• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
পলিতে বদলে যাচ্ছে নদীর গতি, কার্যকারিতা হারাচ্ছে সেচ প্রকল্প

পলি জমে প্রকল্পের গেটে ৭৫ শতাংশ অংশ ভরাট হয়ে গেছে

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

ফেনী নদীর মুহুরী সেচ প্রকল্প

পলিতে বদলে যাচ্ছে নদীর গতি, কার্যকারিতা হারাচ্ছে সেচ প্রকল্প

  • প্রকাশিত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

ইকবাল হোসেন জীবন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)

চট্টগ্রাম ও ফেনী সীমান্তবর্তী এলাকার ফেনী নদীতে বাস্তবায়ন হওয়া মুহুরী সেচ প্রকল্প কার্যকারিতা হারাচ্ছে। নদীর ভাটি এলাকায় জমে ওঠা পলির স্তরের কারণে স্বাভাবিক গতি বদলে যাচ্ছে। ভাঙ্গণের কবলে পড়েছে এখানকার সিডিএসপি বাঁধ, বিস্তৃন্য এলাকা ও শত শত মৎস্য ঘের। এতে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পটি ভেস্তে যেতে বসেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন বলছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে এখানে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে। পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষ হারাবে ভিটেবাড়ি, কৃষক হারাবে জমি, নদী গর্ভে বিলীন হবে শত শত মৎস্য ঘের। ব্যাহত হবে এ এলাকায় বাস্তবায়ন হতে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের উন্নয়ন কাজ।

কার্যকারিতা হারাবে সেচ প্রকল্প:

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের ভাটিতে প্রায় ৭০০ বর্গ মিটার এলাকা পলি জমে ৭৫ ভাগ ভরাট হয়ে গেছে । এতে নদীর পানি প্রবাহের পথ বদলে একদিকে ছোট ছোট চর জেগে উঠছে অন্যদিকে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আবার সেচ প্রকল্পের বেশ কিছু স্লুইজ গেট ইতোমধ্যে পলি জমার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছে।

মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা দুখু মিয়া জানান, ২০১৯ সালের শুকনো মৌসুমে প্রকল্পের মুখে বালি ও মাটি জমাট শুরু হয়। ওই বছর বর্ষা শুরু হলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। যা গত ৩৫ বছরেও এখানকার মানুষ দেখেনি। ইতোমধ্যে শতাধিক মৎস্য ঘের নদীতে বিলিন হয়ে গেছে।

এদিকে প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় মিরসরাই, ফেনী ও সোনাগাজী উপজেলার ২৭.১২৫ হেক্টর জমি ইরি চাষের আওতায় আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভরা বর্ষা শুরু হওয়ার আগে নদীতে পলি জমা এলাকা জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজিং করা না হলে একদিকে নদীর উজান এলাকার গ্রামের পর গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে অপরদিকে এখানকার জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকবে।

মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমরা নদীর আচরণ বুঝি। জমা হওয়া বালু মাটি খনন করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। গত ৩৫ বছর এখানে আমরা ভাঙ্গন দেখিনি। এখন বালু জমার কারণে ভাঙ্গন হচ্ছে।’

সিডিএসপি বাঁধ ভাঙ্গলে বিপর্যয়:

মিরসরাইয়ের বিস্তৃন্য জনপদকে বঙ্গোপসাগরের ভাঙ্গণ থেকে রক্ষা করতে ১৯৯৪ সালে চর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট প্রকল্পের (সিডিএসপি) আওতায় বাস্তবায়ন করা হয় ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধ। এ বাঁধের কারণে এখানকার বাঁশখালী ও ইছাখালী এলাকায় গড়ে ওঠে হাজার হাজার একর মৎস্য ঘের। যা থেকে চট্টগ্রামের মৎস্য খাদ্য চাহিদার ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয়।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের আগষ্ট মাসে সিডিএসপি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ওইসময় ভেঙ্গে যাওয়া অংশ নদীর গতি প্রকৃতি বুঝে অন্য দিক দিয়ে ঘুরিয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

এদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে সিডিএসপি বাঁধের পশ্চিম পাশে সুরক্ষা ব্লক না বসালে চলতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙ্গে বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিবে।
সরেজমিন সিডিএসপি বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের উত্তর অংশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ফেনী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বাকি অংশটুকু বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগর অববাহিকায়।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় নদী ও সাগর থেকে বাঁধের দূরত্ব ছিল প্রায় ৭০০ মিটার। বর্তমানে কোথায় ১০মিটার আবার কোথাও ৫০ মিটার দূরত্ব রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের বর্ষা মৌসুমে গুরুত্বপূর্ণ এ বাঁধ ভয়াবহ ভাঙ্গনের মুখে পড়বে।

দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় ভাঙ্গন রোধে সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরক্ষার জন্য সিসি ব্লক বসালেও বর্তমানে তা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সিডিএসপি বাঁধের ভাঙ্গন প্রসঙ্গে মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এলাকার লোকজন থেকে জেনে এটি আমি সরেজমিন গিয়ে দেখেছি। সেখানে ভয়ংকর অবস্থা। যে কোন সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে আমরা মাননীয় পানি সম্পদ মন্ত্রী ও সচিব বরাবরে ই-মেইলে একটি চিঠি দিয়েছি।’

ব্যাহত হবে শিল্পনগর উন্নয়ন:

মিরসরাইয়ের বঙ্গোপসাগর উপকূলে জেগে ওঠা ৩০ হাজার একর ভূমিতে দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যার উত্তরাংশের পুরোটাজুড়ে প্রতিরক্ষার কাজ করছে এখানকার সিডিএসপি বাঁধ। এটির ভাঙ্গণ দেখা দিলে শিল্প নগরের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হবে এমন আশঙ্কা করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘খুব সহসা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিবে। এখানকার জনবসতি, মৎস্য প্রকল্প ও বাস্তবায়নাধীন বিশেষ অর্থণৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ ক্ষতির মুখে পড়বে।’

মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ভাঙ্গণের বিষয়টি নিয়ে আমি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সাথেও কথা বলেছি। তারা এ ধরণের প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। পরে আমি বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করেছি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীকে ফোন দিলে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। পরে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর মিরসরাই অঞ্চলের প্রকল্প কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদকে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পাউবোর বক্তব্য:

এসব বিষয়ে কথা বলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহির উদ্দিনকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুন নবী জানান, নদীর ভাটি এলাকায় জমে থাকা পলি ড্রেজিং এর জন্যে আমরা আরো আগে উদ্যোগ নিয়েছি। এ বিষয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব বন্ধ না থাকলে এটির কার্যক্রম আরো এগিয়ে যেতো।

প্রকল্পের আদ্যোপান্ত:

ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস নদীর সম্মিলিত পানি প্রবাহকে সেচ কাজে লাগাতে এবং ফেনী, সোনাগাজী ও মিরসরাই এলাকার বিস্তৃন্য জনপদকে বন্যা ও ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে বাস্তবায়ন করা হয় মুহুরী সেচ প্রকল্প। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে এটির পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হয়। ৪০টি স্লুইজগেট বিশিষ্ট এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয় ১৬৮ কোটি টাকা। যার অর্থায়ন করে সিডা, ইইসি ও বিশ্বব্যাংক।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads