• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
যেতে হবে জনগণের কাছে, বিদেশিদের কাছে নয়

জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

যেতে হবে জনগণের কাছে, বিদেশিদের কাছে নয়

  • প্রকাশিত ২১ মে ২০১৮

গত ১৩ মে ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আবারো বৈঠক করেছে বিএনপি। খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ প্রভাবশালী ১৪টি দেশের মিশনপ্রধান বা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকের বিষয়ে বিএনপি কোনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেনি। বিদেশি কূটনীতিকরাও কিছু প্রকাশ করেননি। তবে, বৈঠকসূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি তাদের দলীয় চেয়ারপারসনের জামিন তথা মুক্তিতে বিলম্ব, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি ও নিজেদের বক্তব্য কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরেছে। বিএনপি যেসব বিষয় কূটনীতিকদের অবহিত করেছে বলে খবরে বলা হয়েছে, তা যে এ দেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা জানেন না, তা নয়। তারা সব খবরই জানেন। কারণ, বিষয়গুলো প্রকাশ্য। তা সত্ত্বেও সেসব বিষয় ঘটা করে দাওয়াত দিয়ে এনে বিদেশিদের অবহিত করার প্রয়োজন বিএনপি নেতৃত্ব কেন অনুভব করলেন বোঝা গেল না।

এ বৈঠকের ফলাফল কী তা কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, এ ধরনের বৈঠক বিএনপি শুধু নয়, বিভিন্ন সময়ে দেশের অন্য প্রধান দলটিও করেছে। এ ধরনের বৈঠক করে বিদেশি শক্তির সহানুভূতি অর্জন করা যায় কি না, বা তা অর্জন করা গেলেও তাতে কোনো কাজ হয় কি না কারো জানা নেই। কেননা, অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটে বিদেশিদের তৎপরতা বা দূতিয়ালি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ধরনা দেওয়ার বিস্তর নজির থাকলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার কোনো নজির নেই।

১৯৯৫-৯৬-এর কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। সে সময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিসহ সব দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। আর বিএনপি ছিল সংবিধান অনুযায়ী তাদের সরকার ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল। সে সময় আমরা দেখলাম বিদেশি মিশনগুলোকে সরব হয়ে উঠতে। তারা নানা ধরনের তৎপরতা চালাতে থাকল সমস্যা সমাধানের জন্য। সেসব তৎপরতার ধারাবাহিকতায় ঢাকায় এসেছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ানসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতা। কিন্তু ফয়সালা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত রাজপথেই। সব সালিশি-দূতিয়ালি ফেল করার পর ওই সময় আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জাতীয় পার্টির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি সরকার। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন বিএনপি করেছিল, সে নির্বাচনে গঠিত সংসদেই পাস করানো হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত নিতে হয়েছিল আমাদের রাজনীতিকদেরকেই। বিদেশিরা সে সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০০৬ সালে। বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা নিয়ে বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরোধ যখন তুঙ্গে, সে সময় সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজকে নিয়ে সৃষ্টি হয় আরেক জটিলতা। সবকিছু মিলিয়ে যখন দেশের রাজনৈতিক আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, তখন আবার বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেল। ‘একটি সুষ্ঠু সমাধান’ করার জন্য তাদের ওয়াজ নসিহত দেশবাসীকে শুনতে হলো। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ফয়সালা হয়েছিল রাজপথেই। তবে, সেবার ফলাফল হয়েছিল ব্যতিক্রমী। সঙ্ঘাতপূর্ণ ও অস্থির পরিস্থিতির সুযোগে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত সেনা হস্তক্ষেপ। ‘লাইনচ্যুত’ দেশ নামক ট্রেনটিকে লাইনে তুলতে ক্রেন হয়ে আসেন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ ও তার সহযোগীরা। তার পরের ঘটনা সবারই জানা। সেই জরুরি অবস্থার স্মৃতি এখনো এতটাই তরতাজা যে, তা নতুন করে বিস্তারিত আলাপ নিষ্প্রয়োজন। সেবারও কিন্তু বিদেশিরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান করে দিতে পারেনি। যদিও কথিত আছে যে, জরুরি অবস্থা জারির প্রেসক্রিপশনটিও ছিল বিদেশি শক্তির দেওয়া।

২০১৪ সালের নির্বাচন। সে নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। নির্বাচনটি বর্জন করে বিএনপি সঠিক কাজ করেছে, নাকি ভুল করেছে সে বিতর্ক এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। ওই সময়েও দেখা গেছে বিদেশি শক্তিকে তৎপর হয়ে উঠতে। অনেক বৈঠক হলো, অনেক দৌড়ঝাঁপ হলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি করেই ফেলল আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি বলে ভোটারবিহীন নির্বাচন। অমূলক নয় সে অভিযোগ। কিন্তু রাজনীতিতে অভিযোগের কানাকড়িও মূল্য নেই, যদি সে অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু একটা আদায় করে নেওয়া না যায়। এখানে যেটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশিদের তৎপরতা কখনোই ইতিবাচক ফল এনে দেয়নি। তারপরও আমাদের রাজনীতিকরা কেন এ বিষয়ে বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তা বোধগম্য নয়।

আমরা একটি স্বাধীন জাতি। আমাদের অনেক দুর্বলতা থাকতে পারে। তাই বলে নিজেদের কাজ নিজেরা না করে অন্যের মুখাপেক্ষী কেন হব? বিশেষত আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার বেলায় বিদেশিদের হস্তক্ষেপ সাম্প্রতিক সময়ে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এ বিষয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ পরস্পরকে অভিযুক্ত করে থাকে। একদল আরেক দলকে বিদেশিদের লেজুড়বৃত্তি, তল্পিবাহক ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পিছপা হয় না। অথচ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেউ কারো চেয়ে কম যান না। এখন যেমন বিএনপি দিচ্ছে, একসময় আওয়ামী লীগও দিয়েছে।

বিদেশি শক্তির এ নাক গলানোর চেষ্টা প্রকট হয় আমাদের দেশে যখন রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠে তখন। সরকার এবং বিরোধী দল দু’পক্ষই বিদেশি আনুকূল্য পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তারা বিদেশিদের কাছে একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে এতটাই কাতরতা প্রকাশ করেন যে, তা সচেতন নাগরিকদের আত্মমর্যাদায় ঘা দেয়। বড়জোর যুগ্মসচিব পদমর্যাদার বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে কাতর কণ্ঠে মিনতি জানাতে তাদের বাধে না। যার কাছে একসময় একই পদমর্যাদার কূটনীতিকরা ক্রেডেন্সিয়াল পেশ করত, কিংবা তার এপয়েন্টমেন্ট পাবার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করত, তিনিই যখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য সেই কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেন, তখন জাতির অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হিসেবে কষ্টটা বেশ অনুভব করি।

বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গেই কথা বলে দেখেছি। সবাই এটাকে এক ধরনের হীনমন্যতা এবং নিজেদের ওপর আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ বলে অভিমত দিয়েছেন। তারা প্রশ্ন করেছেন, কেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেবেন? কূটনীতিকরা আমাদের দেশে তাদের স্ব স্ব দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তারা তো আমাদের গার্জেন নয় যে, সমস্যা সমাধানে তাদের কাছে নালিশ করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটি কথা বিএনপি এখনো সগর্বে প্রচার করে থাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই।’ তার এ কথার মর্মবাণী কি বিএনপি বিস্মৃত হয়েছে? বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বনির্ভরতার প্রবক্তা। অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বনির্ভরতার কথাও তিনি অনেকবার বলেছেন। অথচ তারই প্রতিষ্ঠিত দল আজ বিদেশি কূটনীতিকদের দাওয়াত করে এনে নিজেদের অক্ষমতার জানান দেয়। অক্ষমতার জানান দেয় কথাটি কারো কারো কাছে খারাপ লাগতে পারে। তবে, আমার বিবেচনায় এক ধরনের অক্ষমতা থেকেই বিএনপি এখন পরমুখাপেক্ষী সংগঠনে পরিণত হতে চলেছে। বেগম খালেদা জিয়ার জামিন বা মুক্তি, কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে এ দেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের যে কিছুই করার নেই তা কি বিএনপি নেতৃবৃন্দ বোঝেন না? যদি বুঝে থাকেন, তাহলে কেন এ ব্যর্থ প্রয়াস?

যেকোনো দাবি আদায়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে হয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা, না হয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। তাহলে দাবি আদায়ের জন্য বিএনপির সামনে একটাই পথ খোলা আছে। সেটা হলো, তীব্র আন্দোলন, যে আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকারে বাধ্য হবে সরকার। কিন্তু যে প্রশ্নটি এ মুহূর্তে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো, সে ধরনের আন্দোলনের সক্ষমতা বিএনপির আছে কি না। বলাই বাহুল্য, গত নয় বছরের আন্দোলনের দৃষ্টান্ত সেরকম কোনো অভাস দেয় না। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বলেই তারা এখন রাজপথে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না- এমন অভিমত রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের। যদিও বিএনপি নেতারা তা স্বীকার করেন না। তারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন ভাব দেখান যে, তৎক্ষণাত সরকারের পতন ঘটিয়ে দিতে পারেন।

যাক, সেটা বিএনপির অভ্যন্তরীন বিষয়। তারা কীভাবে আন্দোলন করবে, রাজনৈতিক মাঠ দখলে নেবে, সে চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা করার অধিকার তাদের নিরঙ্কুশ। আমাদের বক্তব্য হলো, নিজেরা শক্তিমান হয়ে সক্ষমতা প্রদর্শন না করে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে নালিশ করে নিজেদেরকে ছোট করা কেন? আওয়ামী লীগ নেতারা তো হরহামেশাই বলে থাকেন যে, বিএনপি এখন বিদেশনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে। এসব কটাক্ষ শুনে বিএনপি সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা যে কষ্ট পান, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কি তা অনুধাবন করতে পারেন? পরিশেষে একটি কথা আবারো বলতে চাই, বিদেশিরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার কোনো সমাধান অতীতেও দিতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে এমন আশা না করাই শ্রেয়। বিএনপিকে যদি কিছু আদায় করতেই হয়, তাহলে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি আর জনগণের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে, বিদেশিদের ওপর নয়।

মহিউদ্দিন খান মোহন

সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads