• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ‘বাধা’ এনজিও-বিদেশিরা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে ‘বাধা’ এনজিও-বিদেশিরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০২০

এ বছরেই লাখখানেক রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করার কথা ছিল। যদিও শরণার্থীদের ঘিরে সক্রিয় থাকা এনজিওদের নানামুখী বাধা এবং বিদেশিদের চাপের কারণে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এ কথা জানিয়েছন।

সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহসা আলোর মুখ দেখছে না ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর। করোনা মহামারীর শুরুর দিকে সাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠানো হয়। তারা এখনো সেখানেই আছেন এবং ভালো আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছিল সরকার। যদিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। সে কারণে সরকারের পক্ষে এখনো চূড়ান্ত অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

রাজশাহী কলেজে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। এনজিও এবং বিদেশি শক্তিদের চাপে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্রস্তুতিও চলছিল ভেতরে।  শুধু দিনক্ষণ ঠিক করাই বাকি ছিল। তবে বিভিন্ন চাপ থাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে সমস্যা তৈরি হয়েছে।

দাতাগাষ্ঠী ও এনজিওদের চাপের কারণে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে না যেতে পারার কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করাটাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য। তা ছাড়া কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হলে সেসব রোহিঙ্গার অর্থায়ন যদি দাতা গোষ্ঠী না দেয় সেক্ষেত্রে তাদের চালানোর জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে সেটা সরকারের জন্য বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। এমনিতেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় তাদের নিয়ে সামনের দিনগুলো অন্ধকার দেখছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া চলতি বছর দাতাগোষ্ঠীদের তহবিলেও দেখা দিয়েছে সংকট।

জানা যায়, চলতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য যে পরিমাণ তহবিলের আশা করা হচ্ছিল করোনা মহামারীর মধ্যে ১০ মাসের বেশি সময়ে এসেছে তার মাত্র ৫৪ শতাংশ। অথচ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের তিন বছর প্রত্যাশিত তহবিলের প্রায় ৭২ শতাংশের বেশি পাওয়া গিয়েছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই। কিন্তু বিদেশি সংস্থা ও জাতিসংঘের কিছু কিছু সংস্থা এবং বিদেশি দাতারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে বাধা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হিসেবে তারা বলছেন, যেভাবেই হোক সব চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে হবে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে গত সেপ্টেম্বরে সরকার ‘গো অ্যান্ড সি’ প্রকল্পের অধীনে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে চার দিনের সফরে ভাসানচর দেখাতে নিয়ে যায়। ভাসানচরে পরিদর্শন করা সেসব রোহিঙ্গা নেতা জানান, তাদের ভাসানচরের সুবিধাদি দেখে ভালো লেগেছে। কিন্তু ফিরে এসে নানা মহল থেকে হুমকি পাওয়াসহ বিভিন্ন এনজিও তাদের নিরুৎসাহিত করছে বলে এ নিয়ে উভয় সংকট দেখছেন তারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সরকার সেখানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, সেখানে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং সুন্দর পরিবেশ করা হয়েছে যেন তারা সেখানে গিয়ে ভালোভাবে থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, বিদেশি স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের কিছু কিছু সংস্থা এবং বিদেশি দাতারা আপত্তি করছে। তাদের যুক্তিটা হলো বন্যাপীড়িত-ঝড়পীড়িত এলাকা; ফলে ওখানে রোহিঙ্গারা নিরাপদ নয়। কিন্তু এই যুক্তিটা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সেখানে বন্যা ও ঝড় প্রতিরোধ করবার জন্য সরকার যথেষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।’ ‘আসলে এনজিও কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের নামে প্রচুর টাকা-পয়সা আনেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, তাদের স্বার্থটা ব্যক্তিগত। তাদের স্বার্থ রোহিঙ্গাদের পক্ষে নয়। অথচ সরকার কিন্তু ভাসানচরে তাদের থাকার অবকাঠামো তৈরি করেছে’, যোগ করেন এই অধ্যাপক।

সরকারকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে সব ধরনের চাপ উপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপক বলেন, ‘সরকারের একটাই সমস্যা বিদেশিদের বুঝিয়ে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিতে পারছে না। সরকারকে যেভাবেই হোক সব চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজন হলে আরো এরকম অবকাঠামো বিদেশি দাতাদের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন চর অঞ্চলে করে এদের নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে কক্সবাজার এক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং এখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে। দেখা যাবে এক সময় এটা জঙ্গিদের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে।’

এদিকে গত ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর দুদিনের সফরে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। সেই প্রতিনিধিদলে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজে তিরিঙ্ক ভাসানচরে সরকারের ‘গো অ্যান্ড সি’ প্রকল্পের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া একটি ভালো উদ্যোগ ছিল।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘আমরা চাই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক। সরকার তো চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে। তা ছাড়া ভাসানচের রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া নিয়েও সরকার চেষ্টা করছে, দেখা যাক কী হয়।’

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের সরে আসার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে যখন অবকাঠামো নির্মাণ পরিস্থিতি দেখতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপরই ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর থেকে সরকার আপাতত সরে আসছে বলে আলোচনার শুরু হয়।

পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এটা নিয়ে কথা বলেন। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সেখানে না যেতে চাইলে আমাদের দেশের অসহায় মানুষকে সেখানে রাখা হবে।’

রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে এই চরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার মিলিটারির নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আগে থেকে অবস্থান করছে চার লাখের মতো। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। পরপর দুবার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে পাঠানো যায়নি মিয়ানমারের কারণে।

সাত বছর পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা শহীদুল হক প্রথম থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) এই জ্যেষ্ঠ ফেলো রোহিঙ্গাদের ভাসানচের নেওয়াসহ প্রত্যাবাসন শুরু কীভাবে সমাধান আসতে পারে জানতে চাইলে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হলে ত্রিমুখী চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রথমত, আমাদের কাজ হবে প্রত্যাবাসনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। ভাসানচরে নেওয়ার ক্ষেত্রেও জোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সর্বোপরি দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads