• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখি

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখি

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৯

বালকবয়সে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘প্রশ্ন’ কবিতা আবৃত্তির ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। সোনার তরী, চিত্রা, মানসী, বলাকা কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমার হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কি শুধুই কবিতা? আজ আমি ভাবি— রবীন্দ্রনাথ যদি শুধু কবিতাই লিখতেন কিংবা ছোটগল্প অথবা গান! রবীন্দ্রনাথের তাতে কিছু যায় আসতো না। বরং বাংলা সাহিত্য তাঁর অকৃপণ দানের অভাবে অপূর্ণ থেকে যেত। আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ যে শাখাতেই কলম ধরতেন, সেখানেই তিনি বিশ্ব সম্রাট হয়ে উঠতেন। নামমাত্র একটি উদাহরণ যদি টানি, তবে বলতে হয়— ভানুসিংহের পদাবলী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় বৈষ্ণব পদাবলীর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিল কেবল রবীন্দ্রনাথের অপার বিস্ময়াভিভূত দর্শন-চিন্তার কারণে। সুতরাং ত্রিশের প্রণিধানযোগ্য কবি বিষ্ণু দে যথার্থই বলেছিলেন, ‘বাংলার ছোট ঐতিহ্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট আবির্ভাব একটা প্রাকৃতিক ঘটনা।’
আমাদের বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান যেমন চিরসত্য, প্রকৃত তেমনি তাঁর বিপুল কাব্যভান্ডারের অনেক ক্ষেত্রভূমি তার ভিতরের সার নির্যাস আজও পাঠকের কাছে অনাবিষ্কৃত। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন ‘জটিলতম পরিচ্ছেদ’। কিন্তু শত দুরূহতার ভেতরেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার কাছে একাধারে চিরবিস্ময় ও আদরণীয়। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর সকল সাহিত্য সাধনার ভিতর দিয়ে সকলের হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, সেক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয় তাঁর ধর্ম-দর্শন একটি বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

মহাজাগতিক অনুসন্ধানে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার শুরু। এর পেছনে কাজ করেছে নিজ বাড়িতে নিরাকার স্রষ্টার উপাসনা। এর ভেতরেই মহাসত্যকে বোধ ও মননে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা দেখেছি যে, বালক বয়সের সহজাত অনুসন্ধিৎসা রবীন্দ্রনাথের অতিজাগতিক তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছে, যা বয়স এবং অতিলৌকিক অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতর হয়। আর তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনে অনুভব করেছিলেন ধর্মমতে কিংবা প্রচলিত অর্থে মানুষ যাকে ঈশ্বর বা স্রষ্টা বলে থাকে তার অবস্থান আমাদের অন্তর্জগতে। ১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে আমাদেরকে জানিয়েছিলেন, “...কিন্তু মানুষের আর একটা দিক আছে যা এই ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্যে বস্তু-সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশি। সেখানে জ্ঞান উপস্থিতি-প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে।”

পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন ও প্রধান ধর্মমতও মোটামুটি একইরকম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মলব্ধ দর্শন তাঁর ধর্মচিন্তাকে নতুন পথে হাঁটতে শেখায়। এমন কিছু বলে যা বহুশ্রুত হয়েও নতুন এবং গভীরতর ব্যঞ্জনাময়। তাঁর সেই অন্তর্লোকে জীব-মানুষের চেতনা-বিশ্ব আলোকিত করে আছেন এক জ্যোতির্ময় সত্তা। ইনি এমন এক উপস্থিতি, যাঁর অভ্যন্তর থেকে নিরন্তর শুভবোধ, কল্যাণ এবং মুক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় তাঁর এই ধর্ম-দর্শনের আবেগ ও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে বলেই রবীন্দ্রনাথ আবালবৃদ্ধবনিতার সম্মুখ শিয়রে ঠাঁই করে নিয়েছেন। আমার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁরই মতো সীমার বৃত্ত থেকে অসীমের মুক্তিতে আলোকবর্তিকা হয়ে আজও পথ দেখায়।

এই যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য একুশ শতকে এসেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে তারও কারণ আধুনিক জীবনাচরণে তার প্রকাশ আছে বলে। যদিও আধুনিক শব্দটি পিচ্ছিল, পরিবর্তমান ও বিপজ্জনক। বিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে ‘আধুনিক সাহিত্য’ কখনো ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে বিভিন্ন সংকলন প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর ‘An Acre of Green Grass’ নামে ‘আধুনিক বাংলা সহিত্যের পর্যালোচনা’ এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথকে আমরা বিশ্বসাহিত্যের তুলনামূলক বিচারে আধুনিক কবি হিশেবে পেয়েছি।
যদিও প্রচলিত অর্থে রবীন্দ্র উত্তর কালপর্বে ত্রিশের ‘প্রগতি’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে নতুন একদল কবি-সাহিত্যিকের হাতে বাংলা কবিতা কিংবা গদ্যের পালাবদল ঘটেছিল, সেই নতুন সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্য হিশেবে নামাঙ্কিত করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে সাম্প্রতিকতাকে উত্তীর্ণ করতে পেরেছে যে সাহিত্য, সেটিই প্রকৃত অর্থে আধুনিক। এই তুল্যমূল্য বিচারে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কতখানি আধুনিক?

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল বিস্ময়াভিভূত দার্শনিকতা বাংলা কবিতাকে যে উচ্চ আসন দিয়েছে, সেখানে সমগ্র ভারতীয় চেতনার তুলনায় বাংলার সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঙালির ইতিহাসচেতনায় ঠাঁই করে নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতার কালবোধ বিশ্বব্যাপী শিল্প-সাহিত্যের রস আস্বাদনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রচলিত হিন্দু মিথ, মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্য, গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি, সমাজনিহিত আচার-প্রথা-কৃষ্টির ভিতরে বেড়ে উঠেছিল। ফলে একক সমগ্রতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ইতিহাস বৈশ্বিক চেতনায় উদ্ভাসিত মনস্তত্ব ও দার্শনিকতায় আক্রান্ত। আবার বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষত ছোটগল্পের জাদুকর বললে রবীন্দ্রনাথকে খুব বেশি বলা হবে না। বলা যায় উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটগল্পের সূচনা। বাংলা ছোটগল্পের নিয়তিবাদী ও অতিপ্রাকৃত গল্পের দুটি ধারা আমরা লক্ষ করে থাকি। এই অতিপ্রাকৃত গল্পের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানবমনের দ্বান্দ্বিক টানাপড়েনের মধ্যে যে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, আশা-নিরাশার বিভ্রম, তারই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রবীন্দ্রনাথ অতিপ্রাকৃত গল্পের জগৎ নির্মাণ করেন। একইভাবে রবীন্দ্রনাথের নিয়তিবাদী গল্পের আখ্যান রচিত হয়েছে নরনারীর মনস্তাত্ত্বিক জীবনবোধের সমগ্রতায়। সুতরাং বাংলা ছোটগল্পকে রবীন্দ্রনাথ দাঁড় করিয়েছেন ইতিহাসের কৃষ্ণ সময়ের অকৃত্রিম ভাষ্যরূপে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি ও সমাজনীতির পাশা খেলায় তাঁর কথাসাহিত্যের পাত্র-পাত্রী সাধারণ মানুষের ভাগ্য ও ভবিতব্যকে পুঁজি করে হয়ে ওঠে অসাধারণ। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্ব নাটকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রূপকার উইলিয়াম শেকসপিয়ার যেভাবে এই মর্ত্যে বিচরণকারী প্রতিটি নর-নারীর ভেতর-বাহির পুঙ্খানুপঙ্খভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন, ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা কথাসাহিত্যে ভারতবর্ষের নর-নারীর এমন কোনো চরিত্র বাদ রাখেননি যাকে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে দেখতে পাই না। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির নিত্যদিনের সঙ্গী যেন। তাঁর গানে যেমন বাংলার প্রকৃতি বাঙালির উঠোনে ধরা পড়ে তেমনি প্রেম ও পূজা বিষয়ক গান, কীর্তন, বাউল ও লোকসংগীতের ধারায় হয়েছে উৎসারিত এবং বাঙালিকে করেছে আশ্বস্ত, শান্ত, দিয়েছে শান্তি ও পরিপূর্ণতা।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান কিংবা কথাসাহিত্য ব্যতিরেকেও বৈষ্ণব রসবোধে উদ্ভাসিত ভানুসিংহের পদাবলী, নাটক, প্রবন্ধ, নৃত্যনাট্য, চিত্রকলা সবখানেতেই তিনি তাঁর সমকালকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ও প্রচেষ্টা যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় তেমনি সেই ভাবনাগুলো তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মেও প্রতিফলিত হতে দেখি।

সুতরাং আধুনিকতার মানদণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাম্প্রতিক, সমকালীন ও সমসাময়িক হয়েও বৃহদার্থে শাশ্বত, ভাস্বর এবং চিরকালীন। আর তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পরেও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী, যা ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। আমার রবীন্দ্রনাথ আজো সমান দেদীপ্যমান, চিরকালীন আধুনিক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads