• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ডিম দিয়েছে মহাবিপন্ন কচ্ছপ বাটাগুর বাসকা

বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপের বাচ্চা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

ডিম দিয়েছে মহাবিপন্ন কচ্ছপ বাটাগুর বাসকা

  • রেজাউল করিম সোহাগ, শ্রীপুর
  • প্রকাশিত ২১ মার্চ ২০১৯

আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় এক সময়ে বিশাল আকারের কচ্ছপ ঘুরে বেড়াত। প্রকৃতিতে তাদের ছিল অবাধ বিচরণ। সাগরের তীরে বালুর ভিতরে ডিম দিত। সেই ডিমে বাচ্চা জন্মও হতো নিয়মিত। তবে এসব স্মৃতি কেবল বইপুস্তকেই এখন লিপিবদ্ধ। পরিবেশ বিপর্যয় ও নানামুখী কারণে এ প্রজাতির কচ্ছপ বিলুপ্তপ্রায়।

পৃথিবীতে কেবল উপকুলীয় অঞ্চল বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারেই বসতি ছিল বাটাগুর বাসকার(স্থানীয় নাম শালগম, সাদামুখী কাইঠ্ঠা, মান্দারী কচ্ছপ)। কিন্তু । আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন(আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ) এদের মহাসংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান দিয়েছে। এ প্রজাতির কচ্ছপ গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অভ্যন্তরে অত্যন্ত নিবিড় পরিবেশে গত সোমবার দুটি বাসা থেকে মোট ৩৭টি ডিম পাওয়া গেছে।ওই দুটি বাসার একটিতে ১৫টি ও অপরটিতে ২২টি ডিম পাওয়া যায়।  ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রকল্পে মোট ৪টি নারী ও ৩টি পুরুষ বাটাগুর বাসকা রয়েছে। 

অষ্ট্রিয়ার জুভিয়ানার অর্থায়নে, টার্টাল সারভাইভাল অ্যালয়েন্সের প্রযুক্তিগত সহায়তায় গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে নিবিড় অঞ্চলে এই প্রজাতিকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে চলছে 'প্রজেক্ট বাটাগুর বাসকা' নামের একটি প্রকল্প। এখানেই চলছে প্রজনণ ও গবেষণা কার্যক্রম। এতে সহযোগী হিসাবে কাজ করছে বাংলাদেশের বন বিভাগ এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।

প্রজেক্ট বাটাগুর বাসকার গবেষক ও স্টেশন ব্যবস্থাপক এ জি জে মোরশেদ জানান, প্রাণীগুলোকে প্রকৃতিতে ফেরাতে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হিসাবে 'প্রজেক্ট বাটাগুর ২০১০' সাল থেকে কাজ করছে। কেবল বাংলাদেশেই এ ধরনের গবেষণা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানে পুকুড় পারে বালি দিয়ে তৈরি বিশেষ একটি স্থানে ক্যামেরা ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বালি সরিয়ে ডিম খুঁজতে ব্যস্ত স্টেশন ব্যবস্থাপক এ জি জে মোরশেদ ও তার সহকারী হাসান। রোববার রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাটাগুর বাসকার পায়ে ছাপের চিহ্ন মুছে গেছে। তাই বিশেষ নাইট ভিশন ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ডিম পাড়ার সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করে সেখানে অনুসন্ধান চালান তারা। পরে দুইটি স্থানে ডিমের অস্তিত্ব মিলে। একে একে বালির ভেতর থেকে বের করে আনা হয় ৩৭টি সাদা ধবধবে ডিম। পরে এগুলো অন্য একটি পুকুড় পাড়ে নিয়ে বিশেষ বাক্সে ভরে আবার মাটিতে পুতে রাখা হয়। বাক্সে দেওয়া হয় তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের সংযোগ ও ডাটা লগার।

এ জি জে মোরশেদ আরও জানান, এই প্রজাতির নারী কচ্ছপ পৃথিবীতে আছে মাত্র ১৬টি। সম্প্রতি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান থেকে ৪টি ফিমেল বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ সুন্দরবনের করমজলে একই প্রজেক্টের আওতায় অপর গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ২০১৭ সাল থেকে প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত সেখান থেকে ৫৮টি বাচ্চা পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে কোনটি নারী বা কোনটি পুরুষ তা সনাক্ত করতে ১৫ বছর সময় লাগবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকৃতিতে মহাসংকটাপন্ন বাটাগুর বাসকা জাতের কচ্ছপকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হিসাবে 'প্রজেক্ট বাটাগুর' ২০১০ সাল থেকে কাজ করে আসছে। এটি দেখভাল করছেন প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী ড. পিটার প্রাসাগ। ২০১৬ সালে ২টি কচ্ছপের পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে এদের আচরণ ও চলাচলের গতিপথ পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণে তখন এই পদ্ধতিটি ততটা সফল হয়নি। এ বছর আবারও ৫টি কচ্ছপের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হবে। এ ছাড়া ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে থাকা কচ্ছপগুলোর প্রত্যেকটিকে আলাদাভাবে সনাক্ত করতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। জন্মের কিছু দিন পর এদের শরীরে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বসানো হয়। পরে বিভিন্ন প্রয়োজনে ট্যাগ রিডার দিয়ে এদের সনাক্ত করা হয়। গবেষণা কেন্দ্রে থাকা কচ্ছপগুলোর ডিম দেওয়া ও আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।

পরিচর্যাকারী হাসান জানান, পরম যতেœ এ কচ্ছপগুলোকে দেখাশুনা করি । নিয়ম করে খাবার দেই। প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হওয়া এ কচ্ছপ আবারো প্রকৃতিতে ফিরতে এ মহাআনন্দের খবর। এ কাজে নিজেকে জড়িয়েও আনন্দ পেয়েছি।

গবেষকরা জানান, এ প্রজাতির ডিমগুলো ২৭-২৯ডিগ্রী পর্যন্ত তাপমাত্রার মধ্যে থাকলে তা থেকে পুরুষ বাচ্চার জন্ম হয়। ২৯-৩৩ ডিগ্রীর মধ্যে থাকলে তা থেকে নারী বাচ্চার জন্ম হয়ে থাকে। বছরে সেপ্টেম্বর মাসে বাটাগুর বাসকা প্রজাতির প্রজণন ঘটে। মার্চ-এপ্রিলে ডিম দেয়। প্রজননের আগে পুরুষ কচ্ছপের শরীরে এক দৃষ্টিনন্দন পরিবর্তন ঘটে। প্রজননের সময়কালে এদের শরীরের নরম অংশ গোলাপি রঙ ধারণ করে। এ প্রজাতির কচ্ছপগুলোর মধ্যে নারীদের দেহের আকার পুরুষের আকারের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এরা মূলত তৃণভোজী, তবে গবেষণা কেন্দ্রে এদের শাকসবজির পাশাপাশি তাজা চিংড়ি, শুকনা চিংড়ি, ছোট শামুক দেওয়া হয়। সবজির মধ্যে এরা মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, কচু শাক ও বাঁধাকপি খায়। তবে কলমি শাক এদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার।

বন বিভাগে ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টারের সরীসৃপবিদ সোহেল রানা বলেন, মহাসংকটাপন্ন বাটাগুর বাসকা (কচ্ছপ) এই প্রকল্পের মাধ্যমে আশার আলো দেখাচেছ। পৃথিবীতে এই প্রজাতির নারী কচ্ছপ আছে মাত্র ১৬টি। এর মধ্যে বাংলাদেশেই ৮টি আছে। এটি আমাদের গর্ব।

বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির বলেন, প্রকল্পটি এখনও পর্যন্ত খুব ভালো কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশানুরূপ প্রজনন (বাচ্চা) পাচ্ছি। আশা করি প্রকৃতিতে মহাসংকটাপন্ন বাটাগুর বাসকা আবারও ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads