• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন আজ

প্রথম টিকা নেবেন নার্স রুনু

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ জানুয়ারি ২০২১

বহুলপ্রতীক্ষিত করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা দেশে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বুধবার বিকালে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে এ টিকা প্রয়োগের প্রাথমিক কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এর পরই নিবন্ধনের জন্য অনলাইন সুরক্ষা প্ল্যাটফরম খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি আরো বলেন, দেশব্যাপী ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি। আশা করি, ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ থেকে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করতে পারব।

গতকাল মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভ্যাকসিন কার্যক্রম উদ্বোধনের প্রস্তুতি পরিদর্শন শেষে তিনি এসব বলেন। দেশের ইতিহাসে প্রথম ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা। তার সঙ্গে আরো দুজন সিনিয়র স্টাফ নার্স মুন্নী খাতুন ও রিনা সরকারও টিকা নেবেন।

এদিকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম চালানে আসা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ টিকা মানবদেহে প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গতকাল মহাখালীতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বলেন, টিকার প্রতিটি লটের নমুনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। এ টিকা দিয়েই শুরু হবে টিকাদান কর্মসূচি।

এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ ফ্লাইট টিকার ওই চালান নিয়ে সোমবার ঢাকা পৌঁছায়। পরে তা নিয়ে যাওয়া হয় টঙ্গীতে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ওয়্যারহাউসে। সেখান থেকে প্রতিটি লটের নমুনা পরীক্ষার জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটের এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সরকারকে এই টিকা সরবরাহ করছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি পাওয়ায় বেক্সিমকো সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলায় জেলায় টিকা পৌঁছে দেবে।

চিকিৎসক হিসেবে প্রথম ভ্যাকসিন নেবেন মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. আহমেদ লুৎফর মবিন। আরো দুই চিকিৎসকের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ভ্যাকসিনেটর হিসেবে ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনা আক্তার ও দীপালি ইয়াসমিনের নাম রয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও নার্স এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। প্রথম টিকা গ্রহীতা হিসেবে রুনা বেরোনিকার নাম থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে তালিকার অন্য দুজনের একজনকে টিকা দেওয়া হবে।

এ কর্মসূচি আরো গতি পাবে এদিনই এ হাসপাতালে সম্মুখ সারিতে থাকা বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্বকারী ২৪ জনের একটি দলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার মাধ্যমে। সেই তালিকায় চিকিৎসক, নার্স, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, সাংবাদিকসহ অন্য পেশার মানুষ যুক্ত থাকবে। পরদিন ২৮ জানুয়ারি এ হাসপাতালের সঙ্গে আরো চারটি হাসপাতালে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এগুলো হচ্ছে- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী জেনারেল হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। 

এসব হাসপাতালে পরিচালকরা জানান, টিকা কর্মসূচি চালু করতে তারা প্রস্তুত। তবে তাদের কেউ কেউ বলছেন, জাতীয়ভাবে কর্মসূচি চালু হওয়ার পর কিছুটা সমস্যা হতে পারে, যেটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে। কিন্তু সেসব মাথায় নিয়েই কাজ করছেন তারা। প্রথম দিন যদি সবকিছু ঠিকভাবে করা যায়, তাহলে মানুষের আস্থা আসবে, ধীরে ধীরে ভ্যাকসিন নিতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে।

স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, এসব হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দিয়েই এ কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে, তাদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না সেটা দেখা হবে। গত ২০ জানুয়ারি ভারত সরকারের উপহার দেওয়া অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ২০ লাখ কোভিশিল্ড টিকা দেশে এসে পৌঁছায়। সোমবার দেশে এসে পৌঁছেছে সরকারের কিনে নেওয়া তিন কোটি টিকার প্রথম ৫০ লাখ ডোজ। এই ৭০ লাখ টিকার ভেতরে ৬০ লাখ টিকা দেওয়া হবে প্রথম মাসে। দ্বিতীয় মাসে ৫০ লাখ এবং তৃতীয় মাসে দেওয়া হবে ৬০ লাখ। প্রথম মাসে টিকা পাওয়াদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে তৃতীয় মাসে। এ হিসাবে টিকা বিতরণ পরিকল্পনা ইতোমধ্যে করা হয়ে গেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, টিকা নেওয়ার প্রস্তুতি মোটামুটি ভালোই। টিকা নেওয়ার জন্য কতজন স্বাস্থ্যকর্মী প্রস্তুত করা হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, এখনো সেভাবে ফাইনাল করিনি। তবে ১০০ জনের মতো স্বেচ্ছাকর্মীকে যাতে টিকা দেওয়া যায়, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাদের অনেক চিকিৎসক প্রথম দিনই টিকা নিতে আগ্রহী। আমি নিজেও প্রথম কাতারে টিকা নিতে আগ্রহী, যাতে আমাকে দেখে কলিগরা উদ্বুদ্ধ হবে। তদের মধ্যে উৎসাহ জাগবে এবং আস্থা জায়গাটা তৈরি হবে। এ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, টেকনোলজিস্ট, আনসারসহ সব বিভাগের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই ১০০ জনকে বাছাই করা হচ্ছে। হাসপাতালের নিচতলাতে টিকা নেওয়ার জন্য বুথ চালু করা হয়েছে। এখানে টিকা দেওয়ার পর পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেজন্য পোস্ট ভ্যাকসিন এরিয়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আমিন জানান, টিকা কার্যক্রম শুরু করতে আমরা পুরোপুলি প্রস্তুত। গত ২৪ জানুয়ারি এ হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচি কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে একটি মিটিং হয়। সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচি চালু হবে তখন এ হাসপাতালে মোট আটটি বুথ থাকবে এবং প্রতিটি বুথে টিকা দেওয়ার জন্য দুজন নার্স এবং চারজন করে স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন।

টিকা দেওয়ার পর পোস্ট ওয়েটিং রুমে গ্রহীতাদের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে তারা ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণে থাকবেন। এ সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য থাকবে একটি মেডিকেল টিম এবং স্ট্যান্ডবাই আরেকটি মেডিকেল টিম থাকবে যেখানে একজন ইন্টারনাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট, দুজন রেসিডেন্স এবং একজন আইসিইউ স্পেশালিস্ট থাকবেন। আটটি অবর্জারভেশন বেড প্রস্তুত করা হয়েছে জীবনরক্ষাকারী সব ধরনের ওষুধ এবং যন্ত্রপাতিসহ। সেখানে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। আর এই সময়ে যদি কারো অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন হয় তাহলে হাসপাতালের সি ব্লকে ১০ তলায় চারটি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) হিসেবে। এ কাজে একটি ডেডিকেটেড অ্যাম্বুলেন্সও রাখা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত হাসপাতালের ৩০০ জনের ওপরে চিকিৎসক টিকা নিতে আবেদন করে নিবন্ধন করেছেন, যার তালিকা আমার কাছে রয়েছে। তবে নার্স, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, এমএলএসএস, আনসার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যার যার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করছেন। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, সব বিভাগ থেকেই কয়েকজন করে নিয়ে ২০০ জনের তালিকা করা হবে। হাসপাতাল পরিচালক হিসেবে আমি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া টিকা নিতে নিবন্ধন করেছি। হাসপাতালের অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি এবং এটা আমাদের দায়িত্বও।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, হাসপাতালের ভেতরে ভ্যাকসিনেশন সাইটে টিকা গ্রহীতাদের কিছু ভাইটাল বিষয়, যেমন রক্তচাপ, ফুসফুসের অবস্থা এবং অ্যালার্জির কোনো সমস্যা রয়েছে কি না তা যাচাই করা হবে। সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে তাকে  টিকা দেওয়া হবে। সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে ৩০ মিনিটে। আর তাদের দেখার জন্য থাকবে একটি মেডিকেল টিম। যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে তারা বাসায় চলে যাবে। তাদের একটি টেলিমেডিসিনের জন্য ফোন নম্বর দেওয়া হবে। যদি বাড়ি যাওয়ার পর কোনো সমস্যা হয় তখন ওই নম্বরে তিনি কল করে প্রয়োজনীয় সেবা নেবেন।

টিকা রাখার জন্য হাসপাতালে আইএলআর ( হিমায়িত বাক্সের মধ্যে টিকা সংরক্ষণের  ব্যবস্থা) ফ্রিজ রয়েছে। সেখানে তিন হাজার টিকা রাখার ব্যবস্থা আছে। এ হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, টেকনোলজিস্টসহ মোট ১ হাজার ৪৭ জন কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে টিকা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১০০ থেকে ১৫০ জনের মতো মানুষকে প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। এ হাসপাতাল থেকে ইতোমধ্যে ১০০ জনের একটি তালিকা অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে তাদের আমরা প্রায়োরিটি দিতে চাইছি।

কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ডা. এ কে এম সরয়ার উল আলম জানিয়েছেন, হাসপাতালে এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি চলছে। এখনো ফাইনাল হয়নি। যারা টিকা দেবেন, তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। এ হাসপাতালে কারা টিকা নেবেন তাদের তালিকা হচ্ছে, যাচাইবাছাই চলছে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদ জানান, আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। ১০০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে প্রথম দিনের জন্য। পাশাপাশি ৫০ জনের আরেকটি টিম স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। কেবল ২৭ কিংবা ২৮ তারিখকে ধরে নয়, এ পরিকল্পনা অনেক লম্বা। হয়তো এই টিকাদান কর্মসূচি চালাতে হবে অনেক দিন। সে হিসাব ধরেই আমরা পরিকল্পনা করছি।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ম্যানেজমেন্ট টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। গ্রহণকারীদের পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য ২০টি শয্যা প্রস্তুত। সঙ্গে রাখা হয়েছে চার বেডের আইসিইউ ইউনিট। আশা করি খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে একটু মোটিভেশন লাগবে সব লেভেলেই। যদিও এটা পার্ট অব হিস্ট্রি হওয়ার কথা। আমাদের ইচ্ছে আছে সিনিয়রদের দিয়ে হাসপাতালে এ কর্মসূচি চালু করার, যাতে অন্যদের ভয় বা আতঙ্ক কেটে যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads