• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

রসরচন

খেচর কাহিনী 

  • সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০১৮

ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে ‘এককথায় প্রকাশ’ অংশে পড়েছিলাম ‘আকাশে উড়িয়া বেড়ায় যে’— এই বাক্যের এককথায় প্রকাশ হচ্ছে ‘খেচর’। তখন আকাশে যা কিছু চোখে পড়ত, তা-ই খেচর বলে মনে হতো। অল্পবিদ্যা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার একটি বাজে নমুনা আমার এই খেচরবিদ্যা। একদিন আকাশে একটি যাত্রীবাহী বিমান দেখে সেটিকে আমি খেচররূপে অভিহিত করি।

একটু বড় হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, খেচর শব্দটির ব্যবহার কমে গেছে। ধারণা করলাম, ‘খচ্চর’ শব্দটির কাছাকাছি উচ্চারণ ও বানান পদ্ধতির জন্যই বুঝি ‘খেচর’ শব্দের ব্যবহার ও সম্মান কমে গেছে। পণ্ডিতরাও ‘পক্ষীবিদ্যা’ কথাটা চালু করলেন ‘খেচরবিদ্যা’র পরিবর্তে। সম্ভবত তারা ‘খচ্চর’ ও ‘খেচর’ শব্দদ্বয়ের চক্কর পরিহার করতে চেয়েছিলেন।

যাহোক, এসব পণ্ডিতি বিষয়, আমাদের মাথা ব্যাকুল করার প্রয়োজন নেই। আমরা খেচরবাসনা নিয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই। তবে এ-জাতীয় বিষয় নিয়ে রসের কথা বলা যায় কি-না, তা নিয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে। এমনিতেই আকাশে উড্ডয়নমাত্র ভূপাতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এমন অবস্থায় খেচরমানুষটির মাথায় রঙ্গরসিকতা আসে কীভাবে, ঠিক বোঝা যায় না।

বহু সাধ্যসাধনা করে আমিও মনুষ্যনির্মিত অতিকায় খেচর অর্থাৎ উড়োজাহাজে আরোহণ করার একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। ‘সুযোগ’ বললাম এ-কারণে যে, জাহাজে চড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া একটা যেমন-তেমন ব্যাপার নয়। আর এটি বটগাছ কিংবা আমগাছে চড়ার মতো কোনো হেলাফেলা  আরোহণ  নয়। রীতিমতো গাঁটের বিস্তর টাকা খরচ করে টিকেট কেটে, সেই টিকেট কয়েকটি মেশিনে ঢুকিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আমাকে যাত্রীলাউঞ্জে বসতে দিল। যাত্রীছাউনি নয়, ‘লাউঞ্জ’। আরে, এ কি মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ যাত্রা যে ‘ছাউনি’তে বসে থাকব!

লাউঞ্জে তো বসে রয়েছি। প্রায় দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। বসে আছি তো বসেই আছি। ইতোমধ্যে প্রকৃতি মহাশয় আমাকে ডাক দিয়েছেন। আহ্বানটি সংক্ষিপ্ত। আমি সারা লাউঞ্জ খুঁজেও প্রক্ষালন লাউঞ্জ খুঁজে পেলাম না। শ’দুয়েক যাত্রী (নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধসহ) বসে আছেন। দেখলাম তাদের মধ্যে আমার মতো অনেকেই প্রকৃতি ও মানবদেহের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির ঝামেলায় পড়ে গেছেন।

পরিস্থিতি আরও বিকশিত হয়ে উঠলে আমি অগত্যা কর্তৃপক্ষের কাছে কর্মসাধনার স্থানের সন্ধান করলাম। তাদের একজন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে সেরে আসার জ্ঞান দিলেন। আমার পশ্চাতে একটা লাইন, বেশ লম্বা। সবাই আমার মতো প্রকৃতিভৃত্য। ফিরে এসে আর প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢুকতে পারি না। টিকেট, পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র পুনঃদর্শনপূর্বক তারা আমাকে ঢোকাবেন। হায়, আমি যে পাসপোর্ট ভেতরে রেখে বাইরে গিয়েছিলাম! টিকেট দেখালাম, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করলাম, শেষমেশ আমার প্রচণ্ড শক্তিশালী সরকারি পরিচয় (অর্থাৎ পায়ের মর্যাদা তথা পদমর্যাদা) প্রকাশ করার পর তেনাদের দয়া হলো। আমি কথা দিলাম ভেতরে ঢুকে পাসপোর্ট নিয়ে তাহাদের দরবারে হাজির হব। মুক্তি পেলাম, না মোক্ষলাভ ঘটল...ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

অথচ যাত্রীবসার ঘরে একটি প্রকৃতিআহ্বান সাধনগৃহ (আপনাদের ভাষায় টয়লেট) থাকলে এত বিভ্রাট আর জটিলকুটিল সমস্যায় পড়তে হতো না। বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করার সময় যে ব্যবহার আপনি ‘অর্জন’ করবেন, তা রীতিমতো অতি নিগৃহীত স্বামীর অভিজ্ঞতার চেয়েও ভয়াবহ। ঢাকার এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির স্থাপত্য অঙ্কন ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনাকারীদের প্রাসাদ নির্মাণ বিদ্যার প্রতি যাত্রীলাউঞ্জে রুদ্ধ যাত্রীদের পক্ষ থেকে অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তা মহাশয়, আপনাদের এত বুদ্ধি আর একটা টয়লেটের নকশা আকার বুদ্ধি হলো না! আজকাল তো বিভিন্ন স্থানে দেখছি এই অপরিহার্য কক্ষ নির্মাণেও স্থাপত্যজ্ঞানের প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফিরে এসে মুজবুক খানদারের নিকট আমার দুঃখের কথা জানাতেই তিনি বলে উঠলেন, আমাদের স্থাপত্যবিদগণ নন্দনতত্ত্বের ব্যবহার করছেন সবখানে। তারা যাত্রীলাউঞ্জে প্রস্রাব-পায়খানার ঘর বানিয়ে নিশ্চয়ই বন্দরের নন্দনতাত্ত্বিক সুন্দরকে আহত বা বিনষ্ট করতে পারেন না। তারা এইরূপ নির্মাণ প্রস্তাবনা করে অত্যন্ত সুরুচির পরিচয় দিয়েছেন।

আমি কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করলাম না। মানুষের ক্লেশ দূর করার জন্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যে কুরুচির চিহ্ন, আজ তা প্রথম জানতে পারলাম। প্রিয়জনদের দয়া ও অনুগ্রহে এবং সরকার বাহাদুরের নির্দেশে আমি এই খেচর প্রজাতির বাইরের একটি মানবসন্তান পৃথিবীর সব বিখ্যাত ও কুখ্যাত বিমানবন্দরের যাত্রীগৃহে অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছি। কোনো বন্দরেই প্রক্ষালন ব্যবস্থা নেই, এমনটি আমার চোখে পড়েনি। সে সব বন্দরের নান্দনিক স্থাপত্যকলায় কোনো হানি ঘটেছে বলেও আমার মনে হয়নি। একমাত্র সম্ভবত ঢাকাতেই আমি ব্যতিক্রম দেখলাম। হতে পারে এই ব্যবস্থাটির জন্যই আমরা জগতে ‘একমাত্র’ হওয়ার মহাসম্মান অর্জন করেছি। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান নাকি প্রথম। তবে এই ক্ষেত্রে আমরা অদ্বিতীয়।

যাত্রী অপেক্ষমাণ গৃহে প্রবেশের আগে আরো একটি অদ্বিতীয় কাহিনীর নায়ক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমার চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে অন্য একটি বন্দর থেকে আমাকে অন্য একটি জাহাজে আরোহণ করতে হবে। ঢাকা বন্দরের সংশ্লিষ্ট ডেস্ক থেকে আমাকে বোর্ডিং পাস দেওয়া হলো না। আমি অবাক বিস্ময়ে পাসদাতার পানে তাকিয়ে রইলাম। তিনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাস দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। কুড়ি মিনিট অতিক্রান্ত। আমি যেন দালির একখানা পরাবাস্তব ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, স্যার, আপনি লাউঞ্জে গিয়ে বসুন। আমি এখনই পাস নিয়ে আসছি। আমি প্রমাদ গুনলাম। এখনই যখন দেবেন তো এখনই দিন।

লাউঞ্জে ‘বাউন্স’ হওয়ার ঘটনা একটু আগেই বলেছি। এদিকে ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। পাসবাবুর খবর নেই। তাকে সংবাদ পাঠানোরও কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিকে জাহাজে ওঠার সময় প্রায় আগত। কয়েকজন দেখি লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন। আমি একবার তাকাই লাইনের দিকে আর একবার তাকাই পাসবাবুর পথের পানে। হন্তদন্ত হয়ে তিনি প্রবিষ্ট হলেন। বোর্ডিং পাস পাওয়ার পর মনে হলো এমন প্রাপ্তি বুঝি সারা জীবনে এই একবারই ঘটল।

পাস পেতে বিলম্ব হওয়ায় জাহাজে উঠতেও কিছুটা বিলম্ব হলো। দরজায় দাঁড়ানো খেচরকন্যা (থুড়ি, বিমানবালা) আমাকে এমনভাবে স্বাগত জানালেন যাতে অভ্যর্থনার দুটি বিপরীত অর্থ হতে পারে। এক. দেরিকরা বুঝি স্যার আপনাদের চিরস্বভাব! দুই. তুই একটা খচ্চর; না হলে জাহাজ দাঁড় করিয়ে রাখিস? আমি এতটাই ব্যাকুল ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে, অভিজাত শ্রেণির যাত্রী হয়েও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোন দরজা দিয়ে ঢুকব— দুই বিমানকন্যার একজন এমনভাবে ডানহাতখানি বাঁকিয়ে চুরিয়ে আমার পথনির্দেশ দিলেন যেন মনে হলো তিনি আমার স্বর্গে আরোহণের চিহ্ন দেখিয়ে দিচ্ছেন। অনেক কষ্টে  একখানি শুকনো হাসি মেরে ঢুকলাম।

জাহাজ আর আকাশে ওড়ে না। কোনো প্রকার নড়াচড়াও করে না। উড্ডয়নের সময়সীমা পার হয়ে গেছে সেই কখন! তবে কি যন্ত্রবিভ্রাট? হায়, হায়! আমার এবার কী হবে! এই মহামূল্যবান জীবন (শুধু তা আমার কাছে) কি একটা বিকল উড়োজাহাজের হাতে সঁপে দিলাম!

কাউকে জিজ্ঞাসা করব- তেমন সাহস ও ভাষা, কোনোটাই আমার নেই। প্রবেশদ্বার খোলা দেখে ভাবলাম দরজাতেই গোলমাল। আমার ভাঙাচোরা ইংরেজিতে এক খেচরিণীকে জিজ্ঞাসা করলাম দরজার সমস্যা কী? অত্যন্ত আনন্দের কথা, তিনি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারেননি- এমন একটি আশ্চর্যরকম হাসি দিলেন, যার কয়েক শ অর্থ হতে পারে।

হঠাৎ কানে এলো একটা মৃদু কোলাহল। এসেছেন, তিনি এসেছেন। সমগ্র উড়োজাহাজভুবন যেন জেগে উঠল। তিনি এসেছেন।

অচিরেই জানা গেল একজন মহান রাজপুরুষের জন্য এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছিল এই বিদেশি কোম্পানির জাহাজখানি। জাহাজসুদ্ধ এবার আন্দোলন শুরু হলো। পুরুষশ্রেষ্ঠ আমার পাশেই আসন গ্রহণ করলেন।

salehmahmoodriadh@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads