• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
তাবিজতুম্বা

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

তাবিজতুম্বা

  • প্রকাশিত ০৯ মার্চ ২০১৯

সুরাইয়া বিস্ময় চোখে ফাতেমাকে দেখে। ফাতেমা হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘর মোছে। আর গুনগুন করে গান গায়। ফাতেমা দৌড়ে দৌড়ে এঘর থেকে ওঘরে যায়। বিষয়টি কদিন ধরেই লক্ষ করছে সুরাইয়া। অথচ গত চার বছরের মধ্যে ফাতেমাকে বলে-কয়েও হাসিখুশি রাখতে পারত না সে। সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে রাখত বলে সুরাইয়ার রাগ হতো খুব। বাসায় মানুষ তো সবে দুজন। সুরাইয়া নিজে রোগে শোকে কাহিল হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। শরীর ভালো লাগলে ঘরেই একটু হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু ফাতেমার মুখের ভাবখানা দেখলে আর হাঁটতে ইচ্ছে করত না ওর। কতদিন বলেছে, কী রে ফাতেমা, আমার না হয় শরীরে হাজারও রোগ, তোর সমস্যা কী? তোর মুখে তো হাসি দেখি না। মুখকে কী বানিয়ে রাখিস?
ফাতেমা মুখ শুকনো করে, ছলছল চোখে বলত, সুখ নাই গো খালাম্মা, মনে সুখ নাই। হাসতাম কেমনে? এরপরই শুরু করত তার মৃত স্বামীর গল্প। জীবনে সুখ দিছে না আমারে। জ্বালাইয়া ছারখার করছে। আল্লাহ তুমি হের বিচার কইরো।
তখন সুরাইয়া ধমক দিত। এই, তোকে না বারণ করেছি মৃত মানুষ সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে নেই? স্বামীর জন্য দোয়া করিস। ফাতেমার চোখ দুটো জ্বলে উঠত তখন। না, আমি পারমু না। ওই জল্লাদের জন্য আমি ভালো দোয়া করতে পারব না খালাম্মা। তারপর রান্নাঘরের দরজার পাশে পা দুটো ছড়িয়ে বসে সময় নিয়ে কাঁদত ফাতেমা।
কী এমন হলো ফাতেমার? প্রেম ট্রেম করছে নাকি কারো সঙ্গে? সুুরাইয়ার বুক কাঁপতে থাকে। ফাতেমা ঘরসংসার করতে চাইলে সে বাধা দেবে কী করে? সুরাইয়ার একমাত্র ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করে। ছুটিছাটায় বাসায় আসে। আরো এক বছর বাকি ছেলের পড়া শেষ হতে। ততদিন ফাতেমাকে ছাড়া সুরাইয়ার চলবে কী করে! তবে যে করেই হোক ফাতেমার এত আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের কারণ জানতেই হবে তাকে।
ফাতেমা ঘর মোছা শেষ করে তেল গরম করে আনে। ফাতেমা খাটে বসে সুরাইয়ার পা টেনে নেয়। সুরাইয়া ফাতেমার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, কিসের এত আনন্দ শুনি? ফাতেমা এবার গলা ছেড়ে হাসতে থাকে। তারপর সুরাইয়াকে অবাক করে দিয়ে বলে, খালাম্মা হে অহন এইহানেই থাকে। কথা শেষ করে আবার হাসতে থাকে ফাতেমা।
কে এখানে থাকে? কার কথা বলছিস তুই?
আমার জামাইর কথা।
সুরাইয়া আচমকা পা দুটো গুটিয়ে নেয়। তারপর স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুতগতিতে উঠে বসে বলে, তোর জামাই না মরে গেছে?
খালাম্মাগো, ছাড়া আর মরা তো একই কথা। সেই জন্যই বলছিলাম মইরা গেছে। ফাতেমার চোখে জল দেখে সুরাইয়া খানিকটা বোকা বনে যায়।
এই, কী বলছিস তুই? তোর জামাই বেঁচে আছে?
হ, মরে নাই। বিয়া করছিল আরেকটা। আমারে তালাক দিয়া বাপের বাড়ি বিদায় করছিল। ঘিন্না, ঘিন্না থেকে বলছি মরে গেছে।
সুরাইয়ার শরীর কাঁপতে থাকে। সে আবার শুয়ে পড়ে। ফাতেমা পায়ে তেল ঘষে ঘষে মালিশ করতে থাকে। খালাম্মা, সে টাউনে আইস্যা ঠেলায় করে সবজি বেচে। আমি তো তারে দেইখ্যা আসমান থাইক্যা পড়ছি। ফাতেমা বলতেই থাকে, শান্তি হয় নাই তার। নতুন বউ তো আমার মতোন না। জামাইর মায়া নাই তার। তাই রুজি করার জন্য শহরে পাঠাইছে তারে। হে অহন আবার আমারে ঘরে তুলতে চায়।
কই থাকে সে?
মেস কইরা থাকে। আমরার গ্রামের আরো অনেক ব্যাটা থাকে ওই মেসে। তারার উপরে ভরসা কইরাই হে আইছে।
সুরাইয়ার মাথা গরম হয়ে ওঠে। সে তো সারাদিন নিজের রুমেই থাকে। ওদিকে কী হচ্ছে কে জানে!
সুরাইয়া চিন্তিত স্বরে বলে, বুঝলাম। তোর জামাই আমাদের বাসায় আসে?
আসে তো! এহন তো তার কাছ থাইক্যাই আনাজপাতি কিনে আমি। কেনা দামে দিয়ে যায় আমরারে। সুরাইয়ার মুখে কথার ফুলঝুরি ফোটে। খালাম্মা, হে প্রত্যেক দিন দুইবার আমারে দেইখ্যা যায়। আমারে না দেইখ্যা থাকতে পারে না অহন। আমিও তারে কাছে ঘেঁষতে দিই না খালাম্মা। পুরুষ মাইনষেরে দিয়া কোনো বিশ্বাস নাই আমার। আগে ধর্মমতো বিয়া করবি, তারপর বউ। জীবনে কম শিক্ষা পাইছি আমি? তয় অহন আমার জন্য অনেক টান হইছে তার। খালাম্মা ডরাইয়া আপনারে কিছু কই নাই আমি। আপনি আবার কী মনে করেন!
সুরাইয়া কী বলবে ভেবে পায় না। ছাড়া আর মরা সমান কথা! তবে তার নিজের ভাগ্যে কী ঘটেছে? তার স্বামী সেই যে বিলেত পাড়ি দিয়েছিল, আর তো ফেরেনি। কত বছর হয়ে গেল! ছেলেটির খোঁজও নেয়নি কোনোদিন। শুনেছে সে নাকি বিয়ে করেছে ওখানে। ফাতেমার অট্টহাসিতে সুরাইয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ে। খালাম্মা, এইবার আপনারে আসল কথা বলি। গলির মুখে সাচ্চু পীর আছে না? উনার কাছ থাইক্যা তাবিজ নিছিলাম জামাইরে ফেরত পাওয়ার জন্য। আল্লাহর কী কুদরত, তিন মাসের মধ্যে সে আইসা হাজির!
সুরাইয়া আঁৎকে ওঠে। চোখ দুটো গোল গোল করে বলে, সাচ্চু পীরের তাবিজে কাজ হইছে?
নয়তো কী? জানেন না উনার নাম শুনলেই লোকে ডরায়? অবশ্য আমার টাকা পয়সা গেছে অনেক। জমানো টাকা যা ছিল তার সবটাই খরচ হইয়া গেছে। ক্যান, আপনার সোনার চেন কেমনে পাইছিলেন মনে নাই আপনার?
সুরাইয়ার মনে পড়ে যায় সোনার চেনের কথা। ফাতেমাই সাচ্চু পীরের কাছ থেকে তাবিজ এনে সুরাইয়ার বালিশের তলায় রেখে দিয়েছিল। অবশ্য সাচ্চু পীরকে তাবিজের মূল্য বাবদ পাঁচশ টাকা দিতে হয়েছিল সুরাইয়াকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরের দিনই বাসার সামনের বারান্দায় চেনটি পাওয়া গিয়েছিল। সেকথা মনে পড়তেই সুরাইয়ার মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে, আমার জন্য একটা তাবিজ আনবি ফাতেমা?
ফাতেমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। বিজয়িনী ফাতেমা সগর্বে বলে, পারব। আজ সন্ধ্যার পরেই যাব। খালুর কথা সব খুইল্যা বলবো পীরসাবকে। টাকা পয়সা কী লাগবে জাইন্যা আসবো। খালাম্মা পীরসাব যদি বলে, আপনাকে যাইতে হবে!
বললে না হয় যাব, চট করে উত্তর দেয় সুরাইয়া। কিন্তু কথাটা বলেই আবার চুপসে যায় ভেতরে ভেতরে। ওই প্রতারক স্বামীকে সে কী সত্যিই আবার চায়? গত বিশটি বছর সে স্ত্রী আর ছেলের কোনো খোঁজ নেয়নি! কত সংগ্রাম করে সুরাইয়া ছেলেটিকে বড় করেছে। সুরাইয়া নিজের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে, সে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সুখী হয়নি? এমনও তো হতে পারে স্ত্রী-পুত্রের শোকে সে আজো মুহ্যমান! কিন্তু সে লজ্জায় সুরাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না। একটা তাবিজ নিলে কার কী ক্ষতি হবে! চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! সুরাইয়া মনস্থির করে ফেলে। সে একটিবার চেষ্টা করে দেখবে।
ফাতেমা রাত আটটা নাগাদ সাচ্চু পীরের বাড়ি থেকে ফিরে আসে। আনন্দে আটখানা ফাতেমা। ভাবখানা এমন যে খালুকে স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে সে। বলে, খালাম্মা পীরসাবকে সব খুইল্যা কইছি। আর আপনার শরীরের অবস্থা শুইন্যা তার খুব মায়া হইছে। বলছে যাওয়া লাগবে না আপনার। পীরসাব বলছে, খালুর মন খুব শক্ত। মন নরম করতে শক্ত তাবিজ লাগবে। বলছে, লন্ডন তো অনেক দূর। তাছাড়া সম্পর্ক ভাঙছে অনেক আগে। পুরানা মামলা। খালুর নজর বদলাইতে এক তাবিজে হইব না। পীরসাবরে বছরখানেক কাজ করতে হইবো। আপনারে ধৈর্য রাখতে কইছে। কাল প্রথম গরম তাবিজটা দিব। পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়ব। তবে খালাম্মা আপনি নিশ্চিত থাকেন। খালু আপনার কাছে দৌড়াইয়া আসব। আপনে খালি শরীরে তাবিজ বানবেন, সাথে সাথে খালুর সারা শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হইবো। তারে আপনার কাছে আসতেই হইবো।
টাকার অঙ্ক শুনে সুরাইয়া চমকে ওঠে। এত টাকা! ফাতেমা বিষয়টি টের পেয়ে বলে, আমার জামাই কেমনে আসছে শুনলেন তো খালাম্মা। তার পরাণেও শান্তি নাই। আমারে চোখে দেখলেই তার শান্তি। ছোট বউয়ের কাছে তো যায়ই না অহন।
সুরাইয়া অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝেই রাজি হয়ে যায়। সত্যিই যদি মানুষটা আবার ফিরে আসে! যা হওয়ার তো হয়েছে। আগামী দিনগুলো যদি মানুষটারে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে পারে, কম কী!
পরদিন সকাল সকাল ফাতেমা টাকা নিয়ে সাচ্চু পীরের বাড়ি যায়। আর একলা ঘরে সুরাইয়া সুন্দর আগামীর স্বপ্ন বোনে। আধঘণ্টার মধ্যেই ফাতেমা তাবিজ, খোল আর তাগা নিয়ে বাসায় ফেরে। ফাতেমা আজ আরো বেশি খুশি। বলে, পীরসাব আপনারে বলছে আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে। তারপর তাবিজ হাতে নিবেন। তাবিজটা খোলে ঢুকাইয়া গলায় পইরা নিবেন।
সুরাইয়া আবেগে থরথর কণ্ঠে বলে, এক্ষুনি যাচ্ছি।
অজু করার পর দেহ-মনের শুদ্ধতায় সুরাইয়ার মনে স্থিরতা আসে। রান্নাঘরের পাশে ছোট একটি রুম, ওখানেই ফাতেমা ঘুমায়। ওদিকে এগিয়ে যায় সুরাইয়া। হঠাৎ করেই যেন আজ ফাতেমার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে সুরাইয়া। ফাতেমার বুদ্ধিতেই তো এতদূর আসা। ফাতেমার রুমের দরজা খানিকটা ভেজানো। ধাক্কা দিতেই সুরাইয়ার শরীর অসাড় হয়ে যায়। ফাতেমা কিংবা লোকটি দেখার আগেই সুরাইয়া নিজের রুমে ফিরে আসে। সুরাইয়া তাবিজটির দিকে চেয়ে থাকে। চিকন সুতো দিয়ে পেঁচানো। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে সুতো ছাড়িয়ে নেয় সুরাইয়া। তারপর কাগজের ভাঁজ খোলে। ছোট এক টুকরো সাদা কাগজ। অনেকটা ট্রেসিং পেপারের মতো।
সুরাইয়া গ্লুকোজ বিস্কুটের গন্ধ পায়। কাগজটি নাকের আরো কাছে ধরে সে। ঠিক গ্লুকোজ বিস্কুটের ভেতরের কাগজ এটি। বিস্কুটের হালকা গুঁড়ো লেগে আছে তাতে। সুরাইয়া চোখ বুজে শুয়ে থাকে। অসীম শূন্যতায় বুকের ভেতরটা মোচড়াতে থাকে তার।

 

 

শিরীন আক্তার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads