• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা জরুরি

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৮

ষাটের দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতিহাজারে ২৫৭ জন, যা আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছয়টি প্রতিষেধক টিকার মাধ্যমে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় ১৫-৪৫ বছর বয়স্ক মায়েদের টিকা প্রদান ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা হয়। তবে শিশুদের প্রাণহরণকারী ছয়টি রোগের মধ্যে পোলিও অন্যতম। পোলিও ভাইরাসবাহী রোগ। এই ভাইরাসের মাধ্যমে শিশুর অঙ্গহানি ঘটতে পারে। টিকাদানে অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও অবহেলা শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম অন্তরায়। উপযুক্ত পুষ্টি যেমন শিশুর দেহের বাড়-বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ পরিবেশ ও তার মানসিক ক্রম-পরিণতিও অপরিহার্য। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যপুষ্টি এবং সুস্থ মন একজন ভবিষ্যৎ জননীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।

বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ লাখেরও বেশি শিশু মারা যায়। এর নেপথ্যে আছে মায়ের গর্ভকালে স্বাস্থ্যহানি, জটিল রোগ-ব্যাধির প্রকোপ, সুষম খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, পরিবেশ, অশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি। পাশাপাশি রয়েছে পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সমস্যা ও অজ্ঞতা। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করে তার মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে ছোট ও কম ওজনের হয়। এশিয়ার চারটি দেশে ২.৫ কেজি এবং ৫৫ পাউন্ড ওজনের শিশু জন্ম নেয়। কম ওজন ও ছোট আকারে জন্ম নেওয়া শিশুর এক থেকে তিন বছরের মধ্যে দেখা দেয় খিঁচুনি, অন্ধত্ব, বধিরতা, মস্তিষ্কের পক্ষঘাত ও প্রতিবন্ধীত্ব। বাংলাদেশে এ ধরনের শিশু জন্মের হার ৫০ ভাগ।

গর্ভকালীন মায়েদের আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের অভাবে প্রতিবছর বিশ্বে চার কোটি শিশুর মধ্যে এক কোটি প্রতিবন্ধীত্ব বরণ করে। দুইশ’ কোটির বেশি লোক প্রধানত নারী ও শিশু আয়রন ঘাটতিকবলিত এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনূর্ধ্ব চার বছর বয়সী শতকরা ৫১ ভাগ শিশু রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ শিশুরই আয়রন ঘাটতি থাকে। দু’বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্যের অভাব দেখা যায় এবং তাদের অমিশুক ও দ্বিধান্বিত মনে হয়। ’৯০-এর দশকে ৪৮টি দেশের গর্ভকালীন মা আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের ফলে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু বিকলাঙ্গ এবং প্রতিবন্ধীত্ব থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বে ২০ লাখেরও বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধের মাধ্যমে ৮৮টি দেশ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এখনো এ রোগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি বা নিউমোনিয়া। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর শতকরা চল্লিশ ভাগ শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে আসে এবং তাদের অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করে।

জন্মের এক বছরের মধ্যে বিশ্বে ৮০ লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৫০ লাখ শিশু জন্মের চার সপ্তাহের মধ্যে মারা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। প্রতিবছর শুধু ডায়রিয়ার প্রকোপে ৫০ ভাগ শিশু মৃত্যুবরণ করে। আশির দশকে ও ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ছিল ভয়াবহ। ’৯০-এর দশকে ব্যাপক প্রচার ও পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুমৃত্যুর হার অনেক হ্রাস পেয়েছে। এদিকে ইচ্ছাকৃত আর অনিচ্ছাকৃত হোক, কোনো কোনো মা শিশুর জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়াতে অনীহা দেখান। শিশুর শৈশব অবস্থায় তার মায়ের দুধ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। অনেক ক্ষেত্রেই অসুস্থ শিশুর রোগ নিরাময়ে মায়ের দুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর দেহ গঠনের চাহিদা পূরণ করতে মায়ের দুধের প্রোটিনের প্রয়োজন ১০৬ গ্রাম।

বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছর বয়সী অসংখ্য মৃত্যুবরণকারী শিশুর মধ্যে শতকরা দশভাগ শিশু শৈশবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না পাওয়ায় মারা যায়, ফলে মাতৃদুগ্ধের অভাবে ১৫ লাখ শিশুর জীবনহানি ঘটে। দশ ভাগ শিশু শৈশবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না পাওয়ায় মারা যায়। ফলে মাতৃদুগ্ধের অভাবে ১৫ লাখ শিশুর জীবনহানি ঘটে। হাম প্রতিষেধক টিকা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের পরও সারা বিশ্বে তিন কোটি শিশু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সের নিচে কমপক্ষে আট লাখ শিশু হামে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন হাম আক্রান্ত প্রায় দুই হাজার শিশু প্রাণ হারায়। বাল্যবিয়ে আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫-২১ বছর বয়সে যেসব মেয়ের বিয়ে হয় তাদের মধ্যে বিকলাঙ্গ সন্তান দানের প্রবণতা বেশি এবং মৃত্যুহারও বেশি। কাজেই বাল্যবিয়ে বন্ধ করে অবশ্যই বয়স বৃদ্ধি করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

শিশুর নিরাপদ পরিবেশ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। মা ও শিশুর নিরাপদ জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আর্থসামাজিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অবকাঠামোগত পরিকল্পনায় মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের পাশাপাশি শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, ধনুষ্টঙ্কারের হাত থেকে শিশু ও মাকে রক্ষা, শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান ইত্যাদি কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। যেখানে আমাদের দেশে প্রতিমিনিটে পাঁচ শিশু জন্মগ্রহণ করে, সেখানে মা ও শিশু একে অপরের পরিপূরক। তাই সুস্থ মা-ই পারেন সুস্থ শিশু উপহার দিতে। একটি আদর্শ ও পরিকল্পিত ছোট স্বাস্থ্যসম্মত পরিবার গড়তে হলে মায়েদের জন্য প্রকৃত শিক্ষার পাশাপাশি সচেতন হওয়া দরকার। সমাজজীবন থেকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিকল্পিত পরিবারই সুখী পরিবার।

ইয়াসমীন রীমা

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads