• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

বৃক্ষকথা

  • আসাদুজ্জামান দুলাল
  • প্রকাশিত ২৪ নভেম্বর ২০১৮

বৃক্ষরা কি একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে? কানকথা, গোপন প্রেমকথা? তাদের কথা বলার আছে কি ভাষা? যারা বিশ্বাস করেন বৃক্ষের জীবন আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন, যার জীবন আছে তার আছে বিচরণ। আর এক্ষেত্রে বিচরণের মৌলিক বিবরণ— আহার নিদ্রা, হিংসা, ভালোবাসা, যাত-পাত এমনকি শ্রেণিবিন্যাসের কথাও উঠে আসে। শোনা যায়, বৃক্ষ মানুষ ধরে খায়। সালাতে সেজদা যায়। পরশে রাঙা হয়ে লজ্জায় মুখ লুকায়। এমন অসংখ্য উদাহরণ আনতে পারেন বিশ্ব-বৃক্ষ প্রেমীজন। কিন্তু বৃক্ষ যে কথা বলে এমন প্রমাণ কি দিতে পারেন? শুনেছেন কি বৃক্ষ-ভাষার ব্যাকরণ? উত্তর... না, শোনা যায়নি! এটা অবাস্তব। যাদের বিচিত্র সব আচার আছে, তাদের কি ভাষা নেই? ভাষা ছাড়া কি আচার হয়? পৃথিবীটা অসংখ্য ভাষার স্থলবন্দর— ভাষায় ভাসমান। ভাষা বোঝাটা কি শক্ত ব্যাপার নয়? তবে কি বৃক্ষ নিজ ভাষায় গলা তুলে কথা বলে? এই বাস্তবে কি মানুষ তা শুনতে পারে? না, এটা বাস্তব নয়, পরাবাস্তব। তাহলে কি আমরা ধরে নেব বৃক্ষের ভাষা পরাবাস্তব? আর তার কথা কি অন্তর্নিহিত?

দুই       

আমরা একটি দেশি বৃক্ষের গল্প বলি। যার ডাকনাম ডাক্তার। বিলচলন স্কুলের সহকারী শিক্ষক জিন্না ভাই একদিন চা খেতে খেতে বলছিলেন এই ডাক্তার-বৃক্ষটি বাড়িতে থাকলে নাকি ফার্মেসির ওষুধ কিনতে হয় না! তিনি অনেক যত্নে রন্ধনশালার পাশে এই ডাক্তার-বৃক্ষকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। জিন্না ভাই ডাক্তার নাম দিলেও আমরা দেখেছি বৃক্ষটির রূপ বুনো। স্বভাবে কালো সাঁওতাল। গতর দেখলে গা শিউরে ওঠে। যেন জমিচষা কৃষকের ১৮ ইঞ্চি ফাটা পা। দাউদ ওঠা বাকল সারাক্ষণ সাপের খোসার মতো খোলস বদলায়। তবু গতরে তেল-চর্বির চিহ্ন আসে না। জাতটা এতই জংলি। ফুলের শোভা নেই। ঘন ছায়া নেই। পাখির কোলাহল নেই। যেখানেই চুমু দাও তেতোয় তিক্ত হয়ে উঠবে দেহ-মন-রুচি। ফল পাকলে কাকেরা কেবল দল বেঁধে ভক্ষণ করে। জাতীয় পাখিরা ফিরেও তাকায় না। তবু নাকি বৃক্ষটির নাম ডাক্তার। ভাটো পাড়ার ভোলা তর্জনী ছুড়ে সাক্ষী দেয়, ‘শুধু ডাক্তার নয় হে, মহা ডাক্তার। ধরো, তোমার শিশু বড় হয়েও মায়ের দুধ ছাড়ে না। ডাক্তারের দুটি পাতা বেটে বুকে লাগাও, রাইফেলের গুলির মতো কাজ করবে। ওই শিশু মায়ের বুকে আর মুখ লাগাবে না। হা হা হা...।

এদিকে আবার মহাকাণ্ড! করটিয়ার কবিরা কুলাঙ্গার এই বৃক্ষটির নামে একটি লিটল ম্যাগ বের করে। স্বদেশ ঘরানার সেই কবিতাপত্র দুই বাংলা দাপিয়ে পার্সেল সিলগালা হয়ে পৃথিবীর পথে হাঁটে। কবিতা হয়েও বৃক্ষটি জাতে ওঠে না। একবার বৃক্ষটির বংশধর সবার অগোচরে দীর্ঘ আয়ু নিয়ে বড় হয়েছিল হরিবাসরের সামনে। প্রতি বছর সেই বৃক্ষতলে দুর্গানাশিনী অসুরের বুকে বর্শা বিঁধিয়ে অসুর বিনাশের বিধান দিত শিংয়া ফুঁকে। শুক্লাপক্ষের নবমী তিথিতে নয়নের আরতি নৃত্য ধূপধুয়ার ঢেউ তুলে, ঢেউয়ের তালে তালে স্বর্গের অপ্সরীরা নেমে আসত সেই বৃক্ষতলে। ভক্তরা ভক্তিভরে মানত করে বৃক্ষটির নামের সঙ্গে মন্দিরটির নামকরণ সেলাই করে গেঁথে দেয়। তারপরেও বৃক্ষটি কারো বন্ধু হয় না। ধর্মে ওঠে না। কাঠঠোকরা ফোকড় কাটতে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে। ঘুণপোকারা মুখ ফিরিয়ে থু থু ছিটিয়ে অন্যত্র চলে যায়। বৃক্ষটি প্রেম পায় না। করপোরেটের জগতে জংলিই থেকে যায়। 

তিন

হৈ হৈ কাণ্ড... রৈ রৈ ব্যাপার... পাঁচ দিনব্যাপী বৃক্ষমেলা বাম্পার। বাহারে... ঘেউ ঘেউ। মজার ব্যাপার। প্রেম পোড়া দেশে বৃক্ষবরণ, বৃক্ষ স্মরণ, বৃক্ষ রোধন চলছে। ষোড়শীরা বাকুম বাকুম দল বেঁধে বৃক্ষ মার্কেটে শপিংয়ে যায়। ঈদ আনন্দে গগনে বেলুন ওড়ায়। কচি ডাব, মশলা মুড়ি, গরম চটপটি চাটে আর ঝিলিমিলি রঙ্গমঞ্চে সুশীল ম্যানদের বৃক্ষ প্রেমের বুভুক্ষু বয়ান শোনে। গড়িওষিদের গানে-বাদ্যে শরীরজুড়ে প্রেম জাগে। হাইব্রিড প্রেমিকারা লাইলি মজনুর আখ্যান মিলিয়ে বৃক্ষ আবেগে চোখের জলে বেহুলার ভেলা ভাসায়। বাসর সাজায়। বৃক্ষ-ফুলে লুটোপুটি খায়।

চার       

তাঁবুর দেয়ালে চারপাশ শক্ত আঁটা। বাইরের আলো-বায়ু হল্ড। প্রবেশপথে সংরক্ষিত আলিশান পাঁচতলা গেট। ঢুকতে বুক কাঁপে। বেঁথড় ফলের থোকায় জ্বলে জোনাক আলো। ‘বৃক্ষ প্রেমে ঘুম আসে না... তাই তো আসি ঘুরে...।” বাহারি ফ্ল্যাটে বনের বৃক্ষ জরাগ্রস্ত রোগীর মতো সটান শুয়ে থাকে। হ্যালোজেনের আলো— পারফিউমের ভুরভুর গন্ধে বৃক্ষরা বুকের অক্সিজেন হারায়। শ্বাসকষ্টে ঘুম আসে না। ছটফট করে। একটা ইনহেলার দেব কি?

পাঁচ       

ভাই ভাই স্টলটি মেলার উত্তর কোনায়। কান্নার শব্দটি সেখান থেকেই ভেসে আসে। শিশুকান্না। দুটি ডাক্তার শিশুবৃক্ষ চিৎ হয়ে কাঁদছে। ‘কাঁদছো কেন তোমরা? বেশ তো আজ জাতে উঠেছ। শহরে মেলায় এসেছ। আম রুপালি, মামা ফজলি, বউ ভুলানি, কসমস, বনসাই, বিউটি কুইন, পেয়ারা, জামরুল কদরে একসঙ্গে শুয়ে আছ। বৃক্ষ বেনিয়ারা দাম দিয়ে তোমাকে কিনবে। আদর করে পুষবে। বুনো বদনাম ঘুচে ডাক্তার নাম তোমার সার্থক হবে। তবু কেন কাঁদছ তুমি?’

 

- কাঁদছি প্রজাপতি ও বন্ধু শোকে। চারদিক চেয়ে দেখ, আমাদের পিতা-পিতামহ কেউ বেঁচে নেই। হত্যা হয়েছে অপঘাতে। গণহত্যার দেশে তাই কাঁদি মৃত্যুশোকে, প্রাণভয়ে।

— যা-ই বলো তুমি, দিন কিন্তু এখন পাল্টে গেছে। তোমাদের সম্মান, স্মরণ অনেক বেড়ে গেছে। বৃক্ষপ্রেমে মানুষ এখন মহীয়সী। কত আইন, কত গবেষণা, সেমিনার হচ্ছে তোমাদের ঘিরে জানো? কান্না থামাও। কথা শোন। 

- কিন্তু ইতোমধ্যে আমার যে মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। আর মাত্র একঘণ্টা বেঁচে আছি জগতে।

 

- বলো কি! এই শিশু বয়সেই?

- হ্যাঁ, আমি আজ বিক্রি হয়েছি, এক মৌলভী সাহেবের কাছে। বৃক্ষ নয় দাঁতন হিসেবে। মাগরিবের আজানের আগেই তিনি আমাদের ভেঙে, মুচড়ে দাঁত মাজবেন কৃমিনাশের উদ্দেশ্যে।

হায়! জগতে শুধু মৌলভী সাহেবেরাই নয়— আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্যুট-টাই পরা প্রকৃতিপ্রেমীরাও বৃক্ষ নিধন করে চলেছে নিজ স্বার্থসিদ্ধি লাভে। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads