিদ চৌধুরী

  • আনিসুজ্জামান
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

চারু ও কারুকলা কলেজের যে ক’জন ছাত্র সাহিত্যানুরাগী ছিলেন, তাঁদের একজন রশিদ চৌধুরী। এই সূত্রেই বেগম (পরে সওগাত) পত্রিকার অফিসে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের কোনো এক পাক্ষিক সভায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৫১ সালের একেবারে শেষে বা ১৯৫২ সালের একেবারে গোড়ায়। যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন রশিদদের উপরের ক্লাসের ছাত্র এবং আমার অগ্রজপ্রতিম আমিনুল ইসলাম। রশিদ তখন প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন, আমি জগন্নাথ কলেজে আইএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। অচিরেই আমরা আবিষ্কার করি যে, রশিদ আর আমি চার-পাঁচটা বাড়ির ব্যবধানে ঠাটারি বাজারে একই রাস্তায় (পোশাকি নাম বামাচরণ চক্রবর্তী রোড) বাস করি। সেই থেকে রশিদের বাড়িতে আমার হানা দেওয়া শুরু। রশিদ কদাচিৎ আমার বাসায় আসতেন। তাঁর বাবা ইউসুফ হোসেন চৌধুরী অবস্থাপন্ন মানুষ ছিলেন। লোকে তাঁকে জমিদার বলে জানত- যদিও তখন সে জমিদারির কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তবে সে সময়ে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। রশিদ পিতার রাজনীতি পরিহার করেছিলেন এবং নিজের নামের মধ্যখানের হোসেনও। আমরা তখন বামপন্থায় দীক্ষা নিচ্ছিলাম।

রশিদের হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল, ফলে রাজনৈতিক পোস্টার লেখার দায়িত্ব প্রায়ই তাঁর প্রতি অর্পিত হতো। আমার কাজ ছিল তা জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, এখানে তা বলি। ১৯৫২ সালের ২৩ বা ২৪ ফেব্রুয়ারি হবে। রশিদের কাছ থেকে পোস্টার নিয়ে আমি সাইকেলে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে পৌঁছাতে যাচ্ছি সন্ধ্যাবেলায়। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের সামনের রাস্তা দিয়ে যেই হাসপাতালের দিকে বাঁক নিয়েছি, ট্রাফিক পুলিশ আমাকে আটকে দিল। পোস্টারের জন্য নয়, সাইকেলে বাতি না থাকায়। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গেলাম এই ভেবে যে, থানায় নিয়ে গেলে পোস্টারের কারণে আমার বিপদ হবে। পশু হাসপাতালের দেয়ালে ঠেস দিয়ে সাইকেল রেখে আমি রাস্তায় পায়চারি করতে থাকলাম এবং এক সুযোগে খবরের কাগজে মোড়া পোস্টারগুলো পাঁচিলের উপর দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ফেলে দিলাম। বাতিহীন সাইকেলচালক আরো দু-চারজন ধরা পড়ল, কিন্তু থানায় না নিয়ে গিয়ে আমাদের সতর্ক করে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। তখন পোস্টারগুলোর জন্য আমার কী আফসোস!

রশিদ তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র- ক্লাসের কাজ হিসেবে প্রতিকৃতি আঁকতে হবে। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ওয়ারীর এক বাসায়। তার ভাড়াটে- আমার শিক্ষক- অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কারাবন্দি, বাসা শিল্পী কামরুল হাসানের জিম্মাদারিতে। সেখানে আমাকে মডেল করে তৈলচিত্র আঁকলেন দুই সহপাঠী- রশিদ চৌধুরী আর মুর্তজা বশীর। ছবি দুটো থাকলে আজ তা কৌতূহলের সামগ্রী হতো।

বয়সে রশিদ আমার চেয়ে প্রায় পাঁচ বছর বড় ছিলেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, তিনি আমাকে আনিস ভাই বলে সম্বোধন করতেন, আমি তাঁকে রশিদ বলে ডাকতাম। এটা রশিদের ঔদার্য এবং আমার জ্যাঠামির পরিচায়ক।

মূলত পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের উেযাগে ঢাকায় ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে আরো কিছু কর্মসূচিও নেওয়া হয়- তার একটি ছিল চিত্রকলা প্রদর্শনী, তার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, রশিদ ছিলেন তাঁর প্রধান সহায়ক। সেইসঙ্গে অবশ্য আবদুস সবুর ও ইমদাদ হোসেন ছিলেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে জয়নুল আবেদিন তত্ত্বাবধান করেছিলেন। প্রদর্শনীতে রশিদের একটি তৈলচিত্র ছিল। আমার মনে হয়, ছাত্রজীবনে তেলরংই ছিল তাঁর প্রিয় মাধ্যম।

এর অল্পকাল পরে রশিদ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে কলেজের ডিগ্রি লাভ করেন এবং অচিরেই সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তারপর স্পেনে যান সে দেশের সরকারি বৃত্তি পেয়ে, তবে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে আসেন। কয়েক মাস পরে ফরাসি সরকারের বৃত্তিলাভ করে তিনি প্যারিসে যান এবং থাকেন ছ বছর। এবারে দেশে ফেরেন ফরাসি ভাষায় দক্ষতা, ফ্রেসকো ও ট্যাপেস্ট্রিতে ডিপ্লোমা এবং ফরাসি স্ত্রী নিয়ে। তিনি আবার আর্ট কলেজে যোগ দেন, কিন্তু শুনেছি, সরকারের বিনা অনুমতিতে বিদেশি বিয়ে করায় চাকরি হারান। তবে তারপরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে খণ্ডকাল শিক্ষক নিযুক্ত হন।

ফ্রান্সে থাকতে রশিদ সেখানকার নানাবিধ সাহিত্য ও শিল্পকলা আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং প্রভাবিত হন সুররিয়ালিজম ও তার আগের দাদাইজমের দ্বারা। তার পরিচয় পাই কালি ও কলমের অজস্র স্কেচে এবং অন্য কিছু কবিতা-রচনায়। ঢাকায় একটা ছোট বৃত্তে তিনি ‘না’ নামে একটি সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলেন, যদিও তা ছিল স্বল্পায়ু। ‘না’ নামে এই আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্রও তিনি প্রকাশ করতেন। তাতে কালি-কলমের স্কেচ থাকত, থাকত কবিতা ও প্রবন্ধ। যে ট্যাপেস্ট্রি তিনি বিদেশে শিখে এসেছিলেন, তার চর্চাও শুরু করেন অল্প কয়েকজন শিষ্য নিয়ে। রশিদ তার নাম দিয়েছিলেন তাপিশ্রী। আমাদের শিল্পকলার ইতিহাসে এই তাপিশ্রীই ছিল রশিদের প্রধান অবদান। কার্ডবোর্ডে অ্যাক্রিলিকে তিনি ছোট করে ছবিটি এঁকে নিতেন, তারপর নিজের তৈরি রঙিন সুতো বা উল দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে তা বুননে ফুটিয়ে তুলতেন। কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বহুজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রশিদের তাপিশ্রী আছে এবং দর্শকমাত্রই তা আজো উপভোগ করেন। ধুলোর কারণে তাপিশ্রীর শ্রী ঢাকা পড়ে যায়, তবে নিয়মিত পরিষ্কার করলে তা নতুনের মতোই দেখায়।

১৯৬৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই। অল্পকাল পরে রশিদও সেখানে যোগ দেন চারুকলার একমাত্র শিক্ষক হয়ে, তারপরে অধ্যক্ষতার দায়িত্ব নিয়ে তিনি চারুকলা বিভাগ গড়ে তেলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উেযাগ ছিল অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের। তাঁর প্রেরণায়ই রশিদ সেখানে যান, আমিও তাঁকে উৎসাহিত করি। তারপর রশিদ নিজের প্রয়াসে মুর্তজা বশীর ও দেবদাস চক্রবর্তীকে বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে নাট্যকলায় পাঠদানেরও ব্যবস্থা হতো- জিয়া হায়দার সে বিষয়ের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন দীর্ঘকাল। রশিদের অনুরোধে সৈয়দ আলী আহসান সেখানে নন্দনতত্ত্ব পড়াতেন এবং শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষক থাকতেন। তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে গেলে ওই দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়। পরে আমি ক্লাস নিতে না পারলেও মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আরো একটি কাজ করেছিলেন রশিদ চৌধুরী, তার তাৎপর্য হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। তা হলো, চট্টগ্রামে একটি চারুকলা কলেজ স্থাপন। রশিদের প্রধান যুক্তি ছিল এই যে, একটি চারুকলা কলেজ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ছাত্র পাওয়া সহজ হবে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় নগর- অমন একটি কলেজ থাকলে এখানকার সাংস্কৃতিক জীবনে গতি আসবে। আবুল ফজলের বাসভবন ‘সাহিত্য নিকেতনে’ তাঁরই সভাপতিত্বে নাগরিকদের এক সভায় এই লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠিত হলো। আবুল ফজল সভাপতি, রশিদ চৌধুরী সম্পাদক, কামাল এ খান, সৈয়দ মোহাম্মদ শাফী, মাহমুদ শাহ কোরেশী, সাবিহ উল আলম, আমি এবং আরো কয়েকজন সদস্য। শিল্পপতি এ কে খান খুব আনুকূল্য করেছিলেন। তার ফলেই চট্টেশ্বরী এলাকায় কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হলো- প্রথম অধ্যক্ষ হলেন সবিহ-উল আলম। এখন একটু বর্ধিত আকারে সেটি হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভবন।

অল্পকালের মধ্যেই আমাদের জীবনে আবির্ভূত হলো ১৯৭১ সালের মার্চ মাস এবং অসহযোগ আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক সভায় গঠিত হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ- গণিত বিভাগের ফজলী হোসেন ও বাংলা বিভাগের মাহবুব তালুকদারকে করা হলো তার যুগ্ম আহ্বায়ক। অনেকের সঙ্গে রশিদ ও আমি সদস্য। ওদিকে সাহিত্য নিকেতনে আহূত সংস্কৃতিসেবীদের এক সভায় গঠিত হলো শিল্পী, সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ-সংঘ। সভাপতি-সৈয়দ আলী আহসান, সহ-সভাপতি আমি ও কামাল এ খান, সম্পাদক মমতাজউদদীন আহমদ, রশিদ এখানেও সদস্য। চিত্রশিল্পীরা তখন প্রকাশ করেন ‘বাঙলায় বিদ্রোহ’ নামে ছাপচিত্রের একটি অ্যালবাম- তাতে রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মিজানুর রহিম, সৈয়দ আনসার আলী ও সবিহ উল আলমের একটি করে ছাপচিত্র ছিল। এর পরিচয়লিপি লেখেন মাহমুদ শাহ কোরেশী। রশিদের ছবিতে বাঙলার লোক-ঐতিহ্যের প্রতিফলন ছিল। পরে যাঁরা রশিদ চৌধুরীর শিল্পকর্মে লোকজ উপাদানের কথা বলেছেন, তাঁদের মনে এ ছবিটির কথা হয়তো কাজ করেছিল।

২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণের পর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম। চট্টগ্রামের কাজিরহাট গ্রামে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে কিছুকাল কাটিয়ে সপরিবারে আমি গেলাম আগরতলায় এবং সেখান থেকে কলকাতায়। রশিদ তাঁর পরিবার নিয়ে কিছু পরে চলে যান প্যারিসে। সেখানে তিনি ও তাঁর স্ত্রী আন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক অভিযান চালান। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পরে রশিদ দেশে ফিরে আসেন সপরিবারে। আগে তাঁরা থাকতেন চট্টগ্রাম শহরে, এখন সংসার পাতলেন বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়। তাঁরা ও আমরা হয়ে গেলাম নিকট প্রতিবেশী।

এই সময়ে রশিদ চৌধুরীর পারিবারিক জীবন নিকট থেকে অবলোকন করার সুযোগ হয় আমার। রশিদকে দেখেছি প্রেমময় স্বামী ও স্নেহময় পিতা হিসাবে। আনও ছিলেন রশিদের প্রতি ভালোবাসায় উেবল, রোজা-রীতাও ছিল বাপের তেমনি ভক্ত।  সাংসারিক কাজকর্ম স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নিতেন রশিদ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজটি নিজেই করতেন। ছুটির দিনে গাড়ির নিচে শুয়ে পড়ে তা পরিষ্কার করতেন, প্রয়োজনে তার যন্ত্রাংশে তেল দিতেন। যন্ত্রপাতির ব্যবহারে এই শিল্পী ছিলেন অতি দক্ষ। আনের কঠিন অ্যাজমা ছিল, মেয়েদের একজনকেও সে রোগ ধরেছিল। অসুখের প্রকোপটা নিয়মিত ছিল, বিশেষ করে, শীতের সময়ে ধুলো আর ঠান্ডায় তা খুব তীব্র আকার ধারণ করত। রশিদ জানতেন, তার কিছু করার নেই, কিন্তু সে-সময়ে তার উৎকণ্ঠা অন্যকেও সংক্রমিত করত।

১৯৭৪ সালে আমি লন্ডনে যাই স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে এক শিক্ষাবর্ষে গবেষণা করতে। যাওয়ার আগে এক সন্ধায় রশিদ আমার বাসায় এলেন তাঁর দুটি ট্যাপেস্ট্রি নিয়ে। বললেন, পরিবার নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন, স্কলারশিপের অতিরিক্ত টাকা লাগবে। এই ট্যাপেস্ট্রি দুটি ওবায়েদ জায়গীরকে দেবেন। সে বিক্রি করে টাকাটা আপনাকে পৌঁছে দেবে। ওবায়েদ আমাকে ১০০ পাউন্ড দিয়েছিল। তা শুনে রশিদ একটু হতাশ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম আরো বেশি পাওয়া যাবে। উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম, ওবায়েদ বলে, শিল্পকর্মের বাজার এখন মন্দা। ১০০ পাউন্ড আমার ভালোই কাজে এসেছিল, তবে ট্যাপেস্ট্রি দেওয়ার পেছনে রশিদের ভাবনাটাই আমাকে অভিভূত করেছিল বেশি।

১৯৭৯ সালে একটা বই লেখার কাজে আমি আবার লন্ডনে যাই- এবার একা! এ সময়ে স্বল্পকালের জন্য রশিদ সেখানে আসেন। যেদিন আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, সেদিন রাতে ফ.র. মাহমুদ হাসানের বাড়িতে আমার যাওয়ার কথা। রশিদকে জোর করলাম আমার সঙ্গে সেখানে যেতে- তাতে আমরা গল্প করার সময় একটু বেশি পাব। খবর দিয়ে যাইনি, কেননা মাহমুদ ও জ্যোস্নার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে আমি দু’একজন অতিথি নিয়ে অনায়াসে তাদের বাড়িতে যেতে পারি। গিয়ে দেখি, মাহমুদ নেই; জ্যোস্নার মুখ দেখে বোঝা গেল, সে আমাদের প্রত্যাশা করেনি। আমি ফিরে আসতে চাইলাম, কিন্তু জ্যোস্না নাছোড়। তার রান্না তখনো চড়ানো হয়নি, সুতরাং দুজনের জন্য বাড়তি রাঁধতে তার অসুবিধে হবে না। ওদের ড্রইংরুমে বসে রশিদ আর আমি গল্প করতে থাকলাম, জ্যোস্না রান্না করে আর আমাদের এটা-ওটা খেতে দিয়ে যায়। বেশ খানিক পরে মাহমুদ ফিরে এলো। আমাকে দেখেই শিরে করাখাত, উচ্চৈঃস্বরে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং রশিদকে সানন্দে স্বাগত জানায় সে। তার হইচইতে রশিদের অস্বস্তি একেবারে দূর হয়ে গেল।

বেশ কিছুকাল পরে লন্ডনেই একদিন ওবায়েদ জায়গীরদার আমাকে বলল, তোমার বন্ধু এখন একজন বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে স্থিত হতে চায়। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। রশিদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আমার যে-অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে এটা মোটেও মেলানো যায় না। ওবায়েদ এমনভাবে কথাটা পাড়ল, যেন এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আমি চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমারও এই মতলব নাকি? ওবায়েদের স্ত্রীও ফরাসি, পরে তাদের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।

ওবায়েদ সে-মুহূর্তে রশিদের পক্ষে দু-একটি কথা বলে জানাল, মেয়েটি তোমারই ছাত্রী। আমার ছাত্রী যে কে, সে-বিষয়ে চিন্তা না করে আমি ভাবতে লাগলাম আন এবং রীতা-রোজার কথা। কী করছে তারা! ঘটনাটা কোন দিকে গড়াচ্ছে!

দেশে ফিরে জানতে পাই, মেয়েটি আমারই প্রিয় ছাত্রী জান্নাত সুলতানা। সে যখন বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়, তখন তাকে সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে চারুকলা নিয়ে আমিই উৎসাহ দিই। সেভাবেই রশিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে।

ততদিনে পরিস্থিতি যতটা জটিল হওয়ার, তা হয়েছে। রশিদ বোধহয় জান্নাতকে বিয়ে করেছেন, মেয়েদের নিয়ে আন ফ্রান্সে ফিরে গিয়েছেন। তারপর রশিদ চেষ্টা করেছেন আন ও মেয়েদের সঙ্গে পুনর্মিলনের।

আমি চট্টগ্রামে ফিরে এলে জান্নাতের একটা চিঠি পেয়েছিলাম- সুন্দর চিঠি। সে আমাকে তার পিত্রালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কিছু কথা বলবে বলে। তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি যাইনি। কী বা আমি বলতে পারতাম তাকে? আবার ভাবলাম, আন যদি আমাকে ডাকতেন, তাহলে কি যেতাম না? তবে তাঁকেও কী বা বলতাম!

রশিদের জীবনটা একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা তিনি আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন শহর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলেন ঢাকায়। তাঁর ট্যাপেস্ট্রি তৈরির কারখানা গেল বন্ধ হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হতে হতে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল ১৯৮১ সালে। আর্থিক চাপ বাড়তে থাকল। ছবি এবং ট্যাপেস্ট্রি ন্যায্য দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে থাকলেন। এরই মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। ওই অবস্থায় প্যারিসে চলে গেলেন। আন এবং রীতা-রোজার সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করলেন। রোগের প্রকোপ বাড়ায় ভর্তি হলেন হাসপাতালে। ফুসফুস ও পেটে জমা পানি বের করা হলো, কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁর জীবনের আশা দেখতে পেলেন না। রশিদ এবারে দেশেই ফিরতে চাইলেন। ডাক্তাররা শর্ত দিলেন- যদি একজন চিকিৎসক সঙ্গে যান, তবেই তাঁরা তাঁকে বিমানযাত্রার অনুমতি দেবেন। প্যারিসে ওবায়েদ জায়গীরদার তাঁর দেখাশোনা করছিল। লন্ডন থেকে ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজকে প্যারিসে এনে তাঁর তত্ত্বাবধানে রশিদ যাতে বিমানে শুয়ে আসতে পারে, তার ব্যবস্থাও সে করল।

ঢাকায় ফিরে রশিদ ভর্তি হন মহানগর ক্লিনিকে, ধানমন্ডিতে। বেবি ও আমি গিয়ে দেখি তাঁর অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের দেখে বোধহয় চিনতে পারলেন, চেষ্টা করলেন একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে তুলতে, তবে কথা বলতে পারলেন না। শুনলাম জান্নাত তাকে দেখতে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আন এবং রীতা-রোজার আপত্তির করণে তার আসা হয়নি। পরে অবশ্য সে ওই ক্লিনিকে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল।

রশিদকে যখন আবার দেখতে যাই, তখন তিনি সংজ্ঞাহীন। ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বরে তিনি চলে গেলেন সকলের মায়া কাটিয়ে, সব তর্ক শেষ করে দিয়ে।

বাংলাদেশের শিল্পকলার ক্ষেত্রে আধুনিক ধারার শিল্পী হিসেবে রশিদের আসন স্থায়ী তাপিশ্রীর মতো একটা নতুন ধারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। আজো যাঁরা এই আঙ্গিকে কাজ করেন, তাঁদের উপর রশিদের প্রভাব স্পষ্ট। কালি-কলমের স্কেচে রশিদের পাকা হাতের পরিচয় পাওয়া যায়। ট্যাপেস্ট্রির জন্য যে-মূল চিত্র তিনি এঁকেছেন, তাতেও তাঁর অঙ্কনে নৈপুণ্য এবং রঙের মনোরম ব্যবহার তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে। অঙ্কন পদ্ধতিতে অনেক সময়ে বিদেশিয়ানা সত্ত্বেও দেশের মানুষ ও প্রকৃতি তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। যেখানেই থাকুন না কেন, স্বদেশকে তিনি ভোলেননি। বাংলাদেশও তাঁকে ভুলবে না। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads