• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বাংলাদেশের ধাত্রী ইন্দিরা গান্ধী

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৫ জানুয়ারি ২০২১

একাত্তর এক রক্তঝরা মহাকাব্য বাংলাদেশিদের জন্য। এ মহাকাব্য লেখা না হলে বিশ্বের বুকে জন্ম নিত না একটি সবুজ গালিচার দেশ। লাল যেন একাত্তরেরই রক্তক্ষরণের চিহ্ন। মুক্তির এ সংগ্রামে শুরু থেকেই বহির্বিশ্বের নাগরিকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলার মানুষের বন্ধু হন। তাদের কেউ কেউ মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যা, নির্যাতনের খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন কলম হাতে, ক্যামেরা হাতে, কবিতায়, কণ্ঠে গান তুলে।

বলা যায় আজকের লাল-সবুজ ভূখণ্ডটি পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হতে তাদের অবদানও কম নয়।

তাদেরই একজন ইন্দিরা গান্ধী, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাণের বন্ধু। বাংলাদেশে যখন নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা তখন অসংখ্য বাঙালি প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের ওপারে গিয়ে পেয়েছিলেন জীবনের নিরাপত্তা। ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে মানবিক বিপর্যয় দেখতে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় এক কোটি লোক জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আপন মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষকে খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে সর্বোচ্চ সহায়তা করেন।

একাত্তর সালের টালমাটাল সময়টা তিনি উতরে গিয়েছিলেন প্রচণ্ড সাহস, ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভাসন হলো, যার জন্ম-প্রক্রিয়ায় ইন্দিরার ভূমিকা ছিল ধাত্রীর। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তিনি।

এখন যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ, তা একসময় ভারতের পেটের মধ্যে ছিল। পরে তা ঢুকে যায় পাকিস্তানে। ভূরাজনৈতিক কারণেই ১৯৭১ সালে ভারত জড়িয়ে পড়ে, যা কি না ছিল পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ’ রাজনৈতিক সংকট।

ইন্দিরা ধরেই নিয়েছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে একটা যুদ্ধ হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব এপ্রিলের শুরুতেই ইন্দিরার কাছ থেকে অভিযানের নির্দেশ পেয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেকশ টেলিফোনে জেনারেল জ্যাকবকে আক্রমণ শুরু করতে বলেছিলেন। জ্যাকব মানেকশকে বলেছিলেন, ‘অসম্ভব।’ বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমি ছিল অভিযানের জন্য বড় বাধা। জেনারেলরা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, একটু অপেক্ষা করতেই হবে, ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। ইন্দিরা জেনারেলদের যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন।

ইন্দিরা অবশ্য বসে ছিলেন না, ২৭ মার্চ ভারতের রাজ্যসভায় ‘পূর্ববাংলার’ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে আগ্রহী, কেননা আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের যে মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, শ্রী মুজিবুর রহমানও তার পক্ষে। মানুষ তার পেছনে এবং এই মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, এটা দেখে আমরা অভিভূত। সম্মানিত সদস্যদের কাছে আবেদন, এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।’ ৩১ মার্চ ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে ‘পূর্ববাংলা সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব’ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘পূর্ববাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভ্যুত্থান সফল হবে। এই সভা আশা করে এবং নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে তাদের লড়াই ও ত্যাগ ভারতের জনগণের সর্বাত্মক সহানুভূতি ও সমর্থন পাবে।

এরপর থেকে ইন্দিরা নিরন্তর লড়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। একদিকে চলছিল সামরিক প্রস্তুতি, অন্যদিকে কূটনৈতিক যুদ্ধ।

আগস্ট মাসের ৬ তারিখ পাকিস্তানের জেলে বন্দি শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয় একটি সামরিক আদালতে। বিষয়টি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকার উভয়ের জন্যই ছিল উদ্বেগের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে ১১ আগস্ট ইন্দিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশের পক্ষে দূতিয়ালি করার জন্য ইন্দিরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি সম্মানজনক সমাধান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য তিনি বিশ্বনেতাদের কাছে দেনদরবার করেছেন। এ পর্যায়ে নভেম্বরে তার ওয়াশিংটন সফর ঠিক হয়। মার্কিন প্রশাসনের মনোভাবে অবশ্য কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। ইন্দিরা ও মুজিবের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অধ্যাপক হেনরি কিসিঞ্জারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। ৪ ও ৫ নভেম্বর নিক্সন-ইন্দিরা বৈঠক হয়। নিক্সনের মনোভাব ছিল শীতল। দ্বিতীয় দিন সকালের বৈঠকের আগে ইন্দিরাকে প্রায় ৪৫ মিনিট বসিয়ে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য ইন্দিরা এই উপেক্ষা ও অপমান নীরবে হজম করেছিলেন।

২৫ মার্চ মাঝরাতে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বটি ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে প্রচণ্ড গতি পায়। ৩ ডিসেম্বর খোলামেলাভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর সোমবার লোকসভায় একটি বিবৃতি দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জানান, বাংলাদেশকে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ইন্দিরা গান্ধী সুইডেনের একটি টেলিভিশনের কর্মীদের সঙ্গে ছিলেন। এমন সময় জেনারেল স্যাম মানেকশ তাকে টেলিফোনে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি দেন। ইন্দিরা দ্রুত চলে যান লোকসভায়। লিখিত বিবৃতিতে ইন্দিরা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী।

ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, ঐতিহ্যবাহী নেহরু পরিবারে ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। বাবা জওহরলাল নেহরু এবং মা কমলা দেবী। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ বছর ভারত শাসন করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ইন্দিরা গান্ধী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। রবিঠাকুরই তার নাম রাখেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কেবিনেটে তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভূত হন। ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতার সম্মাননা’ দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads