• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শিক্ষা, শিক্ষক এবং জাতির প্রত্যাশা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৪ মে ২০১৮

জাতি আজ কঠিন মানবিক মূল্যবোধহীন সমাজব্যবস্থার সম্মুখীন। চারদিকে হাহাকার আর নৈরাজ্য। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রতারণা, খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং কত শত নামে নতুন নতুন রূপে সমস্যা হাজির হচ্ছে আমাদের সামাজিক জীবনে। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পারস্পরিক সম্মান এবং মানবিক মূল্যবোধ যেন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। আমাদের আবেগ-অনুভূতির জায়গাগুলো যেন এখন নিষ্প্রাণ ও বোধহীন। ঘুণে ধরা এই সমাজে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব। দুর্মূল্যের বাজারে হন্যে হয়ে ছুটছে সবাই প্রতিপত্তি নামের দৈত্যটিকে ধরার জন্য। টাকা আমাদের লাগবেই— সেজন্য প্রয়োজনে বিবেকবোধ ও মানবীয় সত্তাকে বিসর্জন দিতেও যেন রাজি আছি আমরা। প্রশ্ন হলো- এই বোধহীন, নিষ্প্রাণ সমাজের আগামী প্রজন্মের কী অবস্থা হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সমাজ? কার কাছে? সমাজকে এসব অপসংযোগ থেকে বাঁচাতে মোক্ষম ভূমিকা নিতে পারেন শিক্ষকরা। তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা এখন অনেক। সেই বিবেক, বোধ ও মানবিক আবেগ-আবেদনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে পারেন কেবল তারাই। আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায় আবারো ঝংকার তুলতে পারেন মহান পেশার এই কারিগররা।  কেননা শিক্ষকরা শুধু পাঠ্যপুস্তকের পড়াই শেখান না, তারা সমাজের সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চার সংযোগ ঘটিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন মানবিক মূল্যবোধের পথে। এই পৃথিবীকে যেসব মহান ব্যক্তি তাদের শ্রম আর মেধায় আলোকিত করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার যত উচ্চ, নিম্ন বা মধ্যসারির পেশার কথাই বলা যাক না কেন- সবাই আমরা শিক্ষকেরই ছাত্র। সুতরাং শিক্ষকের দেওয়া দীক্ষা, মেধা, শ্রম আর সাধনার প্রবহমান ফসল আমরা সবাই। এজন্য শিক্ষকরা শ্রদ্ধাভাজন, সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনটি পেশাকে সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, পেশা তিনটি নিজের জন্য নয়। পেশা তিনটির মধ্যে অন্যতম একটি হলো শিক্ষকতা। অপর দুটি চিকিৎসা ও সংস্কৃতি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। পৃথিবীতে যত ধরনের পেশা আছে, শিক্ষকতা তার মধ্যে অন্যতম।

শিক্ষকরা ক্লাসে যেমন পড়াবেন, তেমনি বাইরেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু এখন দেখা যায়, সামাজিক কার্যক্রমের প্রতি শিক্ষকদের আগ্রহ দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। শিক্ষকরাও যেন ভাবলেশহীন। সমাজের প্রতি যেন তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এখন শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ করে বসে— ‘স্যারেরা স্কুলে ভালোভাবে পড়ান না।’ কোচিং বা প্রাইভেট ক্লাসের প্রতি বেশি মনোযোগ এখন শিক্ষকদের। বলে রাখা প্রয়োজন, সমাজের সব অপ-সংযোগ অপবাদ থেকে শিক্ষকরাও রেহাই পাচ্ছেন না। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অনৈতিকতা, প্রতারণা এমনকি শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়ে সমাজের ধিক্কার পেয়েছেন। গোটা শিক্ষকসমাজকে এই অপবাদের কালিমা লজ্জিত করেছে। লোভ-লালসা, মোহ কাটিয়ে শিক্ষকরাও সমাজের কাছে আদর্শের মডেল হতে ব্যর্থ হয়েছেন অনেক ক্ষেত্রেই। তারপরও প্রত্যাশার জায়গাটিতে বসে আছেন তারাই। এই সমাজটাকে বদলাতে হবে- এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে শিক্ষকরা যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে তাদের সঙ্গে দলে দলে যোগদান করবে সমাজের সাধারণ মানুষ। যদিও সমাজ পাল্টে দেওয়ার একক দায়িত্ব শিক্ষকদের নয়, তবু তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

 

বলছি না যে শিক্ষকরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে অবহেলিত হয়ে পান্তা ভাত খাবেন। শিক্ষকদের অধিকারের বিষয়েও কথা বলব আমরা। তবে একজন শিক্ষকের প্রধান এবং একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত তিনি শিক্ষক। কিন্তু সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে শিক্ষকরা এখন শুধুই শিক্ষক হয়ে তৃপ্ত হতে পারছেন না এটাও সত্যি। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ-প্রতিবেশ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী থাকলেও বলতেই হবে, মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে লোভ ও ক্ষমতার মোহে পড়ে যেন শেষ পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছে শিক্ষকসমাজ। এই মোহের সংক্রমণ যেন ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে। তারপরও এমন অপ্রত্যাশিত দুর্নামের কালিমা এড়িয়ে নীরবে সততার নিরহঙ্কার অবদান রেখেও যাচ্ছেন অনেক অনেক শিক্ষক। সমাজও তাদের সম্মান জানায় প্রতিক্ষণ। শিক্ষকরা সচেষ্ট হলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে যা হতে পারে— ১. শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষা পাবে, ২. মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটবে, ৩. সুনাগরিক তৈরি হবে, ৪. অপসংস্কৃতির প্রভাব কমবে, ৫. সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়বে, ৬. সামাজিক সম্প্রীতি বাড়বে, ৭. অনিয়ম, অনৈতিকতা কমবে। শিক্ষকরা নানাভাবে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন— ১. শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, ২. জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে, ৩. সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে, ৪. পাঠাগার আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে, ৫. পরিবেশ রক্ষা ও সামাজিক সমস্যা নিরূপণে সমন্বিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে, ৬. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন করার মাধ্যমে। দুই দশক আগেও উপজেলা ও থানা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক চর্চা ও পাঠাগার আন্দোলন বেশ জনপ্রিয় ছিল। এসব কারণে সামাজিক অপকর্ম কম হতো। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। হঠাৎ করেই শিক্ষকদের অংশগ্রহণ এসব ক্ষেত্র থেকে কমে যাওয়ার ফলে সেখানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই আদর্শহীন রাজনীতি এ চেতনাকে ধ্বংস করে শিষ্ঠাচারহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করেছে। মফস্বল শহরে গেলে এই বাস্তবতা চোখে পড়ার মতো।

সমাজ সংস্কার ও জাতি গঠন, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান কোনো রাষ্ট্রনায়ক, অর্থনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধির চেয়ে কম নয়। সঙ্গত কারণেই শিক্ষকের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসু হিসেবে গড়ে তোলাই হবে শিক্ষকদের দায়িত্ব।

শিক্ষক এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন, যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষকের (প্রাইভেট টিউটর) প্রয়োজন না হয়। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো দেশের প্রধান প্রোডাকটিভ খাত। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধার লালন কেন্দ্র। শ্রেষ্ঠ মেধাবী লালন-পালনের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরি করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম দায়িত্ব। সাধারণত চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে পরিবারের বাইরে একটি শিশু শিক্ষকের সংস্পর্শে বিদ্যালয়ে এসে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বিকশিত হতে শুরু করে। এ সময় শিক্ষকরা শিশুদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দেন— যা ভবিষ্যৎ জীবনে সৃষ্টিশীল কাজে শিশুকে অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষার্থীর অনুশাসন, দিকনির্দেশনা দেওয়া সর্বস্তরের শিক্ষকদের মহান দায়িত্ব। একজন শিক্ষার্থীকে বড় ও মহৎ কিছু অর্জনের জন্য পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করা শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটি ভয়ের নয়-সম্মান ও স্নেহ-ভালোবাসার। শিক্ষক হবেন তার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব। আনন্দঘন ও বন্ধুবৎসল নিরাপদ শিশুবান্ধব পরিবেশ শিশুকে পাঠে আগ্রহী ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।

তারপরও বলব, শিক্ষকরা এই সমাজেরই মানুষ। তাদেরও খেয়ে-পরে সমাজে বসবাস করতে হয়। দুঃখ লাগে যখন শিক্ষকরা সমবেত হয়ে অনশন করেন তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। আর মেধাবীদের আনতে চাইলে শিক্ষকতা পেশাকে আরো আধুনিক ও আকর্ষণীয় করার বিকল্প নেই। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। পৃথক বেতন কাঠামো, উৎসাহ বোনাস, রেশনিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের এসব দাবির সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু শিক্ষকদের সমাজের কাছে আদর্শের মডেল হিসেবে পরিগণিত হওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।

প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

writetomukul36@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads