• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ জয়

মার্চে উন্নয়শীল দেশের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র পাচ্ছে

  • মোমেনা আক্তার পপি
  • প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারি ২০২১

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি। তার এ মন্তব্য বহু বছর আগেই আমরা ভুল প্রমাণ করেছি। স্বল্প আয়ের দেশের তকমাও অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছি। আমরা পৌঁছে গেছি উন্নয়শীল দেশের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্রের দ্বারপ্রান্তে। অবসান হতে চলছে দীর্ঘ ৪৩ বছর এলডিসির। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা পাচ্ছি এই ছাড়পত্র। 

গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে আমরা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি পদ্মা সেতু। কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। আমাদের মাথাপিছু আয় প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। এসবই হয়েছে গত এক যুগে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের শর্ত পূরণ করেছে এ সময়ে। এর মূল বার্তা হচ্ছে ভবিষ্যতে কারো দয়ায় বাংলাদেশকে আর চলতে হবে না। মাথাপিছু আয়সহ নানা শর্ত পূরণে সক্ষম হওয়ায় ২০১৮ সালের ২২ মার্চ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্যাপন হয় এই অর্জন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পৌঁছে গেছি আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র পাওয়ার কিনারে। আগামী ১৮ থেকে ২২ মার্চ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে উত্তরণের সুপারিশ বা ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ২০২৪ সালে শেষ হবে এর আনুষ্ঠানিকতা। এরপর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নত দেশে পরিণত হতে পথ চলা শুরু করব।

এর আগে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেয়। এর তিন বছর পর জাতিসংঘ কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক স্বীকৃতি বিশ্বের সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসে এক অনন্য নজির। এর মধ্যদিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আরেকবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি-এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি-ডিসি) পরিণত হতে তিনটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড সূচকের অন্তত দুটিতে নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়। সব দেশকেই উত্তরণের জন্য একটি নির্ধারিত সময় দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সময়সীমা ছিল ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত। যদিও নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালেই সব কটি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা সব সূচকেই সক্ষমতা নিয়ে এ মাইলফলক ছুঁয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশকে আগামী দিনের উন্নয়নে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার কারণেই এ দুর্লভ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা, রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, দীর্ঘ এক যুগ ধরে একটি গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সুফল পাচ্ছে দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী যত অর্জন রয়েছে, স্বল্পোন্নত থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীলে উত্তরণের ঘটনা তার সব মর্যাদা ও মাহাত্ম্য আত্মতৃপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলো বেরিয়ে আসবে এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। বাংলাদেশকে কারো দয়ায় চলতে হবে না। জোট-সংস্থা বা দাতাদের প্রণোদনার ওপরও নির্ভর করা যাবে না। চলমান অর্থনৈতিক কাঠামোকে পুঁজি করে আমাদেরকে নিজস্ব সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে।

এলডিসির অবসান হলে আন্তর্জাতিক বাজার, দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে পাওয়া অনেক সুযোগ-সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। সেগুলোকে চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণে আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। সময়াবদ্ধ রূপকল্প তৈরি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে এ উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য সুখকরই হবে।

যদিও এলডিসির অসানের কারণে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে রপ্তানি খাতে। যেসব বাজার বাংলাদেশকে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেয়, উত্তরণের পর তা আর থাকবে না। এর পর থেকে প্রতি ১০০ টাকায় রপ্তানিতে আগের চেয়ে সাড়ে সাত টাকা বেশি দিতে হবে। অর্থাৎ এ পরিমাণ আয় কম হবে। ফলে প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, রপ্তানি আয় ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে প্রতি বছর মোট রপ্তানি আয়ের দেড় থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ হারাতে পারে।  আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর স্বল্প সুদ, বিনা সুদের ঋণ ও অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর থেকে বাংলাদেশকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। উত্তরণের পর বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই প্রবৃদ্ধিতে পতন ঘটেছে। বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিট্যান্সের পতন ঘটে। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর একটা নতুন চাপ সৃষ্টি হয়। তবে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ছাড়পত্র পাওয়ার পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ। ওই সময় উত্তরণ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সমাপ্তি হয়ে যাবে। তারপর নিয়ম অনুযায়ী রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধাসহ অন্যান্য বিশেষ সুবিধা ছাড়ের প্রক্রিয়া কঠোর হতে শুরু করবে। এর পরেও পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ২০২৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ক্রমহ্রাসমান হারে কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশের পরও বাংলাদেশের হাতে থাকছে প্রায় সাতটি বছর। এ সময়কে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক রূপকল্প তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নত দেশে পরিণত হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতিসংঘের এ স্বীকৃতি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে আরো বেশি গতিশীল করবে। নিম্নমধ্যম আয় ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের আগে আমরা জাতিসংঘ ঘোষিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলও (এমডিজি) সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছি। তবে আমরা উন্নয়নশীল দেশের তকমাও বেশি দিন গায়ে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উত্তরণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো আমরা সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হব আশা করছি। করোনার কারণে এর ধারাবাহিকতায় কিছুটা ছেদ পড়লেও তা তেমন প্রভাব ফেলবে না বলেনই মনে করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ। বলেন, করোনা প্রভাব বাংলাদেশে একা নয়, বিশ্বব্যাপী ফেলেছে। তবে তুলনামুলক কম প্রভাবই পড়েছে দেশে। এ থেকে উত্তরণ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।

অর্থনীতিবিদদের মতে, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে (ডিসি) উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির তুলনায় সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের যে কোনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়। উদ্যোক্তার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটবে। ফলে দেশে ছোট-বড় সব উদ্যোক্তা বিশ্বায়নের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপদ ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের প্রভাব মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গতি সঞ্চার করবে।

বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের আগে হাতে থাকা নয় বছর সময়ে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য উৎপাদনে অনেক বৈচিত্র্য আসবে। বাড়বে কর্মদক্ষতা। প্রসার ঘটবে তথ্যপ্রযুক্তির। সংযোজিত হবে বিশ্বের সব আধুনিক যন্ত্রপাতির। দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হবে- যা উন্নত দেশের অবকাঠামো তৈরির পথ সুগম করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads