• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

লেখমালার সাহিত্য আড্ডা

  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৯

শুদ্ধ কল্যাণ

 

 

২০১৫ সাল থেকে যাত্রা করে আজ পাঁচ বছরে ‘লেখমালা’ ছোটকাগজের একটি পূর্ণ অবয়বে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তারই স্বাক্ষর রেখে গেলে যেন ‘লেখমালা’র দ্বিতীয় সাহিত্য আড্ডা। গত ৯ নভেম্বর শনিবার রাজধানীর শাহবাগের কাঁটাবনে অবস্থিত ‘কবিতা ক্যাফে’তে অনুষ্ঠিত হলো চার পর্বে বিভক্ত মন ও মননের ছোটকাগজ ‘লেখমালা’র দ্বিতীয় সাহিত্য সন্ধ্যা। লেখমালার সম্পাদক ও কবি মামুন মুস্তাফার মনোমুগ্ধকর সঞ্চালনায় উঠে আসে বাংলা সাহিত্যের নানা প্রেক্ষিত। এই সাহিত্য আড্ডাটি সাজানো হয় দেশের প্রথিতযশা কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিকের ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর ‘জীবন ও সাহিত্য আলোচনা’সহ ‘ছোটকাগজ সম্পাদকের কথা’, ‘এই সময়ের লেখালিখি’ এবং ‘এই সময়ের পাঁচ নারী কবির’ কণ্ঠে কবিতার সমাহারে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘ছোটকাগজ সম্পাদকের কথা’য় তিন ছোটকাগজ সম্পাদক যথাক্রমে ‘ব্যাটিংজোন’-এর কবি মাহফুজ রিপন, ‘শব্দকুঠি’র রুখসানা রহমান এবং ‘মানুষ’ কাগজের শফিক সেলিম। এই সম্পাদকত্রয়ের কথায় ছোটকাগজ সম্পাদনার ক্ষেত্রে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো পাঠক জানতে পারে। লেখাপ্রাপ্তি, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, লেখকদের মান-অভিমান— সবকিছু ছোটকাগজ সম্পাদকরা তুলে ধরেন। পাশাপাশি ছোটকাগজ সম্পাদনায় ব্যক্তি ও পারিবারিক ক্ষেত্রে এর প্রভার সম্পর্কেও উপস্থিত দর্শক অবহিত হন। এর পরই ‘লেখমালা’ সাহিত্য আড্ডার মূল আকর্ষণ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান যশস্বী কবি ও কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিকের ‘জীবন ও সাহিত্য’ নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরই স্নেহধন্য ছাত্র কবি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আপেল আব্দুল্লাহ, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং ছোটকাগজ লোক-সম্পাদক ও কবি অনিকেত শামীম। উল্লেখ্য, এই তিনজন আলোচক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কবি আবুবকর সিদ্দিকের ছাত্র ছিলেন।

আলোচক তিনজন কবি আবুবকর সিদ্দিকের কাব্য ও গদ্যশক্তির সৌকর্য ও সবলতা আজকের পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। আবুবকর সিদ্দিকের লেখনীশক্তি যে অতুলনীয়, অদ্বিতীয়— এই বিষয়টি আলোচকরা উদাহরণসহকারে নবীন সাহিত্যানুরাগী, কবি-লেখক, পাঠকের উদ্দেশে ব্যাখ্যা করেন। আবার লেখক হিসেবে আবুবকর সিদ্দিকের রাষ্ট্রীয়ভাবে যতটা স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল, তা না পাওয়ার ক্ষোভও প্রকাশ করেন তারা। সঞ্চালক ‘লেখমালা’র সম্পাদক, কবি মামুন মুস্তাফার কণ্ঠে আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা পাঠ ও কবির জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা উপস্থিত দর্শকদের আন্দোলিত করে। এই নিরলস, সৎ ও নিষ্ঠাবান কবি— প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে বাজারজাত করে তোলার প্রবৃত্তি যাঁর রুচিবিরুদ্ধ, সেই কবির পক্ষেই বলা সম্ভব ‘কবিতাসংসর্গ আমার জীবনে এক বিশুদ্ধ সংগম’। বলা আবশ্যক, কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিকের ৮৫ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে ‘লেখমালা’ আয়োজন করে তাঁকে নিয়ে আলোচনা। আবুবকর সিদ্দিকের এই মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবি।

এই সাহিত্য আড্ডার আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বরেণ্য কবি গৌতম গুহ রায়ের ‘এই সময়ের লেখালিখি’ নিয়ে সংলাপ। ‘এই সময়ের লেখালিখি’ পর্বে বাংলাদেশ অংশে কথা বলেন কবি কামরুল হাসান এবং বর্তমান সময় ও সাহিত্য প্রসঙ্গে কথা বলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কবি গৌতম গুহ রায়। বাংলাদেশের হয়ে কবি কামরুল হাসান কবি আবুবকর সিদ্দিকের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বর্তমান সময়ের কবি-লেখকদের নিজেদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই অগ্রজদের সাহিত্য পাঠ জরুরি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কবি গৌতম গুহ রায় নব্য উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিবাদী আগ্রাসন কীভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রাস করতে চলেছে, সে বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং বলেন যে, এই সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মূলত গৌতমের মানসলোকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে একটি অখণ্ড বাংলার প্রতিচিত্র দেদীপ্যমান। গৌতম নিজেকে সেই বাংলার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। মনে করা যায়, এ হয়তো গৌতমের আদি বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের মালখানগরে এবং তাঁর মাতুলালয় ময়মনসিংহ জেলায় হওয়ার কারণে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে গৌতম গুহ রায়ের পূর্বপুরুষ চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। এই ছিন্নমূলের খোঁজ ও আর্তি গৌতম গুহ রায় ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতা ও গদ্যে। আর তাই ‘এই সময়ের লেখালিখি’ প্রসঙ্গে গৌতমের ভাষ্যে সেই বোধই উৎসারিত হয়েছে।

সবশেষে এ সময়ের পাঁচ নারী কবির কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে ‘লেখমালা’র দ্বিতীয় সাহিত্য আড্ডার সমাপ্তি টানা হয়। এই পাঁচ নারী কবিরা হলেন— সাফিনা আক্তার, সঞ্চিতা পাল, শ্রাবণী প্রামানিক, তিথি আফরোজ ও বিপাশা মণ্ডল। উল্লিখিত কবিদের সবাই মূলত শূন্য দশক থেকে দ্বিতীয় দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন। তাদের কবিতার মধ্যে উপস্থিত সাহিত্যানুরাগীরা আগামী দিনের কবিদেরই খুঁজে পেয়েছেন। ছোটকাগজ ‘লেখমালা’র সহযোগী সম্পাদক কবি তুষার প্রসূন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে ছোটকাগজ হিসেবে ‘লেখমালা’র প্রকাশনা বর্তমানে ১০টি। ইতোপূর্বে ‘লেখমালা’ প্রথম ও তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দুবার একজন ছোটকাগজ সম্পাদক ও একজন সৃজনশীল লেখককে সম্মাননা জানিয়েছে। আগামী বছর পঞ্চম বর্ষপূর্তিতেও ‘লেখমালা’ ওই দুই শাখায় সম্মাননা প্রদান করবে বলে কবি তুষার প্রসূন ঘোষণা দেন।

পরিশেষে বলতে চাই, গত ৯ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের’ আঘাত হানার দিন। ওই ঝড়-ঝঞ্ঝার ভেতরে অসংখ্য দর্শকের উপস্থিতি ‘লেখমালা’র সাহিত্য আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। শুভানুধ্যায়ীদের আগমন প্রমাণ করে যে, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা আজকের আকাশ-সংস্কৃতির যুগেও নাগরিক বোধে দেদীপ্যমান। এই ধারা অব্যাহত থাক, কামনা করি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads