• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

প্রতীকী ছবি

মতামত

নির্বাচন সামনে নিয়ে

  • প্রকাশিত ১২ মে ২০১৮

নির্বাচন সামনে নিয়ে সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো থেকে প্রতিবার ছকবাঁধা কিছু ভালো কথা প্রচার করা হয়। যেমন- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন। কালোটাকামুক্ত, পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচন। দুর্নীতিবাজদের, ঋণখেলাপিদের ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়াদের প্রার্থী হতে না দেওয়া। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। লেভেল প্লেইং ফিল্ড- সব দলের জন্য সমান সুযোগ। এমনি আরো নানা কথা। সিভিল সোসাইটি মহল রাজনৈতিক দল গঠনের প্রশ্নে, রাজনৈতিক দলের উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনের প্রশ্নে, কোনো কথাই বলে না। তারা কোনো ঘোষণা না দিয়ে সুকৌশলে Political Society-কে দুর্বল করে Civil Society Organization-গুলোকে প্রবল করার জন্য কাজ করে।

Political Society বলে বোঝানো হয় সরকার, রাষ্ট্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রাজনৈতিক দল ইত্যাদিকে। আর Civil Society Organization হলো, Election Watch, Democracy Watch, FEMA, CPD, সুজন, Parliament Watch ইত্যাদি। তারা নাগরিক কমিটি, নাগরিক ঐক্য, নাগরিক আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ইত্যাদির মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। তাদের কার্যক্রম depoliticization-মূলক। বাংলাদেশের রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় থেকে সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোর, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, জাতিসংঘের, বিশ্বব্যাংকের ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গত প্রায় চার দশকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে এটাও বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের রাজনীতি বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসসমূহের অভিমুখী। দেশের রাজনীতি নিয়ে দলীয় স্বার্থে তারা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে চলে যায়। তারা বৃহৎ শক্তিবর্গকে হীন উপায়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য, বাংলাদেশের রাজনীতির অভ্যন্তরে ডেকে নিয়ে আসে। ক্ষমতার বাইরে থাকাকালেই তারা এ রকম করে। এ কাজে বড় দুটি দলেরই আচরণ সম্পূর্ণ একরকম।

বাংলাদেশের রাজনীতি যে অবক্ষয়ক্লিস্ট ও পতনশীল, তার মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর পরনির্ভরতা এবং রাজনীতিতে সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোর তৎপরতা। রাজনৈতিক নেতারা দূরদর্শিতার অভাবে বুঝতে পারছেন না যে, পরনির্ভর হয়ে, সিভিল সোসাইটি অরগাইনাইজেশনগুলোর তৎপরতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তারা নিজেদের রাজনৈতিক সত্তাকে হারিয়ে চলছেন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। যারা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোতে গিয়ে নাগরিকত্ব নিয়েছেন, যারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোতে নাগরিক বানিয়েছেন, তারাই তো বাংলাদেশের শাসক ও নীতিনির্ধারক। মন্ত্রিপরিষদে, জাতীয় সংসদে, প্রশাসন ব্যবস্থার, বিচার ব্যবস্থার ও শিক্ষা ব্যবস্থার উচ্চ স্তরে দৃষ্টি দিলেই এটা বোঝা যায়। এদের কর্তৃত্বে ও পরিচালনায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে? জনগণ ঘুমন্ত। জনগণ পরিবর্তনবিমুখ। জনগণ প্রগতিবিমুখ। জনগণ নিজেদের নেতৃত্ব নিয়ে নেই- নেতৃত্ব তাদের স্বার্থবিরোধী। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। জনসাধারণের মধ্যকার মহান মানবিকগুণাবলিকে জাগাতে হবে। ‘জাগরণ’ আর ‘হুজুগ’ এক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮০’র দশক থেকে কেবল হুজুগ তৈরি করা হয় এবং হুজুগকেই বলা হয় গণজাগরণ। গণজাগরণে জনগণের মধ্যকার মানবীয় গুণাবলি জাগ্রত থাকে, মহান লক্ষ্য থাকে এবং মহান নেতৃত্ব থাকে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদের কথিত নির্বাচনের সময় থেকে নির্বাচনকে বলা হয় ‘উৎসব’। বাস্তবে এই উৎসবও স্বার্থান্বেষীদের সৃষ্ট হুজুগ মাত্র। হীন স্বার্থান্বেষীরা হীন উপায়ে স্বার্থ হাসিল করার জন্য হুজুগ তৈরি করে। প্রচারমাধ্যমও হুজুগ তৈরিতে ব্যবহূত হয়। Status quo রক্ষার বাইরে প্রচারমাধ্যম প্রগতিশীল কোনো চিন্তা বা কাজকেই সহায়তা করে না। এই রাজনীতি নিয়ে বর্তমান বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন দ্বারা জনগণ কি নিজেদের জন্য ভালো কিছু আশা করতে পারে! যে রাজনীতি চলছে তা নিয়ে কোনো দল ক্ষমতায় এসে জনগণের জন্য ভালো কিছু করবে? আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামপন্থি দলগুলো? কোন দল সরকার গঠন করবে? রাজনীতি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরেও এই রকমই চলবে। তবে জনগণ জাগ্রত হলে রাজনীতি অন্যরকম হবে। তাতে রাজনীতি দ্বারা জনকল্যাণের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।

যাই হোক, আমরা চাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভালোভাবে সম্পন্ন হোক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক। ধর্ষণ, অসামাজিক কার্যকলাপ, হত্যা, আত্মহত্যা, জুলুম-জবরদস্তি, ঘুষ-দুর্নীতি কমুক, শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হোক, বেকার সমস্যার সমাধান হোক, কৃষি ও শিল্পের উন্নতি হোক, কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের অবস্থা উন্নত হোক, ধনিক শ্রেণির লোকেরা দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা লাভ করুক এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে কাজ করুক। তবে চলমান ধারার রাজনীতি নিয়ে এসব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো, সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো কেবল status quo রক্ষা করে চলতে চায়, প্রগতি তাদের চিন্তা-চেতনায় দুর্লভ। একটি ধারা আছে, যেটি ইসলামের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে প্রচার চালানোকেই প্রগতি মনে করে। এরা গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রে আগ্রহী নয়। এদের চিন্তা-কাজ ভুল ও ক্ষতিকর। এরা আদৌ প্রগতিশীল নয়। এদের চিন্তা ও কাজ জনস্বার্থের অনুকূল নয়- প্রতিকূল।

এ অবস্থায় কেবল নির্বাচনে গোটা জাতির রাজনৈতিক চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিশ্ব ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং রাজনীতিসংক্রান্ত সব বিষয় নিয়েই গভীর ও ব্যাপক চিন্তা দরকার। যে চিন্তা-চেতনার মধ্যে আমরা আছি, যে চিন্তা-চেতনা দ্বারা আমরা পরিচালিত হচ্ছি, তা আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গণবিরোধী রূপে রেখেছে। তা দ্বারা বাংলাদেশ বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠছে না। আমাদের চিন্তা-ভাবনায় মৌলিক পরিবর্তন দরকার। সেই সঙ্গে দরকার উন্নত নতুন কর্মধারা। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর থেকে এটা আরম্ভ হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দল নতুন চিন্তা-ভাবনা অবলম্বন করে নবায়িত হতে পারে। আবার বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকেও এটা হতে পারে। এর জন্য প্রথমে দরকার বৌদ্ধিক আন্দোলন- intellectual movement. বৌদ্ধিক আন্দোলনে দরকার উন্নত চরিত্রবল। কেবল বুদ্ধি দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে হয় না। দরকার হয় বৌদ্ধিক চরিত্রবল- intellectual character, বাংলাদেশে জ্ঞানী লোকের অভাব নেই। কিন্তু চরিত্রবলের নিদারুণ অভাব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বুদ্ধিজীবী গ্রুপগুলোর যে চরিত্র তা দিয়ে ভালো কিছু, মহৎ কিছু অর্জন সম্ভব নয়। এই রকম চরিত্র হলে ইংরেজ শাসনের অবসান হতো না, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হতো না।

অবস্থার উন্নতির জন্য উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল লাগবে। রাজনৈতিক দলকে গণ্য করতে হবে রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ। বিভিন্ন দলের মধ্যে জনসমর্থন নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকবে। দলের ভেতরে রাজনৈতিক আদর্শ, কর্মসূচি ও জনকল্যাণ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা থাকবে। দলে রাষ্ট্র নিয়েও থাকবে গভীর চিন্তা-ভাবনা। বাংলাদেশকে জনগণের উন্নত রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্রের প্রচলিত ধারণা দিয়ে হবে না। সর্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শ উদ্ভাবন করে নিতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য দল ভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দরকার। এসব নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা দরকার। মোট কথা, রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তনের তাগিদটা প্রথম লেখকদের দিক থেকে আসা উচিত।

আবুল কাসেম ফজলুল হক

লেখক : রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads