• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে নতুন কৌশলে সরকার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে নতুন কৌশলে সরকার

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনের পর রোহিঙ্গাদের ঘিরে সৃষ্ট সঙ্কট সমাধানে নতুন কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব পেলেও রোহিঙ্গা সঙ্কটকে নতুন সরকারের ‘পুরনো’ চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বিশ্বের পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কৌশলগত গুরুত্ব তৈরির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে নানা দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক কূটনীতি চালিয়ে যাবে সরকার। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতিশ্রুতি না রাখা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের মিথ্যা আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও নতুন কৌশলের দিকে হাঁটছে। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে সরকার।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা যে ফেরত যেতে ভয় পাচ্ছে, এ বিষয়টিও সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরবে। সরকার চায়, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপে আন্তরিক হোক। এসব কৌশলের পুরোপুরি বাস্তবায়ন শিগগিরই দেখা যাবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের মিথ্যা আশ্বাস ও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার জোরালোভাবে তুলে ধরবে। চুক্তি করেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না করে পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলোও বিশ্বকে জানানো হবে। মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মূল্য দিতে হচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও তুলে ধরা হবে। এর মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক প্রশ্নও তোলেন, ‘তাহলে প্রতিবেশী দেশের রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এখন কি বাংলাদেশকে তার মূল্য দিতে হচ্ছে?’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জোরাল উদ্যোগ নেওয়ার আগেই চিরবৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চোখ তখন দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের চেয়ে ভারত ও পাকিস্তানের ‘যুদ্ধাবস্থার’ দিকে বেশি চলে যায়। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠে ওই দুই দেশের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ থামিয়ে শান্তি আলোচনার বিষয়ে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন কৌশলে পুরো উদ্যমে কাজ করছে সরকার।

সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে করতে চাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে ভাসানচর দ্বীপের প্রায় ১৩ হাজার একর জমির অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে নৌবাহিনী, যার মধ্য দিয়ে সেখানে ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানি, পয়ঃব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পানি নিষ্কাশন, পুকুর খনন, স্কুল ও মসজিদ নির্মাণ, অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন, সাইক্লোন শেল্টার স্টেশন, দুটি হেলিপ্যাড নির্মাণসহ পুরো দ্বীপটিকে শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

কক্সবাজারের শিবির থেকে সরিয়ে রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকারের নেওয়া উদ্যোগকে শেষ পর্যন্ত স্বাগতও জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। তবে সংস্থাটি বলছে, জোর করে রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো যাবে না। স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে চাইলে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আপত্তি থাকবে না জাতিসংঘের। কক্সবাজারের শিবির পরিদর্শন শেষে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন ইউএনএইচসিআরের সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার ভলকার টার্ক।

অন্যদিকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে বলে গণমাধ্যমকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ২৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে ওই চরে পাঠানো হবে। ২৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের প্রায় এক লাখ সদস্যকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। ইতোমধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য অবকাঠামোগত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎ, ঘর, সাইক্লোন শেল্টার ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়েছে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষে আর কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করা সম্ভব নয়, দেশের পক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইতোমধ্যে এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের রাখাইনে একটি ‘সেফ জোন’ গড়ে তুলতে কাজ করবে সরকার। ‘সেফ জোনে’ রোহিঙ্গাদের দেখভালে ভারত, চীন ও আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে রাখার কথা বাংলাদেশের প্রস্তাবে তুলে ধরা হবে। ওই রাষ্ট্রগুলো ও জোটের প্রতি মিয়ানমার সরকারের আস্থা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘সেফ জোনের’ প্রস্তাবটি আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতার মধ্য দিয়ে দেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নতুন করে আবার ওই প্রস্তাব দেওয়া হবে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দেন। চরম নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে তার সরকার যুক্তিসঙ্গতভাবে ও শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা এবং আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালায়।

শেখ হাসিনার সরকার মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের সুযোগও খোলা রাখে সরকার। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি সইয়ের পরও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads