• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বাংলাদেশে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য

নৃ-গোষ্ঠী

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

বাংলাদেশে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানে অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এদের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। অপর এক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে এসব নৃগোষ্ঠীর ভাষার সংখ্যা ছাব্বিশটি (ইনডিজেনাস কমিউনিটিস গ্রন্থ)। এরা প্রধানত বাস করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, পটুয়াখালী, বরগুনা, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে। এদের ভাষাগুলোর মধ্যে ওঁরাও, খাসিয়া, গারো, চাকমা, মগ, মণিপুরি, মুন্ডা ও সাঁওতালি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে খুমি, কোচ, হাজং, চাক, খাড়িয়া, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি ভাষার ব্যবহার। এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা আবশ্যক মনে করছি।  

এক. বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের চা-বাগান এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাতৃভাষা ওঁরাও। ওঁরাওভাষীদের সর্বোচ্চ সংখ্যা রংপুরে এবং সর্বনিম্ন সিলেটে। ওঁরাও ভাষা কুরুখ নামে সমধিক পরিচিত। এ ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই, তবে তা লোকসাহিত্য সমৃদ্ধ। ওঁরাও ভাষায় অসংখ্য উপকথা, রূপকথা, গীত, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি রয়েছে।

তবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মুন্ডা ও ওঁরাও ভাষা একই। ওঁরাও এবং বাংলা ভাষায় কিছু গহনার নাম এক; যথা— টিকলি, বালা, পায়রা, বালি, কানপাশা ইত্যাদি। সন্বন্ধসূচক অনেক ওঁরাও এবং বাংলাশব্দও এক; যেমন— মা, বাবা, মামা, ভাগিনা ইত্যাদি। এ ছাড়া আরো কিছু বাংলা শব্দ এবং ওঁরাও শব্দের মধ্যে যথেষ্ট মিল দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে ওঁরাও ভাগোয়ান, বাংলায় ভগবান; ওঁরাও ভগতি, বাংলা ভক্তি; ওঁরাও ভূত, বাংলাতেও ভূত ইত্যাদি।

দুই. খাসিয়া ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। খাসিয়া ভাষায় গ্রামকে ‘পুঞ্জি’ বলে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ও পার্বত্য অরণ্য অঞ্চলে তাদের বসবাস। খাসিয়া ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রধানত পাড়, লিংগাম ও ওয়ার। পাড় মানে পর্বত এবং খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাই পাড়। লিংগাম শব্দে গারো পাহাড়কে বোঝায়। তাই গারো পাহাড়ের সন্নিকটস্থ অঞ্চলের ভাষাই লিংগাম নামে সমধিক পরিচিত। ওয়ার মানে উপত্যকা।

একসময় খাসিয়া ভাষা বাংলা হরফে লিখিত হতো। বাংলা অক্ষরে বাইবেলের কিছু অংশ খাসিয়া ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়েছিল। বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় রোমান অক্ষরে চেরাপুঞ্জি ও এতদাঞ্চলের খাসিয়া ভাষা লিখিত হচ্ছে। বাংলাদেশে খাসিয়াদের জনসংখ্যা অত্যধিক নয়। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন পার্বত্য ও অরণ্যে অঞ্চলে তাদের বসবাস।

তিন. গারো ভাষা প্রধানত চীনা-তিব্বতি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং অনক্ষর ও অলিখিত একটি প্রাচীন অনার্য ভাষা। চীনা ভাষার সঙ্গে এ ভাষার শব্দ, ব্যাকরণ ও ভাষা তত্ত্বগত প্রচুর মিল রয়েছে। এ ভাষা প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, গান, ছড়া, কিংবদন্তি, উপকথা, পালাগান ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এতে নৃতত্ত্ব ও ধর্মের কথাও আছে। বহু ভাষার শব্দ দ্বারা গারো ভাষার শব্দকোষ পুষ্ট। বাংলা ও অসমিয়া ভাষার সঙ্গে এ ভাষার সাদৃশ্যের কারণে কেউ কেউ গারো ভাষাকে এই দুই ভাষার মিশ্ররূপ বলে মনে করেন। খ্রিস্টান মিশনারিরা গারো ভাষায় রোমান অক্ষর প্রচলন করেন। বাংলা হরফে গারো ভাষা স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। বর্তমানে গারোদের পারিবারিক ভাষা গারো কিন্তু তাদের পোশাকি ভাষা বাংলা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ভারতের মেঘালয় সীমান্তে রয়েছে গারোদের বসবাস।

চার. চাকমা ভাষা বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর মধ্যে উন্নততর। এ ভাষায় কিছু প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। সে-সবের মধ্যে তালপাতায় লিখিত ‘চাদিগাং চারা’ পালা একটি। চাকমা ভাষার বর্ণমালা থাইল্যান্ডের ক্ষের, আন্নাম, লাওস, কন্বোডিয়া, শ্যাম ও দক্ষিণ ব্রহ্মের লিপির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। চাকমা ভাষায় চীনা ভাষার মতো টান আছে। শব্দতত্ত্ব, ছন্দ প্রকরণ, লোকসাহিত্য, বাগ বিন্যাস ও ধ্বনিতত্ত্বের দিক দিয়ে চাকমা ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার খুব মিল রয়েছে। রাঙামাটি থেকে ‘চাকমা প্রথম পাঠ’ নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রণেতা নয়ন রাম চাকমা। চাকমা ভাষায় রচিত অনেক গীতও আছে, যেগুলো চাকমা কথ্য ভাষায় রচিত। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে চাকমা কবি শিবচরণ রচিত ‘গোজেল লামা’র ভাষা প্রায় হুবহু বাংলা, এতে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকার’ মতো বন্দনাগীতি রয়েছে। ‘রাধামন ধানপাতি’ ও ‘চাদিগাং চারা’ চাকমাদের দুটি উল্লেখযোগ্য পালা। চাকমা লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। বহু লোকগাথা ও কিংবদন্তি রয়েছে এ ভাষায়। প্রবাদ-প্রবচন চাকমা ভাষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এতে প্রধানত কৃষি, পশুপাখি, প্রকৃতি, সমাজ, ধর্ম, দেহ-তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় বিধৃত হয়েছে। বর্তমান এ ভাষা রূপগতভাবে বাংলা, অসমিয়া, রাজবংশী, গারো, সাঙ্ঘমা ও চাটগেঁয়ে ভাষার কাছাকাছি। এমনকি চাকমা গোত্রে-গোত্রেও এর পৃথক কথ্যরূপ দেখা যায়।

পাঁচ. মগভাষা হলো আরাকানি ভাষার কথ্য রূপ এবং একটি সংকর ভাষা। চীনা, প্রাচীন বর্মি এবং মিজো ভাষার সঙ্গে এ ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে সবচেয়ে বর্মি ভাষার সঙ্গে রয়েছে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মগ ভাষার আদিনিবাস আরাকান। বাংলাদেশে দুই লক্ষাধিক লোক মগ ভাষায় কথা বলে। মগভাষা আরাকান ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রিত ভাষা।

আরাকান ও বাংলাদেশেও একশ্রেণির মগ আছে। যাদের ভাষা বাংলা। বড়ুয়ারা মূলত মগ, কিন্তু বাংলাভাষী। পালি মগদের ধর্মীয় ভাষা। এ কারণে বহু পালি শব্দ কিছুটা বিকৃত কিংবা অবিকৃতভাবেই মগ ভাষায় প্রবেশ করেছে। যেমন- ভিক্ষু, নির্ব্বাণ, বিহার, ভাবনা (ধ্যান), দুক্খ, বস্সা (বর্ষা) ইত্যাদি। আত্মীয়সূচক কিছু মগ শব্দ বাংলায় ব্যবহূত হয়, যা উচ্চারণ ও অর্থে এক। যেমন— মগরা ছোট মেয়েকে বলে ‘মা’, কিন্তু আঞ্চলিক বাংলায় মেয়েকে আদর করে বলা হয় ‘মা’। বর্মি ও মগ ভাষায় বার ও মাসের নাম এবং সংখ্যা গণনাও অভিন্ন। মগভাষায় সৃজনশীল সাহিত্য না থাকলেও লোকসাহিত্যের উপাদান আছে প্রচুর। এতে রয়েছে প্রবাদ, ধাঁধা, উপকথা, গীত, ভূতের গল্প, জাতকের গল্প, বৌদ্ধ রাজা-রানিদের কাহিনি ইত্যাদি।

ছয়. মণিপুরি ভাষা মোঙ্গলীয় ভাষা পরিবারের তিব্বতি-বর্মিশাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীভুক্ত প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বছরের প্রাচীন ভাষা। এর বর্ণগুলো তিব্বতি বর্ণমালার অনুরূপ। মণিপুরি একটি সংকর ভাষা। বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও ব্রহ্মদেশে প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক লোক এ ভাষায় কথা বলে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটে মণিপুরি ভাষীর সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষ।

মণিপুরি ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব যুগের প্রথম নিদর্শন গীতি কবিতা ‘ঔগ্রী’। তার আগে বিচিত্র প্রেম, গীত, প্রবাদ-প্রবচন, পালাগান, ছড়া ইত্যাদির প্রচলন ছিল। মণিপুরি ভাষায় প্রচুর সামরিক সঙ্গীত এবং কিছু নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্য, এমনকি মহাকাব্যও রচিত হয়েছে। এ ভাষায় বাংলা ও পাশ্চাত্যের বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ এবং রামায়ণ, মহাভারতও অনূদিত হয়েছে।

সাত. মুন্ডা ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। এ ভাষা উড়িয়া, অসমিয়া ও বাংলা ভাষার প্রাথমিক ভিত রচনা করেছে। খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, কোল ইত্যাদি উপজাতীয় ভাষার সঙ্গে মুন্ডা ভাষার সম্পর্ক লক্ষণীয়। অসংখ্য মুন্ডা শব্দ বাংলা ভাষায় বিশেষত আঞ্চলিক ভাষায় বিদ্যমান। কৃষি, গৃহস্থালি, বসতি, গণনা, আত্মীয়তা, ওজন, ভূমি, পশু-পাখি, গাছ-গাছড়া ইত্যাদি সংক্রান্ত শব্দ মুন্ডা তথা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা থেকে আগত।

আট. সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্ভুক্ত। প্রায় দশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে ব্রহ্মদেশ ও আসামের ভেতর দিয়ে অস্ট্রো-এশীয় জনগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিহারের সাঁওতাল পরগনায় সাঁওতালভাষী জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। পশ্চিমবঙ্গের বিহার সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এবং বাংলাদেশের দিনাজপুর, রাজশাহী ও রংপুরে বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় দেড় লাখ সাঁওতাল লোকের বাস। তারা বাংলায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে এবং নিজেদের ভাষায়ও বহু বাংলা শব্দ ব্যবহার করে। সাঁওতাল ভাষায় দুটি উপভাষা আছে ‘নাইলি’ ও ‘করকু’। এটি অনক্ষর ভাষা। ভারতে এখনো সাঁওতালি ভাষা দেব নাগরী অক্ষরে লিখিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কোনো সাঁওতালি বই-পুস্তক নেই। খ্রিস্টান মিশনারিরা দু-একটি সাঁওতাল বিদ্যালয় স্থাপন করে ইংরেজি বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে। সাঁওতালি ভাষার প্রায় সব ধ্বনিই বাংলায় রয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ব্যাকরণিক মিলও আছে। বাংলায় ও আঞ্চলিক উপভাষায় বহু সাঁওতালি শব্দ রূপান্তরিত অবস্থায় আজো বিদ্যমান।

এ ছাড়া খুমি, কোচ, হাজং, চাক, খাড়িয়া, খিয়াং ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে বাস করলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে এর মধ্যে হাজংদের নিজস্ব ভাষায় বর্তমানে বহু বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে। আর তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে এবং এ ভাষাটির সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। তবে বাংলা ভাষা গঠনের যুগে উপজাতীয় ভাষাগুলোর অবদান অপরিহার্য। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads