• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ক্ষত

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

ক্ষত

  • প্রকাশিত ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রায় আট মাস আগে আদিবাদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেয় রুবি। কাজে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে আদিবার মা রুবিকে বকাবকি করলেও তার ছুটিছাটার বিষয়ে তেমন কিছু বলেন না। বিপদ-আপদে দু’পঞ্চাশ টাকা ধার চাইলেও রুবিকে দিতে আপত্তি করেন না। পরে বেতনের টাকা থেকে সমন্বয় করে নেন। এসব কারণেই হয়তো রুবি একটু দরদ দিয়েই আদিবাদের কাজ করে। বেড়িবাঁধের কাছে একটা বস্তিতে সে তার ছেলে মুক্তিকে নিয়ে ভাড়া থাকে। একদিন কাজ করার সময় আদিবার মা দেখেন রুবির মনটা ভীষণ খারাপ। আদিবার মা এর কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমার ছেলেটা এ গ্রেডে পাস করে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। এতদিন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। এখন আমার সামর্থ্য নেই ওকে হাইস্কুলে পড়াব। আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি। বলেছি, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ কর। ক’টা টাকা পাবি। পড়াশোনা করে কোনো লাভ হবে না। বড় হলে তোকে কে চাকরি দেবে? কে শোনে কার কথা। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। আপা বলেন, আমার পক্ষে কি সম্ভব ছেলেকে পড়ানো?’

‘ওর বাবা কী করে?’ আদিবার মা প্রশ্ন করেন। উত্তর না দিয়ে রুবি চুপ থাকে। ধমকের সুরে আবার জিজ্ঞেস করেন আদিবার মা। ‘ব্যাটা বদমায়েশ। আমার সর্বনাশ করেছে। খুব চেষ্টা করেছি পালিয়ে আসার জন্য। কিন্তু পারিনি। আমাকে ঘরের মধ্যে তালা দিয়ে স্বামী-স্ত্রী যেত চাকরি করতে। কিছুক্ষণ পরই ওই ব্যাটা আবার অফিস থেকে ফিরে আসত। ব্যাটা দিনের পর দিন আমাকে চুষে খেয়েছে। একদিন সে জানতে পারে আমার পেটে বাচ্চা। তখন ক’টা টাকা দিয়ে আমাকে বলে, ক’দিনের জন্য বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আস। তারপর দেখব কী করা যায়। বাড়ি থেকে এসে দেখি ওরা বাসা ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। ওই ব্যাটাকে আর খুঁজে পাইনি। ছেলেটা হওয়ার সময় মা-বাবা কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু গ্রামাবাসীদের কটূক্তির কারণে শেষপর্যন্ত মা-বাবাও আমাকে ঠাঁই দেয়নি। সেই থেকে পাপের বোঝা আজো বয়ে বেড়াচ্ছি।’ কথাগুলো বলতেই রুবির দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছে। কথাগুলো আদিবার মায়ের বুকে আঘাত করে। লোকটার প্রতি তারও প্রচণ্ড ঘৃণা হয়। ‘ঠিক আছে এখন যাও। পরে এসো।’ শুধু এটুকুই বলে সেদিন রুবিকে বিদায় দেন আদিবার মা।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আদিবার মা তার স্বামী মাসুদকে রুবির বিষয়টি খুলে বলে। হূদয়বিদারক কথাগুলো শোনার পর মাসুদ সাহেবের মনে কেমন যেন একটা আতঙ্কের দানা বাসা বাঁধে। রুবির কথাগুলো তার কানে বার বার প্রতিধ্বনি হতে থাকে। সেদিন রাতে সে মোটেও ঘুমাতে পারে না। তার বিশ্বাস করতে আর কষ্ট হয় না যে, সমাজে অনেক নারীলিপ্সু পুরুষ আছে যারা অসহায় নারীদের ফাঁদে ফেলে ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করে। তার জীবন্ত প্রমাণ তিনি নিজেই। জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা তার স্মৃতির আঙিনায় আজো নৃত্য করে। সকালে মাসুদ সাহেব স্ত্রীকে বলেন, ‘একটা কাজ করলে কেমন হয় বলো তো? রুবির ছেলের পড়ার দায়িত্বটা যদি আমরা নিই? তাকে যদি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই? কেমন হবে বলো তো? ক’ টাকাই বা লাগবে?’ স্বামীর মনোভাবের কথা শুনে স্ত্রীর চোখে-মুখে খুশির রেখা ফুটে ওঠে। তার ইচ্ছার কথাই তো স্বামীর মুখ দিয়ে বের হলো। উত্তরে তিনি বলেন, ‘মন্দ হয় না। অবশ্যই ভালো হয়। অন্তত একটা ভালো কাজ তো করা যাবে।’

পরেরদিন রুবি কাজ করতে এলে আদিবার মা তাকে তাদের ইচ্ছার কথাটা জানিয়ে দেন। সেদিন রুবির খুব কষ্ট হয়েছিল আদিবার মায়ের কথাগুলো বিশ্বাস করতে। কৃতজ্ঞতায় তার মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। শহরে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে। যাদের হয়তো রুবিরা চেনে না। সত্যি সত্যি রুবি তার ছেলে মুক্তিকে বেড়িবাঁধের কাছে একটা বেসরকারি হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। মুক্তিও ভীষণ খুশি হয়। সে আগের চেয়ে আরো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।

আদিবার বাবা এনজিওর একজন বড় কর্মকর্তা। বছরখানিক যেতে না যেতেই তিনি বদলি হয়ে যান রাঙামাটিতে। যেদিন বাসা ছেড়ে আদিবারা চলে যাচ্ছিল, সেদিন রুবি খুব কান্নাকাটি করছিল। তার কান্না দেখে আদিবার মাও নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। যাওয়ার আগে তিনি রুবির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, ‘এই টাকাগুলো রাখ। এই টাকা দিয়ে তোমার ছেলের ক্লাস সেভেনের পড়াও হয়ে যাবে। আর যদি শিগগির ঢাকায় ফিরে আসি তবে তোমাকে খুঁজে নেব। এই মোবাইল নম্বরটা রেখে দাও। সম্ভব হলে কথা বোলো।’

রাঙামাটিতে যাওয়ার পর মোবাইলের দোকান থেকে রুবি বেশ কয়েকবার আদিবার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। বছরখানিক পর রুবি হঠাৎ ওদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এভাবে দেখতে দেখতে আরো দুই বছর কেটে যায়। মাসুদ সাহেবেরও আর ঢাকায় আসা হয়নি বললেই চলে। দাফতরিক কাজে একবার ঢাকায় মাসুদ সাহেব কয়েকদিনের জন্য এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি রুবির খোঁজেই রুবির ছেলে মুক্তি যে স্কুলে পড়ত, সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুক্তি নামে একটা ছেলে আমাদের স্কুলে পড়ত ঠিকই। এখন আর পড়ে না। আমরা জেনেছি ওর মা ছিল গৃহকর্মী। কোনো এক ভদ্রলোক নাকি মুক্তির পড়ালেখার খরচ জোগাতেন। ওর মা হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকে ছেলেটা আর স্কুলে আসেনি।’

প্রধান শিক্ষকের কথায় মাসুদ সাহেব প্রচণ্ড ধাক্কা খান। তিনি ঘামতে শুরু করেন। প্রধান শিক্ষক বলতে থাকেন, ‘সে কোথায় গেছে তাও কেউ বলতে পারে না। ছেলেটা পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল। মুক্তি স্কুলে না আসায় আমাদের এক টিচার খোঁজখবর নিতে ওর বাসায় গিয়েছিল। সেখান থেকেই আমরা এসব তথ্য পেয়েছি।’ কথাগুলো শোনার পর মাসুদ সাহেবের বুকের মধ্যে একটা ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। সেই ঝড়ের আঘাতে তার মাথাটাও ঘুরতে থাকে। তার কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নেন তিনি। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুখটা ভার করে টার্মিনালের উদ্দেশে হাঁটতে থাকেন।

রুবি তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতের অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় নিয়েছে; কিন্তু তার এই ক্ষতের জন্য যারা দায়ী সমাজে তাদের অবস্থান কোথায়? তাদের কি শাস্তি পাওয়া উচিত নয়? এরকম হাজারো প্রশ্ন মাসুদ সাহেবের মনে উদয় হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে সাধুবেশে ঘুরে বেড়ালেও বিবেকের আদালতে তাদের যে শাস্তি হয় না তা কিন্তু নয়। তেমনই একটা ক্ষতের যন্ত্রণা দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন মাসুদ সাহেব। রুবির ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি একটু প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগটাও আজ আর নেই। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি আবার নতুন কোনো উপায় খুঁজতে থাকেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads