• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
মিজান-মোয়াজ্জেমে নীরব পুলিশ

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

মিজান-মোয়াজ্জেমে নীরব পুলিশ

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৫ জুন ২০১৯

চট্টগ্রামে ঘটে যায় চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যার ঘটনা। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে মিতুর স্বামী তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও আজ অবধি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কোনো ব্যাখ্যা নেই ওসি মোয়াজ্জেম এবং বিতর্কিত ডিআইজি মিজানের ব্যাপারেও। ফলে এসব বিষয় নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় রয়ে গেছে।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর এই পুলিশ বাহিনীই নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশ থেকে দ্রুত জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করেছে। সেই সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থাও অনেকটা বেড়েছে পুলিশ বাহিনীর প্রতি। স্বাধীনতাযুদ্ধেও আছে পুলিশ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ অবদান। এরপর নানা চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে পুলিশ বাহিনী ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার যখন ঘটছিল ঠিক তখনই এক ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেমের কর্মকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে স্ত্রী হত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে যে হইচই শুরু হয়েছিল। তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি কম ক্ষুণ্ন হয়নি। সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে, অন্যান্য আসামির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাবুলের সোর্স মুসা পরিকল্পিতভাবে মিতুকে হত্যা করে। পুলিশের দাবি, মুসাকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। অথচ মুসার স্ত্রীর দাবি, মুসাকে পুলিশ তার সামনে থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ মূল সাক্ষী গায়েব। আর বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। বিষয় পরিষ্কার হতে আরো কিছু লাগে কি? কিন্তু এসব প্রশ্নে পুলিশ সদর দপ্তর ঠুঁটো জগন্নাথ। একের পর এক ঘটনা সংঘটিত হলেও পুলিশ সদর দপ্তর বরাবরই নিশ্চুপ থেকেছে। দপ্তরের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সঙ্গত কারণেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোনো কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের কেন এই রহস্যজনক নীরবতা। এসব অপরাধী ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুলিশ বাহিনী হচ্ছে একটি ডিসিপ্লিন ফোর্স। তারা নিজেরাই যদি অপরাধকর্মে জড়ায় এবং অথরিটি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তো সন্দেহ-সংশয় এবং নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হবেই। শুধু তাই নয়, যেসব কর্মকর্তা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ভূমিকা রাখছেন তারা নিরুৎসাহিত হবেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সুপার থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাকে পুরস্কার হিসেবে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। গত বছর মরিয়ম আক্তার ইকো নামে এক নারীর সঙ্গে প্রতারণা ও হুমকি এবং একজন সংবাদপাঠিকাকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ার অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত তদন্ত কমিটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও তাকে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করার নামে এপিবিএনে পদায়ন করা হয়। সম্প্রতি দুদক কর্মকর্তা বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার কথা নিজেই অডিও রেকর্ডে প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নিশ্চয়ই তিনি নিজের অপরাধ আড়াল করতে ঘুষ দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। তবে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেননি তিনি।

নুসরাত হত্যার ঘটনাটি সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। দায়িত্বে অবহেলা ছাড়াও ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তির আইনের মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি করেছেন আদালত। এই পরোয়ানা নিয়ে ‘পিংপং’ খেলছে পুলিশ। ঘটনার এক মাস পেরোলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি পলাতক আসামি ওসি মোয়াজ্জেমকে। এটাকে হাস্যকর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, পলাতক আসামি মোয়াজ্জেমের ব্যাপারে পুলিশ সম্ভবত সোর্স নিয়োগ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ সোর্স নিয়োগ করতে ‘মানি’ লাগে। আর এই সোর্স মানি যারা সোর্স নিয়োগ করবেন তাদের কাছে পৌঁছে না। এএসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, এসপি, অ্যাডিশনাল ডিআইজি এবং অ্যাডিশনাল আইজিপিরা ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলেন বলে অভিযোগ আছে।

মন্দ পুলিশের পাশাপাশি অনেক ভালো কর্মকর্তাও রয়েছেন। এসব কর্মকর্তা একটু সচেতন ও উদ্যোগী হলেই পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু এসব ভালো ও সৎ কর্মকর্তা চাকরির খাতিরে চাকরি করে থাকেন। জনগণের সঙ্গে তাদের তেমন একটা যোগসূত্র নেই। এটাই পুলিশের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে এক ডিআইজি মিজান ও ওসি মোয়াজ্জেমের অপকর্মের দায়ভার সমগ্র পুলিশ বাহিনী নেবে না। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর যত সত্বর অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন ততই মঙ্গল। তা না হলে জনমনে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান থাকবে। আর এতে পুলিশ যতই বলুক ‘জনতাই পুলিশ পুলিশই জনতা’, ‘পুলিশ-জনগণ বন্ধু’ এসব আপ্তবাক্য বস্তাপচা বুলিতে পরিণত হবে। আর পুলিশ হারাবে জনগণের আস্থা। ডায়ালগ এক রকম আর কর্ম আরেক রকম সেই দিন অনেকটা শেষ হয়ে এসেছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দেশের মানুষও অনেক সচেতন। পুলিশ নিজেদের বাহিনীর অপরাধী সদস্যের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করলে বা সময়মতো প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা না নিলে মানুষ আর কিছু না করতে পারলেও মনে রাখতে পারে এবং সেটা সময়মতো ফিরিয়েও দেয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads