• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আবাসন শিল্প : সঙ্কট উত্তরণ কোন পথে

  • প্রকাশিত ১১ এপ্রিল ২০১৮

একটি জাতির বড় পরিচয় দেশের নগর-সৌন্দর্য। নগর স্থাপত্যশিল্পে অগ্রসর জাতি বিশ্বে ভিন্নধারায় পরিচিতি পায়। বিশ্বে এ শিল্পে অগ্রসর শহরগুলোর আকাশছোঁয়া সুরম্য দালান বিমোহিত করে মানুষের দর্শন-অনুভূতিকে। তাই স্থাপত্য প্রকৌশলীরা উঁচু অট্টালিকা বিনির্মাণে ভিন্নতা আনেন। শহরভরা ইট-পাথরের দৃষ্টিনন্দন দালান, নয়নাভিরাম শপিংমল, সুউচ্চ করপোরেট প্লাজা, সুবিশাল ব্যাংক-বীমার টাওয়ার কিংবা আবাসিক বহুতল অট্টালিকাগুলোতে ভিন্নতা সৃষ্টি করা হয় স্বাতন্ত্র্য পরিচিতির অভিপ্রায়ে।

কিন্তু দেশের শৈল্পিক সৌন্দর্যের ধারক সেই আবাসন শিল্প এখন সঙ্কটময় কাল অতিবাহিত করছে। এমনই একটি সংবাদ ৩১ মার্চ ‘বাংলাদেশের খবর’-এ ছাপা হয়েছে। ‘সঙ্কটের আবর্তে আবাসন খাত’ শিরোনামের ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ‘সুদের হার কয়েক বছর থেকে নিম্নমুখী থাকলেও তা আবার  বেড়েছে। এতে ফ্ল্যাট ও প্লট কেনাবেচা কমেছে ৭৫ শতাংশ। উচ্চ রেজিস্ট্রেশন ফি থাকায় ঝুলে আছে অনেক হস্তান্তর।’

সংবাদটি বিবেচনায় নিলে এক অর্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের কয়েকটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাসস্থান একটি। শহরবাসী সবার প্রত্যাশা- একটি নিজস্ব ঠিকানা। নগরকেন্দ্রিক ঠিকানা বা বাসস্থান নির্মাণ করা আরো জটিল অধ্যায়। নিষ্কণ্টক জমি কেনা, তারপর নির্মাণসামগ্রী জোগাড়, মিস্ত্রির তত্ত্বাবধান করা— শহুরে ব্যস্ত নাগরিক জীবনে এত সময় কোথায়? তারপর কোনো কিছু নির্মাণে চাঁদাবাজ-মাস্তানদের ঝামেলা তো আছেই। এ কারণে অনেক সামর্থ্যবান মানুষ আর এসবে এগোতে চান না। একটি সহজ পথ হলো- ‘রেডি মেইড’ ফ্ল্যাট কিনে ফেলা। অনেকে করছেনও তা-ই। আবার যারা শহরে জমির মালিক, তারাও আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে নিজ জমি দিয়ে দিচ্ছেন নির্মিত ফ্ল্যাটের অংশের চুক্তিতে। একজনের জমি, আরেকজনের নির্মাণব্যয়। তারপর ফ্ল্যাট ভাগাভাগিতেই নিশ্চিত হয় মালিকানা। মোট কথা, জমির অনেক মালিকও যৌক্তিক কারণে আর নির্মাণের ঝামেলায় যেতে চান না। সব মিলিয়ে এখন বেশিরভাগ ফ্ল্যাট নির্মাণের দায় গিয়ে পড়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের ওপর। ঠিক এমনই সময় ফ্ল্যাট বিক্রি যদি থমকে যায়, তাহলে মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থান প্রাপ্তির বিষয়টি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এ কারণে খতিয়ে দেখা দরকার এর পেছনে সমস্যাগুলো কী কী?

প্রথমত যে সমস্যা তা হলো— ব্যাংকের ঋণে সুদের হার আবার বেড়ে যাওয়া এবং উচ্চমাত্রার নিবন্ধন ফি। তাই যদি হয়, তাহলে ওই সব সমস্যা নিরীক্ষণ করে আরেকটু গভীরে যাওয়া দরকার। নিবন্ধন ফি ১৬ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব।  সংগঠনটির ভাষ্য, সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে আমাদের দেশের ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কেন ৪ থেকে ৭ শতাংশ বেশি হবে? নিবন্ধন ফি বেশি নির্ধারণ করায় বিক্রি কমে যাচ্ছে, সরকারও আয়কর পাচ্ছে কম। এতে একদিকে ক্রেতা-বিক্রেতা তাদের সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার মোটা দাগে রাজস্ব আয় হারাচ্ছে।

আরেকটি বিষয়, সেকেন্ড হোম গ্রহণের সুযোগ থাকায় দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওই সব দেশে ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। এ সুযোগ দেশে সৃষ্টি হলে হয়তো অনেকে অপ্রদর্শিত আয়ে অর্জিত অর্থ ফ্ল্যাট কিনতে বিনিয়োগ করতেন। আবাসন শিল্পের সঙ্গে দুই শতাধিক সহায়ক শিল্পের কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত। এসব প্রতিষ্ঠানে লাখো মানুষ কর্মরত। শুধু আবাসন খাতেই এককভাবে ৩০ লাখ মানুষ কর্মরত। এত মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস যে আবাসন খাত—এটাকে কোনোভাবে অবহেলা করা যায় কি?

আরেকটি ভাববার বিষয়, আমাদের দেশে উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট নির্মাণ হয় বেশি। সুলভ মূল্যের ফ্ল্যাট তুলনামূলক কম নির্মাণ হয়। বাজারে চাহিদার কারণে ব্যবসায়িক লক্ষ্যে এমনটা হতে পারে। সরকার এর আগে নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সুবিধার জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সেই ভাষানটেক প্রকল্প কত দূর, সেটাও আজ প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন প্রশ্নটা শুধু উচ্চ আয়ের বা নিম্ন আয়ের নয়, মধ্যম আয়ের শহরবাসী মানুষের জন্যও আবাসনের বিষয়টি ভাবা দরকার। এ কারণে নির্মাতাদের সহজ শর্তে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, রিহ্যাবের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ক্রেতারাও সুবিধা পেতেন। তারা স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ভাড়া থেকে শোধ দিয়ে ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। এজন্য সরকারকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে।

২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহঋণ বিষয়ে একটি তহবিল সৃষ্টি করেছিল। ওই তহবিল থেকে সে সময় ৬১০ কোটি টাকা ছাড় করা হয় ১৪টি ব্যাংক ও ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নিয়ম ছিল- যাদের মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকার কম, তারা ওই তহবিল থেকে দীর্ঘমেয়াদে স্বল্প সুদে গৃহঋণ নিতে পারতেন। কিন্তু কালক্রমে সেই তহবিল বন্ধ হয়ে যায়। এখন মধ্যম আয়ের মানুষেরা ভাড়া দিয়ে অন্যের বাড়িতে জীবনযাপন করছেন। সুবিধা না থাকায় আর নিজের ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখেন না।

বর্তমানে আবাসন খাতে যে স্থবিরতা চলছে, তা কাটিয়ে উঠতে অনুরূপ তহবিল থাকা দরকার। রিহ্যাবও এ ধরনের দাবি করেছে। সংগঠনটির দাবি, ২০ হাজার কোটি টাকার অনুরূপ তহবিল, অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ প্রশ্নহীনভাবে আবাসনে বিনিয়োগের সুবিধা এবং নিবন্ধন ফি গ্রহণযোগ্যমাত্রায় নিয়ে আসা। তাহলে একদিকে যেমন মধ্যম আয়ের মানুষেরা ভাড়া থেকে ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন, তেমনি উদ্যোক্তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি হবে; অন্যদিকে সরকারও চলমান ব্যবসা থেকে রাজস্ব পাবে। এ রকম একটি বিষয় সুবিবেচনার জন্য রিহ্যাব থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের মাধ্যমে তহবিল জোগান দিয়ে মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য গৃহঋণ প্রবাহ বাড়ানো যেতে পারে।

অথচ এ শিল্প একসময় খুবই লাভজনক ছিল। আবাসন ব্যবসা দিয়ে সমৃদ্ধি এনে অনেক উদ্যোক্তা জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি পেয়েছেন। এ ব্যবসা দিয়ে সিমেন্ট কল, কাগজ কল থেকে শুরু করে এক মালিকেরই নানান শিল্পপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে; যেসব প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ এ শিল্পাঙ্গনজুড়ে আজ মন্থর গতি। শিল্পকে স্থবির করে তো আর রাজস্ব আয় বাড়ে না। বরং রাজস্বের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে যদি শিল্প প্রাণবন্ত থাকে তাহলেই উত্তম। এতে রাজস্বের মাত্রা কমলেও আদায় চলমান থাকে। এতে সর্বাংশে সরকারেরই রাজস্ব আয় বাড়বে। পরিশেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের তহবিল বরাদ্দের বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরি— এমন প্রত্যাশা এ শিল্পে সংশ্লিষ্ট সবার।

 

মোবারক হোসেন

সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads