• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

প্রতীকী ছবি

বিবিধ

নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ২২ নভেম্বর ২০১৯

মহান রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, ‘নারী পুরুষের যে কেউ ঈমান অবস্থায় নেক আমল করবে আমি অবশ্যই তাকে শান্তিময় জীবন দান করব, এবং আখেরাতে তার কৃতকর্মের উত্তম প্রতিদান দিব।’ (সুরা নাহল : ৯৭)।

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার উত্তম জীবন এবং পরকালের উত্তম প্রতিদান দেওয়ার ব্যাপারে যেমন পুরুষদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তদ্রূপ মহিলাদের সাথেও অঙ্গীকারবদ্ধ। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোনো পার্থক্য করেননি। তবে শর্ত হলো, প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে যত্নবান হতে হবে। সুতরাং নারী বা মহিলারাও যদি ঈমানকে পরিশুদ্ধ করে নেককাজ তথা ইবাদাত-বন্দেগি, স্বামীর খেদমত ও তার আমানতের হেফাজত এবং সন্তান লালন-পালন করে তাহলে একদিকে যেমন তারা দুনিয়াতে উত্তম জীবন প্রাপ্ত হবে, সুখময় দাম্পত্য জীবনের অধিকারী হবে এবং আত্মার প্রশান্তি লাভ করবে; অপরদিকে আখেরাতেও তারা উত্তম প্রতিদান পাবে, চির সুখ-শান্তিসমৃদ্ধ জান্নাত লাভ করবে এবং অভাবনীয়, অকল্পনীয় ও অপূর্ব নেয়ামত ভোগ করবে। নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো—

ঈমান-আকিদা পরিশুদ্ধ করা

ঈমান শব্দের অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করা, আর আকিদার অর্থ হচ্ছে দৃঢ় বিশ্বাস। কোরআন-হাদিসে যেসব বিষয়কে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, সেগুলোকে অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা এবং মুখে স্বীকার করার নামই ঈমান। আর আমল-ইবাদত হচ্ছে ঈমানের পূর্ণতা। যার ঈমান নেই তার কোনো আমল মহান মাবুদের দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। রুহ ছাড়া যেমন শরীরের কোনো মূল্য নেই, তদ্রূপ ঈমান ছাড়া আমলের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘যারা কাফের তথা যাদের ঈমান নেই তাদের আমলসমূহ মরুভূমির মরিচিকার মতো।’ (সুরা নূর : ৩৯)। তাই ঈমান দুরস্ত করা সকলের বুনিয়াদি ফরজ। ঈমানের মুফাসসালে বর্ণিত হয়েছে : আমি ঈমান আনলাম বা বিশ্বাস করলাম আল্লাহতায়ালাকে, তাঁর ফেরেশতাগণকে, তাঁর প্রেরিত সকল আসমানি কিতাবকে, তাঁর প্রেরিত সকল নবী-রাসুলকে, কিয়ামত দিবসকে, তাকদিরকে অর্থাৎ জগতে ভালো-মন্দ যা কিছুই হয় সবই আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি, তাঁরই পক্ষ হতে নির্ধারিত এবং মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত হওয়াকে। এছাড়াও ঈমানের আরো ৭৭টি শাখা রয়েছে যেগুলোর প্রতিও ঈমান আনা জরুরি।

ইবাদত করা

প্রত্যেক বালেগা নারীর উপর ফরজ হলো— পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, কোরআন সহিহ শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা, রমজান মাসে রোজা রাখা, ধন-সম্পদ থাকলে জাকাত আদায় করা এবং হজ করা। এসব বিষয়ের মাসয়ালা-মাসাইল উপযুক্ত ব্যক্তি বা সহিহ কিতাব থেকে শিখে নিতে গবে। এগুলো অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়। আর এগুলো বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আমল না করলে কাফের তো হয় না, তবে ফাসেক সাব্যস্ত হয়। সেক্ষেত্রে তওবা করা জরুরি। এবং নামাজ রোজার উমরি কাযা করে নিতে হবে। জাকাত আদায় বাকি থাকলে তাও আদায় করে দিতে হবে।

স্বামীর খেদমত করা

মহান আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে স্বামীকে স্ত্রীর ওপর বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং স্বামীর জন্য স্ত্রীর প্রতি বিরাট হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখা, তার মনোরঞ্জনে সচেষ্ট থাকা অনেক সওয়াবের কাজ। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস নিম্নে পেশ করা হলো—

১.         মহানবী (সা.) বলেন, যে নারী এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট, তার জন্য জান্নাত অনিবার্য হয়ে যায়। (তিরমিজি : ১১৬১)।

২.         মহানবী (সা.) বলেন, যদি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন স্বামীকে সিজদা করে। (তিরমিজি : ১১৫৯,  সুনানে দারেমি : ১৫০৪, সুনানে আবু দাউদ : ২১৪০)।

৩.         মহানবী (সা.) বলেন, স্বামী যদি স্ত্রীকে ডাকে তখন তার ডাকে সাড়া দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়, যদিও সে চুলার ওপর থাকে। অর্থাৎ স্ত্রীর যত কাজই থাকুক না কেন, স্বামীর ডাকা মাত্র সবকিছু পরিত্যাগ করে তার ডাকে সাড়া দেয়া একান্তভাবে জরুরি। (তিরমিজি : ১১৬০)।

৪.         মহানবী (সা.) বলেন, যদি স্বামী স্ত্রীকে তার শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য আহ্বান করা সত্ত্বেও সে তার আহ্বানে সাড়া না দেয় এবং এ অবস্থায় স্বামী অসন্তুষ্ট হয়ে রাত অতিবাহিত করে তাহলে এ স্ত্রীর প্রতি ফেরেশতাগণ ভোর পর্যন্ত লানত করতে থাকেন। (বুখারি : ৩২৩৭)।

৫.         মহানবী (সা.) বলেন, কোনো স্ত্রী যখন পৃথিবীতে তার স্বামীকে কষ্ট দেয় তখন জান্নাতে এ স্বামীর জন্য নির্ধারিত হুরগণ বলতে থাকে : আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন, তুমি তাকে কষ্ট দিও না। সে তো তোমার কাছে অস্থায়ী মেহমান মাত্র। অচিরেই সে তোমাকে পরিত্যাগ করে আমার সান্নিধ্যে চলে আসবে। (তিরমিজি : ১১৭৪)। উল্লেখ্য, স্ত্রীদেরও স্বামীর নিকট হক পাওনা আছে। সেগুলো আদায় করা পুরুষদের দায়িত্ব।

নিজের সতীত্ব ও স্বামীর মালের হেফাজত করা

স্ত্রীর নিজের ইজ্জত এবং স্বামীর মাল তার নিকট আমানত হিসেবে থাকে। নিজের সতীত্বের হেফাজতের লক্ষ্যে নিজেকে পর্দায় রাখা ফরজ। আল্লাহপাক এমন নির্দেশই দিয়েছেন সুরা আহজাবে। তাই দেবর-ভাশুর, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালু, নিজ শ্বশুর ছাড়া বিভিন্ন রকম শ্বশুর, উকিল বাপ, ধর্ম যাপ, ধর্ম ভাই ইত্যাদি থেকে পর্দা করা ফরজ। একান্ত প্রয়োজনে পর্দার আড়াল থেকে কর্কশ ভাষায় কথা বলা জায়েজ। শরীয়াতে এ আমানতের অপব্যবহার তথা পরপুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা বা অন্য কোনো অবৈধ আচরণ করলে কিংবা তার অনুমতি ছাড়া স্বামীর মাল খরচ করলে তা খিয়ানত বলে গণ্য হবে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, মুমিন বান্দা খোদা ভীতির পরে নেক বিবি অপেক্ষা উত্তম কোনো জিনিস পেতে পারে না, যে নেক বিবিকে স্বামী কোনো কাজের আদেশ করলে সে সাথে সাথে তা পালন করে, তার দিকে তাকালে সে তাকে খুশি করে, স্বামী কোনো কাজ করার অঙ্গীকার করলে সে তাকে তা পূরণে সাহায্য করে এবং স্বামী অনুপস্থিত থাকলে সে নিজের ইজ্জত এবং স্বামীর মালের হিফাজত করে। (ইবনে মাজা : ১৮৫৭)।

সন্তান লালন-পালন ও তার শিক্ষা-দীক্ষা

একজন আদর্শ মা একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মতো। অপরদিকে মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, প্রতিটি শিশুই ফিতরাতে ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান বা অগ্নিপূজক বানায়। (তিরমিজি : ২১৪৩)। অর্থাৎ প্রত্যেকটি শিশুই মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তার মাঝে সুন্দর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার যোগ্যতা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু শিশুর মাতা-পিতা যদি এ ব্যাপারে যত্নবান হয় এবং তাকে গড়ার জন্য শরিয়ত কর্তৃক বর্ণিত পন্থায় যথাযথ মেহনত করে তাহলে তার মাঝে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। অন্যথায় তা বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার জন্য নিজের সন্তানকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা একান্ত জরুরি। পিতা যেহেতু অধিকাংশ সময় বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সন্তান ৮/১০ বছর পর্যন্ত মায়ের আঁচলের নিচেই প্রতিপালিত হয় এজন্য সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে তাকে বেশি যত্নশীল হতে হয়।

রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, কোনো পিতা-মাতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ কোনো উপহার দিতে পারে না। (তিরমিজি : ১৯৫৭)। সুতরাং পিতা-মাতা তার সন্তানকে আচার-আচরণে, জীবন চলার পদে পদে ইসলামী শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। প্রতিদিন যদি একটি করে সুন্নাতও শেখায় তাহলে দেখা যাবে কিছুদিনের মধ্যেই তার গুরুত্বপূর্ণ সব সুন্নাত শেখা হয়ে গেছে।

মনে রাখা চাই— মনোবিজ্ঞানের আলোকে দেখা গেছে শিশুরা সোহবত বা সংশ্রব দ্বারা বড়ই প্রভাবিত এবং তাদের মাঝে দেখে দেখে হুবহু নকল করার যোগ্যতা অধিক পরিমাণে বিদ্যমান। তাই তারা যদি নেক লোকদের নিকট থেকে নেক কাজ দেখতে থাকে তাহলে সেও ছোট থেকেই নেককার হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে যদি তারা বদকারদের নিকট থেকে শুধু মন্দ কাজ দেখতে থাকে তাহলে সে ছোট থেকেই চরিত্রহীন এবং বখাটে হয়ে ওঠে।

আজকের শিশুই আগামী দিনে দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করবে। আজ যদি তারা নিজেরাই ধ্বংসের পথে চলে যায় তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার। এ নিশ্চিত ধ্বংস থেকে ভবিষ্যৎকে সুন্দর করতে হলে এখনই আমাদের আল্লাহর বিধানে ফিরে আসার পাশাপাশি সন্তানকে দিনি শিক্ষা তথা আল্লাহ ও রাসুলের শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা উচিত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads