• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
জীবন বদলের ভয়ঙ্কর যাত্রা ভূমধ্যসাগরে

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

জীবন বদলের ভয়ঙ্কর যাত্রা ভূমধ্যসাগরে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৬ মে ২০১৯

অবৈধ পন্থায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের মানুষ। বিপজ্জনক এই যাত্রায় নৌকাডুবিসহ নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অনেকেই। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের সঠিক পরিসংখ্যান কখনো প্রকাশ পায় না। দুর্ঘটনার কবলে পড়া নৌকার কোনো আরোহী জীবিত উদ্ধার না হলে ওই দুর্ঘটনার খবরই জানা যায় না। অনেকেই মনে করেন এমনটা নেহাত কম নয়।

প্রায় ছয় মাস আগে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেন সিলেটের বিলাল। নানা দেশ ঘুরে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে যাত্রাবিরতি করেন তিনি। তিন মাস সেখানে একটি কক্ষে আটক থাকার পর একটি নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ডুবে যায় তাদের নৌকা। মারা যান অন্তত ৩৭ বাংলাদেশিসহ ৭০ জন। বহু মানুষকে ডুবতে দেখা বিলাল উদ্ধার হন তিউনিস নৌবাহিনীর সহায়তায়। এ গল্প অনেকটা মিলে যায় প্রায় সব বাংলাদেশির ক্ষেত্রে। যারা উচ্চ স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে ভয়ঙ্কর ভূমধ্যসাগরের কবলে পড়েন।

সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশের সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি : জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, গত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৯০৬ জন। নিখোঁজ হয়েছেন ১২ হাজারের বেশি মানুষ। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ৬৩৬ জন, ২০১৪ সালে ৭৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৫৫৫ জন, ২০১৬ সালে ১৪৮৫ জন, ২০১৭ সালে ৭৯৫ জন, ২০১৮ সালে ৬৭৭ জনসহ এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১২ হাজার ৫৩৯ জন। সংস্থাটি দিচ্ছে মজার কিংবা কষ্টের তথ্য, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।

এদিকে ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যানবিষয়ক দফতর ইউরোস্ট্যাট বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১৭ হাজার ২১৫ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে ১১ হাজার ৭১৫টি আবেদন বাতিল করা হয়। ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইতালিতে প্রবেশের হার দিন দিন বাড়ছে।

জানা যায়, অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাতটি রুট ব্যবহার করা হয়। এর সবগুলোই লিবিয়া কিংবা তুরস্ক থেকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা হয়। এ সাত রুটের মধ্যে জনপ্রিয় কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুট। এটি ব্যবহার করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়া নিরাপদ

 মনে করে অনিয়মিত অভিবাসীরা। তাই দালালের কথায় প্রভাবিত হয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলে যান লিবিয়া কিংবা তুরস্ক। সেখান থেকে শুরু হয় ইউরোপ যাওয়ার মূল পর্ব।

যেভাবে ইউরোপ প্রবেশ : জুনের শেষ থেকে আগস্ট- এই তিন মাস সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ এ সময় সাগর কিছুটা শান্ত থাকে এবং ছোট ছোট নৌযান নিয়েই ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করে সবাই। লিবিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে ইতালির ল্যাম্পুসা দ্বীপ। সেখান দিয়েই মূলত ইতালি প্রবেশ করে অনিয়মিত অভিবাসীরা। এছাড়া গ্রিস, স্পেন হয়েও ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে অভিবাসীদের ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার হার কিছুটা হলেও কমেছে। কারণ, লিবিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীও অভিবাসী অনুপ্রবেশের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। ফলে মাঝ সমুদ্রে কোনো শরণার্থীর নৌকা নজরে এলেই সেটিকে আটক করার নির্দেশ পায় লিবিয়ার বাহিনী। তারপরও থেমে নেই এই পথে ইউরোপ যাওয়া।

নির্মম অভিবাসী হওয়ার গল্প : সাভারের অন্তর আলী আবাদি জমি, তিনটি গরু, স্ত্রীর গয়না বেচে সব টাকা দালালের হাতে তুলে দেন ইউরোপ যাওয়ার আশায়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশে প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইরাকে। এরপর তুরস্ক, সেখান থেকে গ্রিস। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো ছোট নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, আবার কখনো বা ছোট্ট একটা কনটেইনারের ভেতর ঢুকে যেতে হয়েছে। ইরাকে পর্যটক ভিসা নিয়ে গিয়ে এক মাসের বেশি থাকার সমস্যা হলেও দালাল তাকে বলেছিলেন, ‘কোনো সমস্যা হবে না।’

অন্তর আলী বলে যান ভয়ার্ত গল্প, ‘যাওয়ার পথটা ছিল ভয়াবহ। প্রথম দিন দুবাই থেকে ইরাকের উদ্দেশে রওনা হই। আট ঘণ্টা থাকার পর দালাল নিয়ে যায়। সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে নাজাফ থেকে বাগদাদ যেতে। তিনি বলেন, বাগদাদে এক রাত থেকে কিরকুকে নিয়ে গেল। সেখানে ছিলাম চার দিন। রাতের বেলায় কুর্দিস্তান নিয়ে যায়। সেখানে একটা কারখানায় লেবারের কাজ করি কয়েকদিন। পরে সেখান থেকে তুরস্কের উদ্দেশে আবার রওনা হতে হয়। তিনি আরো বলেন, রাতের বেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে হাঁটতে হতো। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের চামড়া উঠে গেছে, হাত-পা কেটে রক্ত বের হয়ে যেত। তিনি বলে যান, এরপর এক গাড়িতে করে সাত ঘণ্টা ধরে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেল, সেখানে তিন দিন ছিলাম। এই কয়দিনে দিনে-রাতে একবেলা খাওয়া পেতাম, সেটাও ছিল শুকনা একটা অথবা দুইটা রুটি। ভয়ে একেকজন কুঁকড়ে যেতাম। সেখান থেকেই গ্রিসের পথে রওনা হলাম। রাতের বেলায় নৌকায় করে নদী পার হয়ে আবার আরেক জঙ্গল। সেই নদী পার হতে নেয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। যে নৌকায় ১০ থেকে ১৫ জন ধরার কথা সেখানে ওঠাল ৩০ জন। সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের লোকেরাও ছিল। ইরাক পর্যন্ত যেতে নিয়েছে চার লাখ ৪৮ হাজার টাকা। একেকটা জায়গা পার করেছে আর টাকা নিয়েছে। এভাবে মোট ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে দালালকে।

কষ্টের বাকি আছে আরো কিছু। গ্রিসে যাওয়ার পর ছয় মাসের বেশি থাকতে পারেননি অন্তর আলী। ইউরোপজুড়ে ঘোষণা এল কাগজপত্র ছাড়া যেসব বাঙালি আছে তাদের ধরা হবে। এর আগে তাকে দেওয়া কার্ড রিনিউ করতে গেলে ধরা পড়ে যান তিনি। সেই অফিস তাকে পুলিশে দেয়। এরপর থানায় ১৫ দিন আর জেলে দুই মাস ছিলেন অন্তর আলী। জেলে গিয়ে জানতে পারেন এরপরও যদি সেখানে থাকতে চান তাহলে জেল হবে এক বছরের। তারপরও কোনো নিশ্চয়তা নেই থাকার। গত বছর তিনি দেশে ফিরে আসেন।

কাগজপত্রবিহীন বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে : গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে ইউরোপের পরিস্থিতি। এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয় ইউরোপ। কাগজপত্রহীন মানুষদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক না থাকা বাংলাদেশিদের ফেরত আনতে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এর আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে।

অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শ্রম অভিবাসনের নামে মানব পাচার প্রতিরোধে সুদান, লিবিয়া ও মিশরে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে ভিসা যাচাই-বাছাইয়ে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া আছে। এছাড়া ভিজিট ভিসার নামে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য থেকে যাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

সামগ্রিক বিষয়ে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। সচেতন থাকলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কম।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হওয়ার কারণ দুটি বলে মনে করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, বৈশ্বিক এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতির কারণে থামছে না ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়া। এ মুহূর্তে লিবিয়াতে অস্থিতিশীলতার সুযোগে বহু মানব পাচারকারী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। অস্থিতিশীলতার কারণে অরক্ষিত হয়ে আছে লিবিয়ার সীমান্তগুলো। সে কারণে আন্তর্জাতিক মানব পাচারচক্র ইউরোপে ঢোকার জন্য এই জায়গা ব্যবহার করছে।

শরিফুল হাসান বলেন, ইতালিতে প্রবেশ করা মানে হচ্ছে ইউরোপের ২৬টি দেশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া। প্রত্যেকেই চিন্তা করে হয়তো বেঁচে যাব। বাংলাদেশিদের এই যে একটা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা— যে কোনো মূল্যে বিদেশ চলে যাব; এটা যদি ভাঙা না যায় তাহলে বন্ধ করা সম্ভব না। তিনি মত দেন, ইউরোপ আগের অবস্থায় নেই। অবৈধভাবে গেলে কাজ পাওয়া যায় না। তাই এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছানো উচিত যে কাগজপত্র ছাড়া ইউরোপে গেলে হয় জেলে যেতে হবে নতুবা ফেরত আসতে হবে।

শরিফুল হাসানের কথার সত্যতা মেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার কথায়। তিনি বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যান্ডার্ড অব প্রসিডিওর (এসওপি) স্বাক্ষর করেছি। গত ১৮ মাসে ইউরোপ থেকে ১৮৫ অবৈধ বাংলাদেশি এর অধীনে ফেরত এসেছে। আমাদের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত ভালো কাজ করছে। কারণ, এই চুক্তির আগে বলা হতো, হাজার হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে অবৈধভাবে বাস করছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অবৈধদের লিস্ট এখন পর্যন্ত আমাদের দেওয়া হয়নি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা তাদের বলেছি, অবৈধদের আমরা ফেরত নিয়ে আসব এবং তারা আমাদের যে লিস্ট দিয়েছে, তার মধ্যে ২০০ জনেরও কম ফেরত এসেছে। এর ফলে আমাদের ওপর যে চাপ ছিল, সেটি অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। কারণ, কতজন বাংলাদেশি ইউরোপে অনিয়মিতভাবে আছে, এর প্রকৃত সংখ্যা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো এখনো আমাদের দেয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads