• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

সংস্কৃতির বিদীর্ণ মুখ

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

কাজের সূত্রে  সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে আছি অনেককাল। পড়াতে গেলেও প্রসঙ্গটি বাদ যায় না। চলতে-ফিরতে অনেকেই এ নিয়ে বলেন। কিছু শুনি-বুঝি। কী আছে ওতে, মানুষে মানুষে ঠোকাঠুকিতে অনুসন্ধানের প্রান্ত খুঁজি। কখনো তা কঠিন, জটিল; কখনোবা গোলমেলে। আজকাল তা আরো, অধিক। একটা সময়ে, পাড়ায়-গ্রামে দৈনন্দিনতার যে সময়গুলো ছিল, সেখানে মূল্যবোধের সংস্কৃতিটা অন্যরকম ছিল; অন্তত এখন তা মনে হয়। এপার-ওপার বাড়িতে যোগাযোগ খুব আন্তরিকতার ছিল। খাওয়া-পরা, হাঁক-ডাক, সম্মান-শ্রদ্ধা সবকিছুরই একপ্রকার আমন্ত্রণ ছিল। চিঠির যুগে পড়ালেখার কৃষ্টি বোঝা যায়। আমরা চিঠির যুগের মানুষ। ষড়ঋতুতে মিলিয়ে দিনগুলো মাপা হতো তখন। রোদ-বৃষ্টি-গরম-ঠান্ডা ধরে স্কুল-পাঠশালা গড়ে ওঠে। মাস্টারমশায়রা খুব ভালো লোক বলে, যা পড়াতেন তা মনে ধরতো। প্রাইভেট নয়, লজিং ছিল; শ্লেট, পেন্সিল, ফাউন্টেন পেন ছিল। নতুন কলমে ভালো লেখা যায়, কারণ মন ভালো হয়ে যেত। স্যারদের পাঞ্জাবির পকেটে ভালো কলম দেখলে লোভ হতো। একই সঙ্গে স্যারের কলমের প্রতি সমীহও পয়দা হতো। তো যা-ই হোক, এসব বয়স বাড়ার ফের। কথায় বলে, বয়স বাড়লে আত্মকথা বলার প্রবণতা বাড়ে। তাই তো নিজের স্মৃতি নিজের যৌবন এত সুখের! শান্তিরও বটে। শান্তিটুকু কেন মনে হয়! সংস্কৃতির ধারণ ও গ্রহণের কারণে। কিন্তু সংস্কৃতি তো একরকম নয়। এর রূপান্তর হয়। গোপাল হালদার, সংস্কৃতির রূপান্তরের পথের কথা বলেছেন। সে পথে এখন কত কী? প্রযুক্তি, যোগাযোগ, কম্পিউটার সব; সবার কাছে। যন্ত্র। যন্ত্রদানবই বটে। যন্ত্র ছাড়া কারোরই তো চলে না। কিন্তু একইভাবে প্রশ্ন তবে— নদী নেই, জল নেই, মিষ্টি মাছ নেই, মাংস বিস্বাদ, সবজি তরতাজা নয়; বিপ্রতীপে ফার্স্ট ফুড হাঁকিয়ে চলে সব অস্বীকার করে! খুব কালার এখন সবকিছু। কালারফুল দোকান সব। ঠান্ডা করা যন্ত্রের বাতাস। একরকম দোকানদাররা সব স্যার স্যার বলে চেঁচায়। কেমন লাগে তখন যেন! টক টক গন্ধ। প্রচুর ওয়েস্টার্ন জিনিস এখন। তাতে শৌখিনত্ব আছে। কেউবা দেশালটা পরে ঐতিহ্যের প্রতি আনুকূল্য দেখান। সেখানেও শৌখিনত্ব অপ্রতুল নয়। আছে সব থরে থরে সাজানো। রঙও আছে অনেক। রঙের বাহারে গুরুগম্ভীর। নাচন তার চমকিত। যেন সঙ সেজে বসে আছে সব। তবে মন বড় দুর্লভ। মন নেই। মানুষ আছে মন নেই। মনের বাজার এখন খুব চড়া, অন্তত এ বাজারে। তবে প্রশ্ন আসে মন না থাকলে কী সংস্কৃতি তৈরি হয়!

মন আসলে কী চায়। মনের ভেতরে-বাইরে একরূপ তো হওয়া কঠিন! এ কঠিনতা ক্রমাগত বাড়ছে। এমনটা বাড়ার কারণ, কৃত্রিমতা। মেকি হাসিতে স্যার স্যার ধ্বনি যেভাবে আগ্রাসন তৈরি করে, সেভাবে মনবিচ্যুত সমাজে সবকিছু আনুষ্ঠানিকতার ভাঁড়ামিতে নিমজ্জিত। এই ভাঁড়ামিপনা একটা নাটুকে প্রস্তাব বটে। সেখানে প্রতারণা, মিথ্যাচার, ভীরুতা আচ্ছন্ন। এই আচ্ছন্নতার বেড়াজাল বিধ্বংসিতা ডেকে এনেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। সংস্কৃতি তো হাওয়ায় পাওয়া জিনিস নয়। এটি শুদ্ধাচার, প্রশান্তিপ্রবণ; আচার-ধর্মীয় বিশ্বাস, আনুষ্ঠানিকতা, আর্থনীতিক অবস্থান, ঐতিহ্যগত আবাহন সবকিছুর ভেতর দিয়ে তা তৈরি হয়। সহজ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা মনের আহার জোগায়। মন সেটিকে সতেজ করে, তুষ্ট করে, প্রবহমানতা দেয়— কৃষ্টি সেখানে জমাট বাঁধে। গ্রহণীয় পর্যায় স্পর্শ করে। তাতে যুক্ত হয় নানা মাত্রায়। ভাবে ও বিন্যাসে আসে তার ‘নতুন’ অজুহাত।

এ নতুনত্ব যেন বিলাসী হাওয়ার ছায়ায় আর মায়ায় নতুন প্রণোদনা। এই আনয়ন তো সংস্কৃতিরই কাজ। সুতরাং সংস্কৃতি সহজাতভাবে ভেতর থেকে উঠে আসে। এতে কোনো মেকিপনা নেই। জটিলতা নেই। সংস্কৃতির সহজ কথা বলতে গিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে অন্যের উপকার করার কথা বলেছেন। এই ব্যক্তির সংস্কৃতি। আহমেদ শরীফও সংস্কৃতির অর্থ করতে গিয়ে মননশীলতার কথা বলেছেন। এসব তত্ত্বকথা ঠিক বোঝার প্রয়োজন নেই। সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ সর্বপ্রকার সৃষ্টিশীলতার। এ কথার অতিরেক যদি কিছু গড়ে ওঠে তা হলো সংস্কৃতি এবং মানুষের অভিন্ন পরিপূরক ধারণাই যথেষ্ট। বস্তুত, মানুষকে বোঝার জন্য সংস্কৃতিই শেষকথা। বিষয়টাকে আরো আমলে গ্রহণ করা যায়। যেমন আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা বাংলা। আমাদের বাংলা নামের একটি দেশ আছে। এই দেশের উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ব-দ্বীপ আকৃতির এ দেশটাকে আমাদের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে আমরা মিশিয়েছি। এর বৈশিষ্ট্য বা গুণ বিদ্যমান। মাটির গুণ, আবহাওয়া জলবায়ুর গুণ, সেখান থেকে উঠে আসা কৃষিজ মানুষের গুণ প্রভৃতি।

যদি বলি, এই কৃষিজ মানুষ কেমন! হাজার বছরের ইতিহাসে নদ-নদী বিধৌত পলি পড়া ভূমিতে এরা অনার্য, ব্রাত্য, প্রান্তিক, কেতাবি শিক্ষা তাদের নেই, ধর্ম-বর্ণ তারা তেমন মানে না, উৎসবে তারা একত্রিত, সমন্বয়ী, সমবায়ীভাবে লোকজ, সহজাত-সরল, খুব বড় রকমের মানবিক গুণাবলি দিয়ে তাদের শরীর ও মন ঋদ্ধ। এই সমৃদ্ধিজ্ঞাপকতা হার্দিক, প্রাণজ ও মিস্টিক। মিশে আছে তার ভেতরে চরম আধ্যাত্মিক রস। এভাবে আমাদের সংস্কৃতির অভিমুখ বিরচিত। এ অভিমুখে আবেগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উগ্র ক্রোধ আর সারল্য। যুক্তি ও নিরপেক্ষতা তাতে কম। চাওয়ার চেয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি। ভোগের চেয়ে ত্যাগে আকৃষ্ট। সম্পূর্ণটা মায়া আর স্নেহ দিয়ে পরিবেষ্টিত। ভেতরে জটিলতা বা কুটিলতা নেই। পাড়া-পড়শি সবাইকে নিয়ে সে ঐক্যের সুর রচনা করে। বিধাতার কাছে যাচ্ঞনা করে। মার্গ রূপ তার মনে। প্রেম তার ভাবে। খুব দ্রুত সে জৈবতাড়নায় পর্যবসিত। প্রবৃত্তিও খুব বেপরোয়া। বেহিসাবি। আয়-ব্যয় জানে না।

আবার যে ঐক্যের কথা বলেছি, এ ঐক্যের ভেতরেও লুক্কায়িত আছে সাহস। ভয় অতিক্রমী সাহস। দুর্জয় মনের সাহস। তাই আবেগের কথনপ্রবাহে বিন্যাসশীলতা কম। গল্পপ্রবণ খুব। সত্য সহজ নয়, মিথ্যার প্রশ্রয়ে সত্য গড়ে ওঠে। ফলে বিশ্বাস যেমন প্রবল তেমনি সহজেই অবিশ্বাসের ধারা গড়ে ওঠে। এ সংস্কৃতি ‘মিথ’প্রবণ। মিথ মানেই ভয় আর ক্ষমতার প্রশ্রয়। মিথিক ইতিহাস তাই! অযুক্তির আয় আছে ওতে। অসত্যের মিনার যেন। শুধুই বিশ্বাস আর অযৌক্তিক সমর্থন দিয়ে সবটা ভরা। এই ভরা মাঠের গঠন— প্রকরণ গড়ে দেয় কে? উত্তর থেকে প্রবাহিত মৌসুমি বায়ু। তাতে জলছলছল আবেগ-আনন্দ আর দুঁহু কোরো দুঁহু ভাবার সময়। সে কারণেই কালিদাস সত্য স্বীকরণে ‘মেঘদূত’ লিখতে সমর্থ হন। মেঘদূত একদম আমাদের কৃষ্টির জিস্ট। মূল। এবং চিরকাল তা জনপ্রিয় এ কারণেই। এ প্রেম প্রসিদ্ধিজ্ঞাপকও। মালিন্য পাবে না কখনো। পাওয়ার একটুমাত্র অবকাশ নেই। এই বাঙালি কৃষ্টির চিরায়ত কথা যখন বলে চলি, তখন কিছু ততোধিক প্রত্যয় তৈরি হয় এর ভেতর থেকেই। যেমন : অবসর, আলস্য, আতিথ্য, ঐক্য, উৎসবময়তা, ব্যঞ্জনে সংবর্ধনা, গানে-গজলে-বাউলে নৃত্যপিয়াসী দেহ, ছন্দোময়, প্রেয়সীপ্রবণতা প্রভৃতি। সবটুকু তন্ত্রে, মায়ায় মেশানো। অস্থিমজ্জারউপজাত। ষড়ঋতুর বিচারে তৈরি। ষড়ঋতুই সবটার আধার। এই ঋতু আর জোয়ার-ভাটার তরঙ্গ মনের তরঙ্গপ্রান্ত তৈরি করে। নর-নারীর প্রেম শরীরে-মনে মিশে যাওয়ার অনিবার্য আকর্ষণ ও আহ্বান ওই কৃষ্টির মধ্য থেকেই তৈরি। পরকীয়া-স্বকীয়া সাধনও ওই বৃত্তে উদ্ধৃত। বাউলের গান, দোতরার সুর, ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি তো ওই কেন্দ্রেই উপগত। এই ভূমি-মাটি-আবহাওয়ার দস্তুর। সবটাই প্রেমপ্রবণ। তীব্র ও  আকর্ষকজ্ঞাপক।

এখন নিশ্চয়ই নাগরিক জীবন গড়ে উঠেছে, অর্থ-পুঁজির দাপটে। হর্ম্যপ্রাসাদ গুলজার হয় প্রযুক্তির শক্তিতে। চোখ কান ঝলসে যায়। চোখে ধরে। কৃত্রিমতার সবটুকু শুষে নেয় সহজ চোখ। অধিক অকৃত্রিমতার মানুষও কৃত্রিমতায় গা ভাসায়। কমিউনিটি সেন্টার, এয়ারকুলারের শীত, শীতার্ত করে মনের পালকগুলোকে। নাওয়ের বাদাম বহুকাল আগেই নেমে গেছে। তাতে তৈরি হচ্ছে বাজেটের পর বাজেট ভেঙে চওড়া সেতু। বড় বড় মন জুড়ানো স্প্যান। হৈ বাতাসে শেষ হয় সাঁকো গতিশীল হাইস শকটের চাকার গতিতে। এই ঢাকায় সবকিছুই ‘ফাঁকা’। এক দুই তিন চার করে এখন ঊনপঞ্চাশ বায়ুতে ঊনপঞ্চাশ তলার কাঠামো। গোনার জন্য গ্রামের গফুর এই শহরে এক সময় টাকা দিয়ে তলা গুনেছে এখন আর গুনতে পায় না। লিফটে, চড়াৎ শব্দে উঠে যায় অনেক উপরে। সেখানে মিলিয়ন-বিলিয়ন হিসাব হয়। মালিকের টাকার ব্যাগে টাকা ভরে আর নিরাপত্তার জন্য টোটাভরা পিস্তলও থাকে। তাক করা, অতাক  করা— অবাক রূপ সে পিস্তলের। বাটাম মুছে সাজানো থাকে ব্যাগে।

শোনা যায় মালিকের বাড়ির জমি নিউইয়র্কে, হাভানায়, গুয়াতেমালায়। সিঙ্গাপুর আর বেশ্যার শহর ব্যাংককেও ফ্ল্যাট নিষ্পত্তি হয়েছে। ব্রথেলকন্যারা হাত পেতে নেয় সব। ঘষে নেয় শরীর কিন্তু মন বলে ওদের আর কিছু নেই, তাই মন নয় কোনো কিছুর মূল। এবার-সেবার করে ঘুরে বেড়ান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, বালি, লোহিত সাগর বা গোয়ায়। কখনো আন্দামানের হাওয়ায়। ওঠাচড়া এখন প্লেনে। উঠে গেছে কবেই গরুর গাড়ি, মহিষ টানা সদাগর। ধুলার স্বর কবেই নেমে গেছে গাড়ির চাকা থেকে। গাঁয়ের বধূ আর কেউ নয়! তাদের দুঃখ এখন অন্যরকম। তাদের বসন-গড়ন-পরন সখা এখন অনেকেই। সতীত্বের ছায়া-মায়া ‘অপরিচিত’ শব্দ। নেই তার কোনো স্বরূপ। বোঝেও না। পরিচয়ও কখনো ছিল না। বুঝি দেখা হয়নি কোনোকালে এসব শব্দের উঠানকুল। এরূপে সংস্কৃতি এখন বেশুমার পাল্টায় মান! এই ঢাকা অচিন। সবটাই। তুমুল বদলের সংস্কৃতি সে বহন করে। এই বহনের ভারে সে বিদীর্ণ। নেই কোনো নিজস্ব স্বর। আছে কান্না আর কদর্থ। সবকিছু বেচাকেনা। পুঁজির প্রতাপে। শিক্ষা, পোশাক, শরীর, মন, চুল-নখ, শরীরের শাখা-প্রশাখা সবটা কিনে নেয় ব্যবসায়ী যেন! মিডিয়া ও মিডিয়াম্যানরা। বাতাস বিক্রির অর্থে তাদের দম্ভ ও শক্তি নির্মিত। নারী পণ্য, সে সাজে, সাজায়, সাজতে সাজতে নিজে বহুবার হাতবদল, হাটবদল করে। উপায়হীন সব যেন। বৈশাখ পর্যন্ত বিক্রীত। মহররম বিক্রীত। জন্মাষ্টমী বিক্রীত। সর্ব-ধর্ম-বর্ণ বিক্রীত। বিক্রীত মানুষের মন। বিক্রীত ইলিশ মাছ, সরা, পান্তাভাত। সবকিছুর দামও অনেক। ফুল-ফল ফরমালিনসহ বিক্রীত তাবৎ মাল। তারও অধিক দাম। দামে চলে। দামে মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব। এই এখন সংস্কৃতির দস্তুর। এককালের প্রান্তিক বঙ্গাল, অনার্য বঙ্গাল এখন ব্যবসা শিখে গেছে! সে ফেসবুকে, অ্যাপে সবাইকে নিয়ে মাত করে মাতিয়ে ফেলে। দেশ-বিদেশ বলে কিছু নেই, সব একাকার। থার্টি ফার্স্ট বা বড় দিনময় সময়ে বিশালরূপে সবাই ব্যাপৃত। কীসব নামি-দামি হোটেলে কত রকম ইয়াবা চিজ বার্গারের নেশায় মত্ত। নাম তার বিগ বস, ব্লু ফক্স, সেভেন আই, ব্ল্যাক কাট, ইয়েলো নট ইত্যাদি। প্রচুর অভাবহীন টাকার প্রাসাদ আর প্রসাদ। সেখানে সব সম্পর্ক সত্য (?)। শিথিল শুধু মন না মানা মন। তাবৎ হাওয়া এখন সমুদ্রবিলাস। তাই মন একক ও বিদীর্ণ।

কী হবে তবে? সংস্কৃতির এ রূপ ও তার পরিণতি নিয়ে একপ্রস্থ লিখেই কী, আর না লিখেই কী! পণ্য বিক্রয় ক্রেতা অর্থ পুঁজি করপোরাল কালচার সব শুষে নিলে মন-মনন তীব্রভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। তার পেছনে সমুদ্রবিলাস কাঁদে। কোনো কালে কেঁদেছিল ক্লিওপেট্রা বা জোলেখা বিবি, রুস্তম, শেফালি কিংবা মল্লিকারা। সবাই আছে বদলি প্যাশনে। কিন্তু মন তো বদলি নয়! তাই কন্ট্রাডিকশন চলে সর্বদা। বিব্রত সে কন্ট্রাডিকশন। সরলে বাঁকায়, সস্তায় উচ্চতায়, বোকায় চালাকে, বুদ্ধিতে অবুদ্ধিতে, মিথ্যায় সত্যে, উপরে নিচে— এরকম বিপরীতার্থক দ্বন্দ্বে। সংস্কৃতি তখন অসুখময়, সুধাহীন। ক্রন্দনরত। শিল্পের কী দাম, সাহিত্য কে পড়ে, কবিতা কেন লিখবে, পড়ে কী হয়, জ্ঞানীর দাম কই! দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান কারা পড়ে। ‘ফলিত জ্ঞান’ দিয়ে ভরা এ দুনিয়া। পিতা ছাড়া সব শাখা-প্রশাখার দৌরাত্ম্য। ছেড়ে দাও ওসব, যা দরকার ততটুকু কর। আনো টাকা। করো সমৃদ্ধি (?)। তাক লাগিয়ে দাও। অন্যকে ঠকাও। দুর্নীতি আবার কী! নীতিই তো দুর্নীতির অন্য পিঠ! লেনদেন আদান-প্রদানই এখন মুখ্য। এই মুখ্যকে পাশ কাটিয়ে চললে, চলো পেছনে। প্রতিযোগিতায় হার। অসফল। এই কী কৃষ্টি, এখন!

এরূপ আলাপ এখন একটি কবিতা দিয়ে শেষ করি। কবিতাটি আমার শিক্ষক আবুবকর সিদ্দিক লিখেছিলেন বেশ আগে, শ্রমিক নেতা নূরুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর, তাকে তর্পণ করে :

 

‘উত্থানের স্বপ্নজপ’

যেখানেই সংস্কৃতি সেখানেই মানুষ মানুষের জন্য

যেখানেই দিগন্ত চায় শুদ্ধতম নীলাভ আকাশ

সেখানেই কালো রক্ত সেখানেই খঞ্জরধারী পামর সীমার।

ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে দিবালোকে খুন হয়ে গেছে।

মানুষের ইতিহাসযান চলতে চলতে পথে

বাঁকে বাঁকে কত যে কংকালঅস্থি বালিচাপা রেখে এলো হায়!

আঁশটে তামার গন্ধ সোরা-নাইটার

জৈব হয়ে মিশে গেছে কবিতার শিরা-উপশিরায়।

সেই সব সন্ত যারা ধুনী জ্বেলে শান্তিস্তব করে

তাদের পাঁজরখসা হাড়চূর্ণ এই বালিয়াড়ি।

কেন আনো অশ্রুর আবেগ? এনে রেখো এ সবই তর্পণের উপলক্ষ।

তোমাকে নিঃশ্বাস চেপে অগ্নিযজ্ঞে দিতে হবে হবি।

মধুবায়ু লেশমাত্র আজ আর পৃথিবীতে নেই, তবু এই

ধাতুউৎসর্গ নিয়ে উত্থানের স্বপ্নজপ,

শান্তিপারাবার আমাদের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads