• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

জীবন নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই

  • হাসান আজিজুল হক
  • প্রকাশিত ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলা ভাষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯। সে হিশেবে আজ তিনি আশিতে পা রাখলেন। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। বাংলা সাহিত্যের এই অদ্বিতীয় কথাসাহিত্যিক লিখে চলেছেন ছয় দশক ধরে। লেখালেখির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তার জীবন-ভাবনা, জীবনাভিজ্ঞতা, লেখালেখিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের খবর-এর পক্ষে হাসান সাইদুল

হাসান সাইদুল : আপনার শৈশব সম্পর্কে কিছু বলুন?

হাসান আজিজুল হক : আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। এই বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে দেখি। আমার লেখায় নানাভাবে বিষয়টি এসেছে। এটাকে নস্টালজিয়া না বলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিয়েছি। ভারতবর্ষের রাজনীতি একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করেছি। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানরা কীভাবে অংশগ্রহণ করল, স্বাধীনতা লাভের আগেই বহু লোক কেন ছুটে গেল দেশটাকে বিভক্ত করার জন্য। যারা মুক্ত হতে চাইল আবার তারাই নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ তুলে বিভক্ত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হলো কেন।

 

হা. সা. : আপনি প্রায় সারা জীবন রাজধানী থেকে দূরে থেকে গেলেন। কিন্তু খ্যাতি, সুনাম এবং সৃজনশীল প্রজ্ঞার অলৌকিক ঐশ্বর্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেলেন...

হা. আ. হ. : বিশ্বময় ছড়িয়েছি না মদনভস্ম হয়েছি, তা আমার পক্ষে বলা কঠিন। একা একা যখন ভাবি, তখন মূলত নিজের নানা রকমের সীমাবদ্ধতার কথাই মনে হয়। এটাও ঠিক বিনয়ের কথা নয়। আমি নিজেই বুঝতে পারি যে আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার সেই অর্থে উল্লেখযোগ্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা কিছুমাত্র নেই। আমি এখনো জানি না, আমি কতটা পাঠকপ্রিয়। পাঠকেরা যখন আমাকে কোনো কিছু জানায় এটা পড়েছে এবং ভালো লেগেছে, তখন আমার নিজের কাছে খুব ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই যে খুব আত্মগরিমায় ভুগতে থাকি, তা কিন্তু নয়। এটা এক ধরনের ভালো লাগা। মানুষের বহু কাজ করে ভালো লাগে, তৃপ্তি লাগে খুব ভালো একটা খাওয়া হলে তৃপ্তি লাগে। খুব ভালো একজন প্রেমিকা জুটলে ভালো লাগে ঠিক তেমনি আর কি। অনেকে কিন্তু এ কথাও বলেছে, হাসান আজিজুল হক ঠিক যতটা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশংসা পান। আমার মনে হয়, এ কথা যদি কেউ বলে থাকেন, তিনি যে অশুভ সত্য বলেছেন তা মনে হয় না। হয়তো সত্যিই বলেছেন। যে ভালোবাসা বা প্রীতি আমার কপালে জুটেছে। সেটার কারণ আমিও জানি না।

 

হা. সা. : সাহিত্য সম্পর্কে আপনার সাম্প্রতিক ভাবনা জানতে চাই।

হা. আ. হ. : আমার সাম্প্রতিক ভাবনা চিরকালের ভাবনাই। সাহিত্য থেকেই সব হয়। তুমি যদি মনে করো সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়বে, তাহলেও তোমাকে মার্কসের সাহিত্য পড়া উচিত। পড়া ছাড়া মানুষ নিজের চিন্তাটাকে প্রকাশ করবে কোথায়? এই সমস্ত কথার পেছনে কী ক্ষোভ আছে তা আগে জানতে হবে। ক্ষোভটা কেন সাহিত্য দিয়ে কী করব? সত্যিই তো। কেন বলছি, সাহিত্য দিয়ে আসলে কেউ কিছু করে না। সাহিত্য দিয়ে আজকে বাংলাদেশে কিছু হয় না। কেউ তেয়াক্কাই করে না। তুমি যে কাগজে কাজ করো, সেখানেও দেখবে আট পাতার সাহিত্য আর ৫০ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন। আমি যে বলেছি, সাহিত্য দিয়ে আপনারা কী করবেন? আমি কি অন্যায্য প্রশ্ন করেছি? তার মানে কি এই সাহিত্য দিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না? তা তো নয়।

 

হা. সা. : একজন কথাশিল্পীকে নিজস্ব একটি গদ্যশৈলী নির্মাণ করতে হয় আবার তার নির্মিত শৈলী ভেঙে নতুন শৈলী তৈরি করতে হয়। আপনার ভাঙাগড়ার বিষয় জানতে চাই?

হা. আ. হ. : বলা মুশকিল। বড় উদাহরণ হলো, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি। গল্প অনেকটা অংশ লেখার পরে দেখি, আরে, এ তো সমরেশ বসুর গল্প হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিলাম। অনেক দিন পরে কোনো এক শরৎকালে একদিন গল্পটা লিখতে বসি। আমাদের গ্রামের বাড়ির ছাদের সিঁড়িঘরের পাশে একটা আমগাছ আছে, আম ধরে আছে আমার নাকের সামনে; ছোট্ট গোল একটা বেতের চেয়ার ছিল আমার, আর একটা টেবিল ছিল; টেবিলের ওপরে মাথা রেখে আমি হঠাৎ লিখলাম, এখন নির্দয় শীতকাল। এটার পরেই ঘামটা মুছে নিলাম। তারপরে কী করে লিখেছি জানি না, ‘অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।’ স্রোত শুরু হয়ে গেল। বাক্যগুলো একেবারে যেন মিছিল করে আসছে। একটার পর একটা।

 

হা. সা. : সাম্প্রতিক বাংলা ছোটগল্পের ধারা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

হা. আ. হ. : আমাদের বড় দুর্বলতা হচ্ছে, সমগ্র পৃথিবীতে কী হচ্ছে তার খবর আর নিচ্ছি না। মানিক, বিভূতি, রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান পড়েছেন। পড়াশোনা করতে হবে না? বাংলা গল্প সম্পর্কে অচেতনতা মারাত্মক। গল্প পড়ে মনে হয় যে, ভালো করে মানিক পড়া থাকলে এই গল্পটা সে লিখত না, কিছুতেই লিখত না। তারাশঙ্কর পড়া থাকলে লিখতে পারত না। বললে পরে যুবক লেখকদের মনে লাগবে, এখন কেন এই গল্প লেখা হবে? এতদিন পরে কেন এই গল্প লেখা হবে? আমিও তো লিখে গেলাম। আমার পেছন থেকেও হাঁটতে পারে না কেউ, সামনে থেকে হাঁটা ধরছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গেও একই অবস্থা। অপরিচয়ের ফলে দম্ভ এবং আত্মতৃপ্তি বেড়ে যায়। না জানলেই তখন নিজেকে বড় মনে হয়। প্রতিনিয়ত শেষ অবস্থান জানা থাকতে হবে। আমি সেই জন্যে সবসময় চেষ্টা করি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতে।

 

হা. সা. : আপনার দীর্ঘ ছয় দশকের লেখালেখির জীবনে উপন্যাস লিখেছেন কেবল দুটি— ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। গল্প নিয়েই কাটিয়ে দিলেন অনেকটা সময়। কেন?

হা. আ. হ. : উপন্যাস আমি লিখতে চেয়েছি শুরু থেকেই। কিন্তু পারিনি বলেই গল্প লিখেছি। তবে একেবারেই যে চেষ্টা করিনি, তা নয়। ‘তরলা বালা এক বঙ্গ রমণীর কথা’ নামে একটি লেখা শুরু করেছিলাম। লিখেও ছিলাম অনেকটা। তার পরে আর আগ্রহ বোধ করিনি। তাই লিখে শেষ করা হয়নি।

 

হা. সা. : ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ আপনার বহুল পঠিত ও আলোচিত গল্প। এ গল্পের ঘটনা, ভাষা ও পরিবেশ একটি ফুলগাছের। কিন্তু আবহ ও ইঙ্গিত দেশভাগ তথা ’৪৭-এর দাঙ্গা...

হা. আ. হ. : তুমি ঠিকই ধরেছ। গল্পটি লিখেছিলাম ’৬৬-এর দিকে। ’৪৭-এর ভারত ভাগ এবং বাংলা ভাগ হওয়ার বিষয়টি এ গল্প পড়লে বোঝা যায়। তখন কোন সম্প্রদায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, আমি সেদিকে যাব না। আমি কেবল চেষ্টা করেছি মানুষের উন্মূল হওয়ার বেদনাটি ধরতে।

 

হা. সা. : জীবনের এই অবস্থায় এসে মৃত্যু নিয়ে কী ভাবনা আপনার?

হা. আ. হ. : জীবন নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। সময়ের কারণে দেহে হয়তো বার্ধক্য এসে যায়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। দৈহিক বার্ধক্য এলেও আমি মনে করি যে, বৃদ্ধ হয়ে যাইনি। আমাদের দেহ নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এতটা বছর পেরিয়ে এসেছে, কষ্ট সয়েছে, তাই তার একটি সময় বিশ্রামের প্রয়োজন হবেই। তখনই দেখা দেয় বার্ধক্য। তাই বার্ধক্য দোষের কিছু নয়। আর মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। মৃত্যু নিয়ে আমাকে আলাদা করে ভাবতেও হয় না।

 

হা. সা. : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

হা. আ. হ. : ভালো থেকো। তোমাকেও ধন্যবাদ।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads