• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি

  • প্রকাশিত ০২ মার্চ ২০১৯

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী একুশের গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশ স্বাধীনের পরপরই ১৯৭২ সালে। তখন এর রূপ বর্তমান অবস্থায় ছিল না, না থাকাটাই স্বাভাবিক। কালপরিক্রমায় বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে যেমন দেশে দেশে বইমেলার আয়োজন ও আন্তর্জাতিকতায় লেখক-প্রকাশক-পাঠকের সম্মিলন ঘটেছে, তেমনি বছর বছর প্রকাশিত হচ্ছে নতুন লেখকের প্রথম গ্রন্থ। ২০১৯ সালে একুশের মেলায় প্রকাশিত তেমন কয়েকটি প্রকাশিত প্রথম বই প্রসঙ্গে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন নবীন কবি-লেখক। তাদের সেই স্বগতোক্তি অনুলিখন হিসেবে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের খবর-এর পক্ষে কবি অনু ইসলাম

বারুদ মিশ্রিত মৃত্তিকা
বিষাদ আবদুল্লাহ

প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি! কীভাবে প্রকাশ করব! ভাবছিলাম দু’দিন ধরে। কিন্তু মন উদ্গত করোটির ভাঁজ থেকে বের হওয়া শব্দগুলোর সমন্বয়রূপে প্রথম কাব্যসন্তানের অনুভূতিগুচ্ছগুলো আমি ধরতে পারিনি। কিন্তু বুকের পুরোভাগ জুড়ে সমুদ্রের বসন্তকালীন ঢেউয়ের মতন কি যেন আছড়ে পড়ছে, বুঝতে পারছি অথচ শব্দের খেলায় তাকে ধরা যাচ্ছে না। অনুপ্রাণন প্রকাশনের ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে ১১ জানুয়ারি ২০১৯-এ যখন আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি বইয়ের মলাটে আবদ্ধ হয়ে অনুপ্রাণনের অফিসে আসার সুবার্তা জানতে পারি তখন আমি আমার জন্মবাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের লাউলাইশ গ্রামে। সেদিন থেকে চোখে হারিয়েছে তার স্বাভাবিক কার্যকলাপ, মন হারিয়েছে তার বাড়ি ফেরার পথ, বালিশে মাথা রেখে এপাশ-ওপাশ করছি আবার হুট করে উঠে পড়ছি এসব কি উচ্ছ্বাস! আনন্দ! উন্মাদনা! কি জানি! জানি না কিন্তু আমার এমন করতে ইচ্ছে করছে।

এ মুখ পিতার এ মুখোশ পুত্রের
অয়ন সাঈদ

কবিতায় মজে থাকব, আজ এ সময়ে এসে যার জন্যে গ্রন্থ প্রকাশের দুঃসাহস দেখাতে পারি সে কথা আমার বিশ বছর হওয়া অবধি টেরই পাইনি। আমি যে আছি, তা বুঝতে বুঝতেই প্রথম কুড়ি কেটে গেছে। অক্ষরজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেয়াল আলমারিজুড়ে আব্বার-গন্ধসমেত পড়ে থাকতে দেখেছি কয়েক হাজার বই। তখনো বুঝতে শিখিনি এই বইগুলোর প্রতিটি শব্দ তার মগজ দিয়ে হেঁটে গেছে। আমার সে কথা বুঝতে বুঝতে আব্বার প্রিয়জনেরা বইগুলো পুকুরে রেখে আসে! আমি তখনো ডাঙায়, শুধু এতটুকুই জানতাম আমার বাবা একজন কবি, আমার জন্মের ছয় মাস পরে তার বয়স আর বাড়েনি। তারপর আব্বার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘এসো নাগ শিশু’ খুঁজতে খুঁজতে কোথাও না পেয়ে নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করলাম। (এর অনেক পরে বইটি অবশ্য পাই কবি তাহের ম. শায়েখ চাচ্চুর কাছ থেকে) কাব্যলক্ষ্মী দেবীর রাজ্যে ততদিনে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছি, এখন এতটুকুই অনুভবে অবশিষ্ট আছে। যদিও ২০১১ সাল থেকে কবিতা লিখছি, খুব বেশিদিন নয় তবু নিজের মতো করে বলতে চেষ্টা করার অধ্যবসায় আর চর্চার ভেতর একটি কবিতা কবিতা হয়ে উঠেছে মনে হলে ভালো লাগার রেশ বেশিক্ষণ থাকে না, আরেকটি কবিতা রচনায় ব্যস্ত করে তোলে। ‘এ মুখ পিতার এ মুখোশ পুত্রের’— এ গ্রন্থের রেশ মনে হচ্ছে বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে।

অশুদ্ধ ব্যারোমিটার
শুভ আহমেদ

মানুষ স্বভাবতই স্বপ্ন দেখে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী স্বপ্ন দেখে কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু মানুষ কখন স্বপ্ন দেখে? যখন একটি ইচ্ছে চিন্তায়, চেতনায় ঘুরপাক খেতে থাকে ঠিক তখনই মানুষ স্বপ্ন দেখে। ইচ্ছের কথা বলছি এখন, লেখালেখির অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। ইচ্ছে ছিল গল্প লিখব, গল্পকার হবো। হঠাৎ কখন থেকে যে কবিতা লেখা শুরু করেছি, কবিতার প্রেমে পড়েছি। এটা এখন খুব বেশি একটা মনে পড়ছে না নির্দিষ্টভাবে। কবিতার প্রেমে পড়েছি বলেই হয়তো এখন এমন... যাই হোক, শুধু একথা বলতে পারি, আমার জীবনের প্রথম লেখা প্রকাশ কবিতা দিয়েই শুরু। এভাবেই গল্প লেখার ইচ্ছেটা কবিতা লেখায় রূপ পায়। অবশেষে, আমার স্বপ্নটাকে বাস্তবরূপ দিতে পেরেছি। জন্ম হয়েছে ‘অশুদ্ধ ব্যারোমিটার’ কবিতাগ্রন্থ। আমার প্রথম বই, আমার প্রথম প্রেম, আমার প্রথম প্রতিবাদ, আমার প্রথম আলো। আমার কাছে এর নামই অনুভূতি। কেননা একজন মা-ই জানেন প্রসবযন্ত্রণার পর একটি সন্তান তার বুকে কতটা শান্তিদায়ক, কতটা মধুর।

দেনমোহরের দেনা
আজাদ বঙ্গবাসী

রঙ দিয়ে চিত্র আঁকা যায়। শব্দের গাঁথুনি দিয়ে সাজানো যায় পিক্তমালা। স্রষ্টার রূপ কিংবা আত্মার আকৃতি কি কখনো বাহ্য চোখে আনা যায়? স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একপিক্ত কবিতা সশস্ত্র বাহিনীর চেয়ে শক্তিমান। চর্যাপদের ডুম্বি থেকে ভার্চুয়াল যুগের নর-নারী, ঐতিহ্য, জন্মযুগ থেকে সৌন্দর্যযুগ অব্দি, মানুষের প্রেমের পিপাসা মৃত্যুর মালিকের দিকে প্রস্থানিত। এমনসব বিচিত্র বিষয় নিয়ে ‘দেনমোহরের দেনা’ কবিতার বইটি সজ্জিত। প্রথম কবিতার বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন? এটা আসলে বলে বোঝানোর মতো বিষয় নয়। প্রকৃতি যেমন নানা অনুষঙ্গে নানা রঙ ধারণ করে। মনের অবস্থাও ঠিক যেন তাই। লিখছি প্রায় কুড়ি বছর গত হয়। তবু মনে হয়েছে এখনো বুঝি লেখায় তেমনটা পরিপূর্ণতা পাইনি। বই প্রকাশে আরেকটু বোধহয় অপেক্ষা করা সমীচীন ছিল। কবিতা ধারণ করে সময়ের চিত্র। অতীত ও ভবিষতের মেলবন্ধন স্থাপন করে এই প্রাচীন শিল্প। প্রিয় পাঠক, কিছু সময়ের জন্য হলেও ‘দেনমোহরের দেনা’ মনসজ্জার সেই নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

পদ্মপ্রয়াণ
আশিক বিন রহিম

রোজকার সূর্য ভেঙে এই যে হেঁটে চলছি অবিরাম, এই যে রোদ কিনছি, ফুল-পাখি, অরণ্যের সঙ্গে বলছি কথা। এই যে জোছনা-ধোয়া কিংবা অমাবস্যার আঁধার মাখছি গায়ে। সমাজ-সংসারের পথে পথে ছিঁড়ে ফেলছি একটা একটা করে আয়ুর পালক— এর নাম জীবন। এই যাপনে-উদ্যাপনে প্রতিনিয়ত শব্দ কুড়াই আমি। নিজেকে ভাবি- শব্দের চাষি এক। মূলত ২০০৩ সাল থেকেই কবিতার সঙ্গে যাপন আমার। সেই থেকে কবিতা আমার কাছে মা-মাতৃভূমির মতো পবিত্র, বোনের মতো না ছিঁড়তে পারা সম্পর্ক, প্রেয়সীর মতো নেশাময় আর সন্তানের মতো হূদয় দিয়ে অনুভব করা অদৃশ্য মায়া-টান। কবিতা আমার কাছে সর্বোচ্চ আরাধনার উপলক্ষ। তার সঙ্গে দীর্ঘ যাপনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু সৃষ্টিকে মলাটবন্দি করে একটি কাব্যসন্তান জন্ম দেওয়ার প্রয়াস— খুব বেশি দোষের নয় বোধ করি। ‘পদ্মপ্রয়াণ’-এর একটি কবিতাও যদি পাঠকের হূদয়কে স্পর্শ করে, তবেই আমার এই প্রয়াস সার্থক হবে।

লুইজালে
মাহমুদ নোমান

আমি বলতে চাই না নিজের লেখা বই মানে প্রসব করা সন্তানের মতোই। তবে যেদিন পরিবার পাবলিকেশন্সের সোহানুর রহিম শাওন ভাই বইটির পাণ্ডুলিপি নিয়েছেন, সেদিন থেকে আমার নিঃস্ব হওয়ার নিগূঢ়তম সত্য উপলব্ধি হয়ে গেছে। বই প্রকাশের আগপর্যন্ত কোনো নতুন লেখায় আর মন বসলো না। ওই যে প্রেমে পড়লে মানুষ কবিতা লেখে, কিন্তু প্রেমটারে পেয়ে গেলে আর কী কবিতা হয়! তাই ‘লুইজালে’ বলতে পারেন আমার প্রেমিকা বা মায়ের অবাধ্য সন্তানের পড়ার টেবিলে বসা সে আমি, চুরি করে প্রেমের প্রথম চিঠি লিখলাম। অনেকে এসব পড়বে ছাপাখানায় শব্দে আটকিয়ে যন্ত্রের কলহের শেষে, ভাবতেই শিহরিত হয়েছি... বই কখন হাতে পাবো বা কারো কাছে মূল্যায়ন হবে কি-না, এটারও যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় ভুগেছিও। কেননা আমার সাহিত্যজগতে কারো পরামর্শ বা ছায়ার তলে আসন লাভ এখনো হয়নি। এবং লিখেছিও নিজের মতো করে, একেবারে মায়ের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলি, সেই চট্টগ্রামের ভাষার কিছু উৎকর্ষ শব্দে ‘লুইজালে’ এর শামিয়ানা... যেখানে নিকটাত্মীয় থেকে সবাই ছিল বিরূপ। ওই অগ্নিমুহূর্তে দাঁড়িয়ে অসম্ভব আর্থিক ও মনোকষ্টে এক যুগের কাছাকাছি টানা লিখে যাওয়াটাও ছিল আমার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের পা ঠিক রাখার যুদ্ধ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads