• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
শীতার্তের আর্তি এবং শীত বিলাসিতা

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

শীতার্তের আর্তি এবং শীত বিলাসিতা

  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

মস্কো বিমানবন্দরে সদ্যই অবতরণ করলেন একজন বাংলাদেশি। তিনি একটি বেসরকারি গ্রুপ অব কোম্পানির কর্ণধার। পরনে কেতাদুরস্ত স্যুট। যা বড়জোর বঙ্গদেশে পৌষ শীত নিবারণযোগ্য। মস্কোতে সেদিন মাইনাস ৭ ডিগ্রি ঠান্ডা। বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা! বিমানবন্দরে ঢুকেই অভ্যর্থনাকারীকে জানালেন, ‘ও মাই গড ইটস প্রবলেম। ঠু কুল।’ কিন্তু অভ্যর্থনাকারী এমন অভিযোগ মানবেন কেন। তাছাড়া সমস্যা বলা মানেই তার দেশের বদনাম। তিনি যুৎসই উত্তরটি দেবার সুযোগ ছাড়লেন না। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘কুল ইস নট প্রবলেম। প্রবলেম ইন ইউর ড্রেস।’ এটুকু বলে সমস্যা সমাধানের জন্য আগন্তুককে বিমানবন্দরের একটা কাপড়ের দোকানে নিলেন। দোকানে থরে থরে শীতবস্ত্র সাজানো। বস্ত্রের ট্যাগে তাপমাত্রা উল্লেখ করা। তাপমাত্রা ভেদে ব্যবহারযোগ্য পোশাক। যেমন ০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৫ ডিগ্রি। মাইনাস ৫ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ১০ তাপমাত্রা। এভাবে শীত যদি মাইনাস ৪০ ডিগ্রি আসে তবু সমস্যা নেই। সেই অনুযায়ী পোশাকও আছে। শীতপ্রধান দেশে গিয়ে একজন ধনাঢ্য বাংলাদেশিও শীতার্ত আকুতি ঝেড়েছেন। দিব্যি দিয়ে বলছি, ‘এই ঘটনা সত্য।’ সত্য প্রকাশে আমার পরিচিত ধনাঢ্য ব্যক্তিটি বিব্রত হতে পারেন ভেবে পরিচয় গোপন করছি। আসলে শীতের কাছে সবাই কাবু। তবে যদি আপনার প্রয়োজনীয় বস্ত্র থাকে তাহলে কোনো সমস্যাই না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু শীতবস্ত্র বিতরণের হিড়িক নেই।

কয়েক বছর আগেও দেখেছি গ্রামে গ্রামে শীতবস্ত্র বিতরণ নিত্যদিনের ঘটনা। শীত এলেই এলাকার রাজনৈতিক নেতা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বা জনহিতৈষী ব্যক্তিরা শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। অথবা কার-ট্রাক বোঝাই শীতবস্ত্র গ্রামে পাঠানো হচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে শীতকালে অন্তত ৪-৫টি দাওয়াত পেতাম শীতবস্ত্র বিতরণ সংবাদ প্রকাশের জন্য। গত দুই-তিন বছর যাবৎ এই কাজটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তার মানে অধিকাংশ মানুষ নিজেরাই কমবেশি শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে। যে কারণে শীতার্তের আর্তিও কমেছে। তবে শীতের তীব্রতা কিন্তু বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে। সাথে শীত নিবারণে বাংলাদেশি মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে। আরো একটি পরিসংখ্যানে তা বোঝা যায়— ‘তীব্র শীতে রংপুর ও কুড়িগ্রামে ২ জনের মৃত্যু।’ শীতকালে সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই এমন শিরোনাম দেখা যেত। নিয়মিতই সংবাদপত্রে এসব সংবাদ স্থান পেয়েছে। এই ২০১৯ সালের শীতে এমন সংবাদ একটিও আমার চোখে পড়েনি। তাই-ই বলছি বাংলাদেশে শীতার্তের আর্তি কমেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

তাই বলে শীতে কাবু বাঙালির বদনাম কিন্তু ঘোচেনি। শীত-গোসলের প্রসঙ্গ উঠলেই বাঙালি মাত্রই জবুথবু। শহরের বাথটাবে গরম জল ছাড়া সুঠাম কুস্তিগীরও কিন্তু নামবে না। আমার ঠিক মনে আছে ছোট বেলা মাঘ মাসের শীতেও নদীতে ঝাঁপিয়েছি। স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা একসাথে নদীতে নামতাম। বাড়িতে বসে গরম জলের প্রশ্নই উঠে না। এখন গ্রাম কি শহর— আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই কুসুম কুসুম গরম জলে স্নান করে। গরম জলে স্নান করতে খবরের পাতা গরম হওয়ারও নজির আছে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু তো গরম জলের ছ্যাঁকা খেয়ে পনেরো দিন শয্যাশায়ী থাকলেন। শীতকালে বাঙালি যুবকের বিয়ের প্রবণতা বাড়ে। তবে শীতে এমন সুখময় কাবু হতে কেউই অমত হয়েছে বলে শুনিনি। শীতকালে বিয়ের ধুম পড়ে।

প্রিয় পাঠক, শীতার্তের আর্তি মানে শুধু শীত নিবারণ হবে কেন! শীতের পিঠা-পায়েস উপভোগের আর্তি কি কমেছে? মনে হয় না। আর্থিক উন্নতির সাথে সাথে পিঠা খাবার বিলাসিতাও বেড়েছে। শীত মানেই বাঙালি বধূর পিঠার রসনা বিলাস আয়োজন। গ্রামের ঘরে ঘরে টাটকা খেঁজুর রসের ভিজা পিঠা, পাটি সাপটা, দুধ কুলি, ভাপা পিঠা হবে না, তা কি হয়! এখন তো শহরের গলির মোড়ে মোড়ে ভাপা পিঠার ভাপ ওঠে। শহরের অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো বাহারি শীতের পিঠার সম্ভার সাজায়। বাড়তি পাওনা সুপার শপের শোকেসে হাফ ডান পিঠা। বাসায় নিয়ে সামান্য আঁচ দিলেই হলো। সামাজিক সংগঠন, স্কুল কলেজে আয়োজন হচ্ছে পিঠা উৎসব। আমি প্রতি বছরই এমন কয়েকটি দাওয়াত পাই। টঙ্গীর চেরাগআলীতে টঙ্গী কমার্স কলেজ প্রতি বছরই তেমন পিঠা উৎসবের আয়োজন করে। তাছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় টঙ্গী পাইলট স্কুলের মূল ফটকের পাশে এক গৃহিণীকে দেখা যায় নানান স্বাদের শীতপিঠা বিক্রিতে ব্যস্ত। আর্থসামাজিক উন্নতির সাথে সাথে মানুষের ভোগ বিলাসিতাও বেড়েছে।

শেষ করব শীতের সবজি দিয়ে। বাজারগুলো টাটকা শাক-সবজিতে লক লক করে। একটু বাড়িয়েই লিখলাম। লক লক সবজির স্থানে লকলকে বাজার আর কি! বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, বরবটি, আলু, বেগুন, মূলা, লাউশাক, লালশাক আরো কত সতেজ সবজি বাজারে। দাদার আমলের সবজির সাথে আধুনিক ব্রুকলি, ক্যাপসিকাম বা লেটুসও প্রচুর পাওয়া যায়। দাম নিয়ে বেরসিকরা উচ্চবাচ্য করে। কৃষকের ফলানো ফসলের দাম নিয়ে অন্যদের সাথে আমি দ্বিমত। কৃষককে সর্বোচ্চ মূল্য দেওয়া উচিত। কারণ তারা একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদনে আমাদের উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে; অন্যদিকে সবুজ চাষ করে অক্সিজেনের জোগান দেয়। তাহলে কৃষক তো দুইভাবে মূল্য পাওয়ার যোগ্য। শহুরে মানুষরা চার দেয়ালে অট্টালিকার ভেতর বসে কড়কড়ে নোট গোনে। তিনি কি ভেবেছেন সব থেকে প্রয়োজনীয় শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন কোথা থেকে উৎপাদন হলো। তা কিন্তু কৃষকের ফসলি ক্ষেত থেকে। তাই আমি মনে করি কৃষকের সর্্বোচ্চ মূল্যই প্রাপ্য। অগ্রগামী বাংলাদেশে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই শীত বিলাসিতা উপভোগ করবে- এটাই প্রত্যাশা।

 

শতাব্দী আলম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads