প্রতিদিনই শোকগাথা, শোকসংবাদ। প্রতিদিনই মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। প্রিয়জনের আহাজারি, কান পেতে রাখলে বুকের ভেতরে জমা হতে থাকে কষ্ট। প্রতিদিনই কবরস্থান, শ্মশানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন এপিটাফ। প্রিয় হারানোর বিচ্ছেদে লোনা জল ভর করছে দু’চোখে। দুর্ঘটনার নামে প্রতিদিনই সড়কে হত্যা করা হচ্ছে মানুষ। স্বজন হারানো মানুষের বেদনা ছাড়া একের পর এক ঘটানো এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার নেই। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় লোনা জলে আমাদের গাল ভেজানো ছাড়া অন্য কারো কোনো দায় নেই। একটি ঘটনা যেন অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তাই একটির পর একটি ঘটনা ঘটে চলে। যেন ছায়াছবি। আগে থেকে নির্মাণ করে রাখা। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে মানুষ, প্রতিবাদে মুখর মানুষ, তবুও এর থেকে নিস্তার নেই। সভা-সমিতি র্যালিসহ নানামুখী প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আজ মানুষের জানা। আর যে পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, তাদের আহাজারি তো বাকি জীবনের পুরোটাই। তবুও কমছে না দুর্ঘটনা। বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে দুর্ঘটনা। সড়ক-মহাসড়ক হয়ে উঠছে মৃত্যুকূপ।
মাত্র কয়েক দিন আগে ৩ এপ্রিল রাজধানীতে বেপরোয়া গতির একটি বাসে থাকা রাজীব নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী আরেক বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিজের হাত হারায়। চিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবনে না ফিরতে পারলেও, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে আকুলতা তৈরি হয়েছিল সচেতন মানুষের মাঝে। কিন্তু সেই আকুলতায় সাড়া না দিয়েই ১৬ এপ্রিল রাজীব নামের সেই কলেজ শিক্ষার্থী প্রিয়জনদের কাঁদিয়ে যায়। এই ঘটনায় যখন রাজধানীতে গাড়ির বেপরোয়া গতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, চালকদের অসচেতনতা, দায়িত্বহীনতা, ট্রাফিক আইন না মানা নিয়ে কথা চলছে— তখনই একে একে আরো কয়েকটি ঘটনা সামনে চলে আসে। রাজীবের আহত হবার ঘটনার সপ্তাহ পেরুনোর আগেই একইভাবে বেপরোয়া গতির বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় ৫ এপ্রিল দুই বাসের প্রতিযোগিতার মাঝে পড়ে দুই পায়ের শক্তি হারান আয়েশা খাতুন নামের এক নারী। ১০ এপ্রিল ফার্মগেটে বাসচাপায় পা থেঁতলে যায় রুনি আক্তারের। ২০ এপ্রিল বনানী এলাকায় পা হারান রোজিনা নামের একজন শ্রমিক। তার ডান পা হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এসব ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারো সাজা তো দূরের কথা— আটকই হয়নি অধিকাংশ। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই বেপরোয়া গতি আর নিয়ম না মানার বিরুদ্ধ স্রোতের মুখে আমাদের ঘর থেকে বেরুতে হয়। যার ফলও ভোগ করতে হয় আমাদের হাতেনাতে। ১৯ এপ্রিল বগুড়ায় বেপরোয়া গতির দুই অটোরিকশার গতি কেড়ে নেয় ছয় বছরের শিশু সুরাইয়া তাসনিমের প্রাণ।
এগুলো একদিনের টুকরো টুকরো ঘটনা। এর বাইরেও রয়ে গেছে অসংখ্য দুর্ঘটনা। অসংখ্য মৃত্যু, পঙ্গুত্ব আর প্রিয়জনের আহাজারি। যার সবটুকু আসে না খবরের কাগজের পাতায়। আমরা একদিনের খবর পড়ি, পরদিন নতুন দুর্ঘটনার খবর আমাদেরকে ভুলিয়ে দেয় পেছনের খবরের কথা। যদি আমাদের মনেই থাকত, তাহলে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের আবু তোরাব বিদ্যালয়ের ৪৫ জন শিশুর করুণ মৃত্যু সচেতন করত। আমাদের মনে থাকত, নাটোরের বড়াইগ্রামে ওভারটেক করতে গিয়ে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩২ বাসযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরকম অসংখ্য হত্যাকাণ্ড প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে আমাদের সড়কে। প্রিয়জনের আহাজারি আর শোক ভারি করে তুলছে বাতাস। কিন্তু যাদের সচেতনতা আর দায়িত্বশীলতা এই হত্যাকাণ্ড থামাতে পারত, তাদের সচেতন করছে না। তাই থেমে নেই সড়ক দুর্ঘটনা। একটি দুর্ঘটনায় শুধু যে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাই তা তো নয়, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাকি জীবনের জন্য পঙ্গুত্বও বরণ করে অনেক মানুষ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশের জন্য আহত যাত্রী এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অধিকাংশ সময়েই দায়ী করেন গাড়ি চালকদের। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, একজন চালকের হাতে একটি গাড়ির মূল্য যতখানি, সেই গাড়ির যাত্রীদের জীবন ততটা নয়। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে। দুর্ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হয় চালকদের। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, দায়ী চালকদের অধিকাংশেরই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তার মানে সভা-সমিতি আর আলোচনার টেবিলে দুর্ঘটনার জন্য চালকদের ভূমিকা বড় বলে যে প্রচারণা, তা সর্বাংশে মিথ্যে তো নয়ই, বরং এর সত্যতা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ৭ লাখের বেশি বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। খোদ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এর সত্যতা স্বীকার করে বলেও সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। অথচ দেশে রেজিস্ট্রিকৃত যানবাহনের সংখ্যা ২১ লাখের বেশি আর এই যানবাহনগুলোর বিপরীতে বিআরটিএ থেকে প্রাপ্ত চালকদের বৈধ লাইসেন্স ১৪ লাখ ৩১ হাজার। আর অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৫ বছরে দেশে আড়াই লাখেরও বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মানে যারা গরু-ছাগল চিনলেই চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পক্ষে, তাদের এই সিদ্ধান্তই এখন আমাদের জন্য আত্মঘাতী হয়েই দেখা দিচ্ছে। তাদের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণেই প্রতিদিন অকালে ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় অনেক প্রাণ।
সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমিতি আর আলোচনাতে সত্যিকার অর্থেই কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে হয়তো সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা গড়ে উঠছে, কিন্তু যাদের হাতে যাত্রীদের জীবন তাদের মাঝে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে একথা বলার উপায় নেই। এ তো শুধু মহাসড়ক, রাজধানীর ঢাকার সড়কেও চালকদের হাতে যাত্রীরা তো রীতিমতো জিম্মি। লেন মেনে গাড়ি চালানো তো দূরের, কোনো যাত্রীকেই নির্ধারিত স্টপেজে নামিয়ে দেওয়া হয় না, চালকেরা ইচ্ছেমতো রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যেমন যাত্রী ওঠায়, তেমনিভাবে চলন্ত গাড়ি থেকে প্রায় জোর করেই নামিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের। এ ক্ষেত্রে পেছনের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে জীবন দিতে হচ্ছে, অথবা গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে হচ্ছে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই মানুষের কান্না, প্রিয় হারানোর বেদনা আর আর্তের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। সড়ক-মহাসড়কগুলো পরিণত হয়েছে এক-একটি নিশ্চিত মৃত্যুফাঁদে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে সড়ক-মহাসড়কগুলো।
প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা কত প্রিয়জনকে হারাই তার সঠিক তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকার বলছে, এই সংখ্যা বছরে দুই হাজারের নিচে। পুলিশের হিসাবে প্রায় ৪ হাজার, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ১২ হাজার আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসাবে বছরে এই সংখ্যা ১৭ হাজার। অন্যদিকে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে, গত ১৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭০ হাজার মামলা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৪ হাজার মানুষকে আমরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অকালে হারিয়ে ফেলছি। এই যে এত মানুষের মৃত্যু, সম্ভাবনাময় প্রাণের অকালের ঝরে যাওয়া- প্রকৃত প্রস্তাবে বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদন এবং সভা-সমিতির আলোচনা থেকে এর প্রধানতম কারণগুলো ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে। চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া গতি, অনিয়ন্ত্রিত ওভারটেকিং, রাস্তার দুরবস্থা, সড়ক বিভাজন না থাকা, সড়কের তুলনায় অতিরিক্ত গাড়ি, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীসহ নানা কারণে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আফসোস, যথাসময়ে কারণ চিহ্নিত হলেও তার প্রতিকার পাওয়া যায়নি, সুফল মেলেনি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। যান্ত্রিক কারণে অথবা কোনো অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, কিন্তু তা যদি নিয়মে পরিণত হয় তাহলে তাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব? মানুষের জীবনের মূল্য কি এতই তুচ্ছ? কেন প্রতিনিয়ত সড়ক-মহাসড়কে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটতেই থাকবে। কেন প্রতিকারহীন হয়ে উঠবে এইসব দুর্ঘটনা? কেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসবে না চালকসহ দোষী ব্যক্তিরা? কেন নীরব কান্নায় ভারী হয়ে উঠবে প্রতিটি ঘরের বাতাস? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ জরুরি। এবং এটা করতে হবে আন্তরিকতা এবং সততার সঙ্গেই।
সড়ক দুর্ঘটনার মতো একটি বিষয় আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যেতে পারে না। সম্ভাবনাময় প্রাণের এভাবে অকালমৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনার বিপর্যয় বহন করছে না এমন পরিবার আজ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই ক্ষত কোনো না কোনোভাবে বহন করছে প্রায় প্রতিটি পরিবার। আমরা আর কত শোকগাথা লিখব, আমরা কি লিখতেই থাকব প্রিয় হারানোর বেদনার কথা? আমরা এর অবসান চাই। আমরা চাই নিরাপদ সড়ক। মানুষের মঙ্গলযাত্রা। এই জন্য যা করা প্রয়োজন, সেই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা তো জনগণ সরকারকে দিয়েছে।
মামুন রশীদ
সাংবাদিক, কবি
mamun_rashid3000@yahoo.com