• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
শুধু ভঙ্গি যেন না ভোলায় চোখ

সংরক্ষীত ছবি

মতামত

শুধু ভঙ্গি যেন না ভোলায় চোখ

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০১৮

গত ৬ মে এসএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। এবার দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় গড় পাসের হার কমেছে। তবে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বেড়েছে। এবার পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এবারের ফলে আরো একটি বিষয় দেখা গেছে, তা হলো অন্যবারের তুলনায় এবার পাসের হার ও শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। একজনও পাস করেনি- এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার শতভাগ শিক্ষার্থী পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৬৯২টি। আর সবাই ফেল করেছে— এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। অথচ গত কয়েক বছরে পাসের হার হু হু করে বাড়ছিল। সেই সঙ্গে ভাঙছিল পাসের হারের আগের সব রেকর্ড। তবে এবার রেকর্ড ভাঙার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেও কমেনি জিপিএ-৫ পাওয়ার হার। বরং বেড়েছে। তবে এই ফলে আমাদের উল্লসিত হওয়ার আদৌ কিছু আছে কি না- ভাবার সময় এসেছে। সত্যিকার অর্থেই পাসের হার বাড়া-কমার সঙ্গে শিক্ষার গুণগতমান বাড়া-কমার সম্পর্ক আছে কি না, শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি হচ্ছে কি না- তাও ভাবার সময় এসেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা কমেছে, এটা যেমন সত্য; তেমনি সত্য অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। ফলে শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ভালো করছে শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের সাফল্যকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যারা পরিশ্রম করেছে, তারা ফল পেয়েছে। তাদের উষ্ণ অভিনন্দন। কিন্তু যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে, যে কারিকুলামের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তারা সার্টিফিকেট অর্জন করছে, সেখানে কোনো গলদ নেই তো- যা তাদের শিক্ষাকে শুধু সার্টিফিকেট সর্বস্বই করে তুলছে? এটাই ভয়। আমরা ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরাই। তাই আমাদের মনে সাফল্যের মধ্যেও সন্দেহের বীজ উঁকি দেয়। শিক্ষার্থীদের এই সাফল্য তো শিক্ষকদেরই সাফল্য, তাই ফল বেরুনোর পর বন্ধুস্থানীয় কয়েক শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তারা মাধ্যমিকের ফল কীভাবে দেখছে? আমাদের এই এগিয়ে যাওয়া নিয়ে তাদের ভাবনা কী? মাধ্যমিক স্তরের কয়েক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে যে প্রশ্ন আমাকে পীড়া দিয়েছে, তা থেকেই আরো কয়েক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান করেন। এদের কারো কারো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানো এবং এই পর্যায়ের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। এদের সবার কথাতেই প্রায় একই সুর। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই সার্টিফিকেটসর্বস্ব ফল নিয়ে এদের কেউই পরিতৃপ্ত নয়। তাদের অতৃপ্তির জায়গাটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। প্রায় একই সুরে বলা তাদের কথার সারমর্ম যদি নিজের ভাষায় করি, তা হবে— ‘শুধু ভঙ্গি যেন আমাদের না ভোলায় চোখ’। তার মানে গরল আছে, আছে প্রশ্ন। কী সেই প্রশ্ন?

আমার শিক্ষক বন্ধুরা বলছে, পাসের হার ইতিবাচক। তবে তা আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য শুভ নয়। কারণ, পাসের হার বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। তাদের বললাম, তোমরাই তো পাঠদান কর, মান বাড়ানোর দায়িত্ব তো তোমাদেরই। তাই মান না বাড়ার ব্যর্থতা তো তোমাদের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু তারা তা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, আগে আমরা যেভাবে খাতার মূল্যায়ন করতাম, এখন তা হয় না। একটু উদারভাবে খাতা দেখার অলিখিত নির্দেশনা থাকে শিক্ষকদের প্রতি। পরামর্শ থাকে, শিক্ষার্থী কিছু লেখার চেষ্টা করেছে দেখলে পার করে দেওয়ার। আগে সাহিত্যের কোনো বিষয়ে একজন শিক্ষার্থী পুরো নম্বর পেত না। কেউ এটা কল্পনাও করতে পারত না। এখন পায়, কেন পায়? এখন আমরা লিখলেই নম্বর দিই। আগে বানান ভুলের জন্য নম্বর কাটা হতো, এখন ওটা ধরি না। হাতের লেখাসহ বিভিন্ন বিষয় ছিল, যা দেখে আমরা পুরো নম্বর দিতাম না। এখন এগুলো আর সেভাবে মানা হয় না। আগে শিক্ষার্থীরা সাহিত্যের পাশাপাশি ভাষার ব্যাকরণে দক্ষতা অর্জন করত। এখন যেটুকু ব্যাকরণ তারা শেখে, তা দিয়ে কাজ চলে না। শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, ইংরেজিতেও একই অবস্থা। ব্যাকরণের ভিত শক্ত না হলে, ভাষার ওপর পুরো দখল হয় না। আবার সৃজনশীল প্রশ্ন বিষয়ে তাদের কথা— একজন শিক্ষক কয়েক দিন খেটেখুঁটে, ভেবেচিন্তে একটা প্রশ্ন তৈরি করল, তা একজন শিক্ষার্থী তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় কী করে উতরে যাবে? শিক্ষার্থী পুরো বিষয়টি পড়ে ধারণা করছে, আর সেই ধারণার ওপর নির্ভর করেই উত্তরপত্রে লিখছে, এটাই সৃজনশীলতার ব্যাপার। কিন্তু সবার ধারণা তো এক নয়। কেউ কেউ কিছু না বুঝে প্রশ্নটাই তুলে দিচ্ছে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তাকেও তো নম্বর দিতে হচ্ছে। পাস করিয়ে দিতে হচ্ছে। যারা জিপিএ-৫ পাচ্ছে, তাদের নিয়ে কিন্তু এসব শিক্ষকের অভিযোগ বা সন্দেহ নেই, তাদের সন্দেহ গড়ে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়া নিয়ে। আর পাসের হার বাড়ানোর একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়েও তাদের আপত্তি। কারণ সব শিক্ষা বোর্ডই চায়, অন্য বোর্ডকে টপকে যেতে। শুধু ঢাকা বোর্ড সবসময় পাসের হারের দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে, তা তো হয় না। এই প্রতিযোগিতাও, উদারভাবে খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের উৎসাহিত করে। যারা মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে সার্টিফিকেট অর্জন করল, তাদের বেশিরভাগই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায় না। এমনকি জিপিএ-৫ পাওয়াদেরও অনেককে দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আসন সঙ্কটের কারণে নিতে পারে না। প্রতিযোগিতার পরীক্ষায় তারা বাদ পড়ে যায়।

এই বাদ পড়ার বেদনার মধ্য দিয়েও ফুটে ওঠে আমাদের শিক্ষার গুণগতমানের চেয়ে সার্টিফিকেট প্রাপ্তির বিষয়টি। কয়েক বছর আগে একটি দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের অধিকাংশই ইংরেজি বিষয়ে নির্ধারিত নম্বর অর্জন করতে পারেনি। একই সঙ্গে আরো একটি বিষয় আমাদের আমলে নেওয়া প্রয়োজন। এখন যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা তাদের অভিযোগ, অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থীই সঠিকভাবে আবেদন করতে পারে না। আবেদনপত্রে থাকে অসংখ্য ভুল। বানান ভুলের সঙ্গে বাক্য গঠনের দুর্বলতাও চোখে পড়ার মতো। শিক্ষার মান এবং আমাদের অপরিকল্পিত উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট প্রাপ্তির হার কোথায় এসে ঠেকেছে, তার উদাহরণের জন্য যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরের অংশটা দেখলেই বোঝা যায়। কারণ চাকরিপ্রার্থীদের যে আবেদনপত্রগুলো জমা হয়, তার অধিকাংশই থাকে সর্বোচ্চ সার্টিফিকেটধারীদের।

তাই শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু পাসের হার বাড়ানো নয়, গুণগতমান নিশ্চিত করার এখনই সময়। না হলে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে আরো ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে আসা প্রার্থীদের ভাণ্ডে যদি জল না থাকে, সেই কলসি উপুড় করলেও জাতির লাভ হবে না। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে কোনো জলধারা বইবে না। এবার আটটি বোর্ডে মাধ্যমিকে যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের সেই অর্জন যদি শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব হয়ে থাকে, তাহলে সেই কাগজের খেসারত ভবিষ্যৎ কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেবে। আমাদের শিক্ষা হোক আলোকিত মানুষ হয়ে ওঠার। আমাদের মেধা ও মনন আরো শানিত হোক, যা দিয়ে দূর হবে তমস কালো অন্ধকার। আর এই সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের যত দেরি হবে, তত বেশি খেসারত দিতে হবে জাতিকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু ভঙ্গি যেন না ভোলায় চোখ। 

লেখক : সাংবাদিক ও কবি

mamun_rashid3000@yahoo.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads