• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

‘মুজিবনগর দিবস’ এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৮

আজ ১৭ এপ্রিল পালিত হচ্ছে ‘মুজিবনগর দিবস’। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ওইদিন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথগ্রহণকারী স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও তিনিই ছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, তাজউদ্দীন আহমদের জন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সুসংগঠিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিজয় অর্জিত হয়।

সরকার গঠন করা থেকে শুরু করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও দেশটির সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ায় প্রধান এবং সফল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা অর্জনের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও সফলভাবে তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। এসব কারণে মুজিবনগর দিবসে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা এবং নতুন প্রজন্মসহ জাতিকে জানানো উচিত। দিবসটি কেন বিশেষ মর্যাদাসহ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এবং দিবসটির তাৎপর্য কী— এসব বিষয়েও সুনির্দিষ্টভাবে জানানো প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে।

বাস্তবে ‘মুজিবনগর’ হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইউডিআই তথা একপাক্ষিক বা একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে নিন্দিত হওয়ার পথে পা বাড়াননি। পরিবর্তে আইনসম্মত পথে স্বাধীনতা অর্জনের সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাম করে সময়ক্ষেপণের আড়ালে পাকিস্তানি সেনানায়করা গণহত্যার জন্য সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। ২৫ মার্চ ছিল খুবই অস্বাভাবিক একটি দিন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ প্রস্তাবের জবাবে ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য জানানোর কথা ছিল। বলা হয়েছিল, ড. কামাল হোসেনকে ফোন করবেন ইয়াহিয়ার সহকারী জেনারেল পীরজাদা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চ  রাত দশটা পর্যন্তও তেমন কোনো ফোন পাননি কামাল হোসেন। তিনি এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন— যা দেখে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ‘লাস্ট সাপার’-এর কথা মনে হয়েছিল।

ফোন না আসার কথা জেনে কামাল হোসেনদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি বঙ্গবন্ধু। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত দশটার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তাজউদ্দীন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবের পর সে সময় দ্বিতীয় প্রধান নেতা। তারা তাজউদ্দীনকে পেয়েছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত অবস্থায়। তার হাতে ছিল রাইফেল।

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং ড. কামাল হোসেন যাওয়ার পরপর ইপিআরের একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ইপিআরের সব বাঙালি সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শোনার পরই তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির চার নাম্বার রোডের একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে।

এর পরের প্রতিটি প্রাথমিক পদক্ষেপ তাজউদ্দীন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে তাকে ভারতীয়দের কাছে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ভারতীয়রা তার পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই তাজউদ্দীন প্রথমবারের মতো জানতে পেরেছিলেন, প্রধান নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’ নিয়ে গেছে পাকিস্তানিরা। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে আরো বলেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার তীব্র বিরোধিতা করলেও এবং বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন থাকলেও ভারতের পক্ষে কোনো দল বিশেষকে সমর্থন জানানো সম্ভব নয়। এজন্য দরকার একটি সরকার গঠন করা। কোনো সরকার গঠন করা হলেই ভারত কেবল সমর্থন জানাতে এবং সেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ও সম্পর্ক রাখতে পারে।

কথাটার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসলে একটি সরকার গঠনেরই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মূলত সে পরামর্শের ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, দলের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। ভারত সরকারের সহযোগিতায় সেদিনই জাতির উদ্দেশে রেডিওতে তার একটি ভাষণও প্রচার করা হয়েছিল। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। এখানে ব্যক্তির চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল উদ্দেশ্য ও বিষয়ের। আর তা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম সরকার গঠন ও সরকারের শপথগ্রহণ। সেদিন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ঐতিহাসিক দিনটি পরিণত হয়েছে মুজিবনগর দিবসে।

ইতিহাসের মূল্যায়নে সঠিক, সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তাজউদ্দীন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন যখন আওয়ামী লীগের প্রায় প্রত্যেক নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ এই নেতাদের অনেকেই পরবর্তীকালে তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

কিন্তু একদিকে তাজউদ্দীন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ী হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিতি থাকায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে না পারলেও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের কাছে বংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তৎকালীন মস্কোপন্থি কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া ছিল মওলানা ভাসানীর ফলপ্রসূ বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।

মওলানা ভাসানীর এই ভূমিকা এবং সমর্থনের কারণে তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষেও সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। স্মরণ করা প্রয়োজন, স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে সহকর্মীদের উপর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ তার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেননি। তার প্রতিজ্ঞা ছিল, দেশকে স্বাধীন না করে তিনি পারিবারিক জীবনের স্বাদ নেবেন না।

সে প্রতিজ্ঞা রক্ষাও করেছিলেন তাজউদ্দীন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে নেতার হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী শেখ মুজিব নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তাজউদ্দীনকে করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পদটি থেকে তাজউদ্দীন আহমদ সরে গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর। একই সঙ্গে দলীয় রাজনীতি থেকেও বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দল না করলেও সে বছরের নভেম্বরে অন্য তিন বাকশাল নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অসহায় অবস্থায় শাহাদাত বরণ করতে হয়। অবসান ঘটে এক দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামীর গৌরবোজ্জ্বল জীবনের।

সবশেষে বলা দরকার- সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি রাজনীতি করেছেন দেশ ও জাতির স্বার্থে। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার নাম ‘মুজিবনগর’ও তাজউদ্দীন আহমদই রেখেছিলেন।

 

শাহ আহমদ রেজা

সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads