• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শ্রেণিকক্ষই শিক্ষার মূল কেন্দ্র 

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৮

শিক্ষা-সংস্কারকরা বলেন তারা চেষ্টা করছেন মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার স্তরে টেনে তুলতে; ওদিকে হেফাজতিরা চান বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাকে মাদ্রাসার স্তরে টেনে নামাতে। টানাটানির এই ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে হেফাজতিদের জোরটাই বেশি। বাংলা পাঠ্যপুস্তকের ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক যে অল্পস্বল্প উপাদান ছিল সেটুকুও তাদের পছন্দ হয়নি। বাদ দিতে হবে। সেই দাবির কাছে নত হয়েছে শিক্ষা প্রশাসন; হেফাজতিদের আপত্তির অংশগুলো মেপে মেপে ছেঁটে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে; কিন্তু আন্দাজ করা গিয়েছিল যে— যে রচনাগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছে তা আর ফেরৎ নেওয়া হবে না। নেওয়া হয়নি। বেচারা প্রতিবাদকারীদের স্টিম শেষ হয়ে গেছে অল্প পরেই। এটা একটা ঘটনা বটে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়, আবার প্রতীকও। এটি পরীক্ষার ভারে কাবু মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে কর্তাদের উদাসীনতার প্রতীক। আবারও বলতে হয় যে, উদাসীনতার মূল কারণ বাংলামাধ্যম থেকে বিত্তবান গৃহের সন্তানদের দূরবর্তিতা। বাংলামাধ্যমের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেলে ধনীদের কী আসে যায়। তাদের বরং লাভই হওয়ার কথা। প্রতিযোগীর সংখ্যা হ্রাস পাবে।

শিক্ষা তো কেবল দিলেই চলে না, শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করতে পারছে কি না সেটাও দেখতে হয়। দেখাদেখির এই ব্যাপারেও শিক্ষাকর্তৃপক্ষ ভীষণ উদাসীন। শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষাই এখন আনন্দহীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দলাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিসরের মারাত্মক অভাব। খোলা জায়গা নেই, খেলবার মাঠ নেই; গ্রন্থাগার আছে কি নেই বোঝা যায় না; সাংস্কৃতিক কাজকর্ম প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের গৃহে আনন্দ নেই, আনন্দ নেই বিদ্যালয়েও। ওদিকে ছুটির ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই তাদেরকে ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে গত ২৭ বছর ধরে কোনো ছাত্রসংসদ নেই এই ঘটনাকে কেবল কর্তাদের উদাসীনতা বলে মেনে নিলে চলবে না। এও একটি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বটে। জ্ঞানগ্রহণে ছাত্রদের সক্ষমতাকে খর্ব করা, তাদের জ্ঞানী হতে না-দেওয়ার পুঁজিবাদী নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটি একটি কর্মপন্থা বটে।

দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার কদর ক্রমাগত কমছে। অথচ আগের দিনে মেধাবানদের প্রথম পছন্দ ছিল বিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মানবিক বিদ্যার আগ্রহও হারিয়েছে। কারণ ওই একই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ওসব বিদ্যা কাজে লাগে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মানবিক বিদ্যা প্রায় নিষিদ্ধ বিষয়। সামাজিক বিদ্যার অবস্থাও তথৈবচ। শিক্ষার্থীরা যদি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি না জানে, তাহলে তাদের শিক্ষিত বলা যাবে কি? আর বিজ্ঞান শিক্ষা যদি শিকায় ওঠে, তাহলে শিক্ষার অগ্রগতির অর্থটা দাঁড়াল কী?

বুঝতে অসুবিধা নেই যে দীক্ষাগুরুর শিক্ষা সর্বত্র বিস্তৃত। ঘরে, পরিবারে, সমাজে, বাজারে, অফিস-আদালতে ওই একই শিক্ষা। নিজের চরকায় তেল দাও। মুনাফা কর। বড় হও। বৃহৎ হও। মহৎ হওয়ার চেষ্টা কর, না করলে মুনাফা অর্জনে বিঘ্ন ঘটবে। এই শিক্ষা আজকের নয়। যুগযুগান্তরের। এ শিক্ষা রাষ্ট্র দেয়, সমাজ দেয়, দেয় বিশ্বব্যবস্থা। এর হাত থেকে আমরা মুক্তি চেয়েছি। মুক্তি চেয়েছি ঠিকই, কিন্তু মুক্তি পাইনি। পাইনি যে সেটা তো প্রতি মুহূর্তে প্রতি ক্ষেত্রে টের পাই।

আমরা আটকা পড়ে আছি জালের ভেতর। জাল কেটে বের হওয়ার সংগ্রামটা মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তির সে-সংগ্রামকে শিক্ষার সাহায্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব- এটা ছিল আশা। বলা যায় স্বপ্ন। বিদ্যমান ব্যবস্থার অনুকূল শিক্ষাকে হটিয়ে দিয়ে নতুন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, এই আশাটা মোটেই অযৌক্তিক ছিল না। মুক্তির সংগ্রামটা তো ছিল পুঁজিবাদবিরোধীই। ব্যক্তিমালিকানাধীন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে তার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যই মানুষ লড়েছে। ক্ষমতার হস্তান্তর নেতারা চাইতে পারে, মেহনতি মানুষ চায়নি। অথচ লড়াই যা করবার ওই মেহনতিরাই করেছে। ভুক্তভোগীও প্রধানত মেহনতিরাই। মেহনতিরা লড়াই করল, প্রাণ দিল, তাদের ঘরের মেয়েরা সম্ভ্রম হারাল, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাল না। পেটি বুর্জোয়াদের একাংশ সুযোগ পেল বুর্জোয়া হওয়ার; অপরাংশ নেমে গেল নিচে। নিম্নগামীদের ভেতর দেখা দিল বঞ্চিতের হতাশা। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেল বেকারত্ব। পেটি বুর্জোয়ারাও পুঁজিবাদীই। দীক্ষাগুরুর শিক্ষা তারাও গ্রহণ করেছে। দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রেণিচ্যুত হয়ে তাদের একাংশ একসময়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। সে-সংগ্রাম প্রত্যক্ষরূপে ছিল রাষ্ট্রবিরোধী। কিন্তু পেটি বুর্জোয়ারা এখন যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেছে, এবং অবাধ সুযোগ লাভ করেছে ধনদৌলতে বুর্জোয়া হওয়ার, তাই রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক করবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাদের ভেতর নেই; তাদের বরং সার্বক্ষণিক আতঙ্ক পা পিছলে না নিচে পড়ে যায়। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য তারা এখন সমাজতন্ত্রীদের জব্দ করবার তালে আছে। শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ধ্যান-অনুধ্যানটা হচ্ছে পুঁজিবাদী মানুষ তৈরির। পুঁজিবাদী মানুষ মুনাফালিপ্সু, বিচ্ছিন্ন, অসামাজিক এবং চূড়ান্ত বিচারে ভোগবাদী। পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়। বিদ্যালয়গুলো তাই পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদী মানুষ তৈরির কারখানাতে।

এমনটা যে ঘটবে তা কিন্তু স্বাধীনতার পর-পরই বোঝা গিয়েছিল। কেননা দেখা গিয়েছিল যে, রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। সমাজতন্ত্রের নাম করে তারা কলকারখানা, ব্যাংক-বীমার রাষ্ট্রীয়করণ ঘটিয়ে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা তুলে দিয়েছে সমগোত্রীয়দের হাতে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপকরা উৎপাদনের বদলে কারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, এমনকি জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। আদমজী পাটকলের বিলুপ্তি দেখলেই কী ঘটেছে তা বোঝা যায়।

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্ল্যানিং কমিশনের হাতে। অচিরেই সেই কমিশন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। তাদের তৈরি কাগজপত্র কোথায় গেছে কেউ জানে না। তারা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ছিলেন এবং সবাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাদের যে গভীর অঙ্গীকার ছিল তা নয়। তাদের পূর্ব প্রস্তুতির সবটাই ঘটেছে পুঁজিবাদী শিক্ষায় এবং পুঁজিবাদে বিশ্বাসী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগের ভেতর দিয়ে। ওই প্ল্যানিং কমিশন যে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে, এটা ছিল অবধারিত। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল যে, অর্থনীতি থেকে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিদায় ঘটতে সময় লাগেনি। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য দূর করা, এসব স্লোগান শোনা গেছে; কিন্তু সেগুলো তো কথার কথা। পুঁজিবাদীরা ওসব আওয়াজ তুলতে কখনো কার্পণ্য করে না। শিক্ষার ভেতর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে- এমনটাও কেউ কেউ আশা করেছিলেন। শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরির জন্য কুদরাত-এ-খুদা কমিশন গঠিত হয়েছিল। ওই কমিশনও কাজেকর্মে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে এমন কোনো অঙ্গীকার ব্যক্ত করেনি। ওদিকে শাসক বদল হয়েছে ঠিকই; কিন্তু পরের শাসক দেখা গেছে আগের শাসককে ছাড়িয়ে গেছে দীক্ষাগুরুর ব্যবস্থাপত্রকে বাস্তবায়িত করবার ব্যাপারে।

এ সত্যটা পরিষ্কার যে, দীক্ষাগুরুকে বিদায় না করতে পারলে আমাদের মুক্তি নেই। তার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োজন হবে। সে-শক্তির থাকবে অঙ্গীকার, থাকবে প্রস্তুতি, থাকবে বিদ্যা এবং বুদ্ধি। দীক্ষাগুরুকে তারাই পারবে বিদায় করতে।

তবে কাজটা কিন্তু কেবল বিদায় করবার নয়। পুরাতনের জায়গাতে নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবারও। এই দায়িত্ব পালন সহজ নয়, অত্যন্ত কঠিন। এবং অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। খুবই কঠিন কাজ। তার জন্য ব্যাপক ও গভীর আন্দোলন প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে শিক্ষার সংস্কার যারা চান তারা কি করতে পারেন? তাদের প্রথম কর্তব্য হবে শিক্ষাকে পরীক্ষার হল থেকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসা। শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে আনতে হলে ভালো শিক্ষক চাই। ভালো শিক্ষকদের মেধাবান হতে হবে। মেধাবানদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আনার জন্য বেতন ভাতা বৃদ্ধি দরকার। শিক্ষকদের বেতন হবে স্বতন্ত্র স্কেলে। বেতন ভাতা বাড়ানোর জন্য জাতীয় বার্ষিক বাজেটের শতকরা ২৫ ভাগ বরাদ্দের যে দাবি উঠেছে সেটা খুবই যৌক্তিক। কম করে হলেও জিডিপির শতকরা ৪ ভাগ শিক্ষাক্ষেত্রে দেওয়া চাই। এক কথায় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের মতো দেশের জন্য সব বিনিয়োগের সেরা বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষায় বিনিয়োগ। বিনিয়োগের সঙ্গে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিও হবে একান্ত কর্তব্য। দীনহীন ম্রিয়মাণ মর্যাদাহীন শিক্ষক করুণার পাত্র হতে বাধ্য, তা তিনি যতই জ্ঞানী হোন না কেন। শিক্ষার্থীরা বীর খোঁজে। সমাজের কোথাও তারা বীর খুঁজে পায় না। বীর ঘরে নেই, নেই রাজনীতিতে, নেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে, নেই আমলাতন্ত্রে। ক্ষমতাবান আছে, রয়েছে তারা সর্বত্র, কিন্তু বীর নেই। অনেকেই তাই নিজ নিজ উপায়ে বীর হতে চায়, এবং বীর হতে গিয়ে দুর্বৃত্ত হয়। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা বীর হতে পারেন, যদি তারা মর্যাদাবান হন, সামর্থ্য রাখেন মেরুদণ্ড শক্ত রাখবার। সে রকমটা হচ্ছে না। যে ব্যবস্থা শিক্ষকদের বীর না করে দোকানদার করে সে ব্যবস্থার পরিণতি ধ্বংসাত্মক না হয়ে পারে না। ঘটছে ঠিক সেটাই।

কিন্তু মূল শত্রুকে যেন কোনোক্রমেই না ভুলি। মূল শত্রু হচ্ছে দীক্ষাগুরু। তাকে বিদায় করাটাই লক্ষ্য হওয়া চাই। সে ব্যাপারে যেন বিভ্রান্তি না থাকে। দীক্ষাগুরু যে শিক্ষা এতকাল দিয়ে এসেছে তাকে মুছে ফেলতে হবে। মুছে ফেলা যাবে পাল্টা শিক্ষা দিয়ে, নইলে নয়। পাল্টা শিক্ষাটার মূল নীতি হবে পুঁজিবাদ বিরোধিতার ও সামাজিক মালিকানার। এক শ’ বছর আগে রুশ দেশে যে বিপ্লব হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল ওই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠাই। বিপ্লব পথ দেখিয়েছিল ব্যক্তিমালিকানার পৃথিবীকে বদলে দিয়ে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবার। সফলও হয়েছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বিপদে পড়েছিল বাঁচার জন্য। সে ছাড় দিয়েছে, ছলনা করেছে এবং নিপীড়ন চালিয়েছে। এসব করে সে টিকে আছে। ইতিহাস এখন অপেক্ষা করছে তাকে চূড়ান্তভাবে বিদায় করবার জন্য। যেখানেই সে আছে সে তার মুখোশ খুলে ফেলেছে। রাষ্ট্রকে সে ব্যবহার করছে ফ্যাসিবাদী কায়দায়। তার হাতে পীড়িত বিশ্ব এখন আর্তনাদ করছে। মানুষ তো বটেই, প্রকৃতিও বিপন্ন। মানুষ ও মনুষ্যত্বের এই শত্রুকে বিদায় করা চাই, বাঁচবার প্রয়োজনেই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads