• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ফেসবুক থেকে আমরা কী শিখছি

ফেসবুক এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ

ইন্টারনেট

মতামত

ফেসবুক থেকে আমরা কী শিখছি

  • প্রকাশিত ২২ মে ২০১৮

ফেসবুক নামের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারুণ্যের নতুন জানালা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফেসবুক সারাবিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। সৃজনশীল মুক্তচিন্তা বিকাশের যোগসূত্রও ফেসবুক। এই সৃজনশীলতার পাশাপাশি আবার অনেক ব্যবহারকারী নোংরামি, অশ্লীলতা, ভাষার বিকৃতি, ধর্মান্ধতা, অপপ্রচার এবং প্রতারণার সুযোগ গ্রহণ করছে। মনে রাখা দরকার, প্রযুক্তি আমাদের যেমন অনেক কিছু দেয় আবার অনেক মূল্যবান কিছু কেড়েও নেয়। প্রযুক্তির প্রয়োগটাই মোক্ষম বিষয়। ফেসবুকের অনেক কিছুই আমাদের চমৎকৃত করে। ভাবনার খোরাক জোগায়। আবার অনেক কিছুই বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক সৃষ্টি করে। ইয়াহু নিউজের এক খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি কোম্পানি এভিজি কর্তৃক অভিভাবকের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান যুগে অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানের ইন্টারনেট কার্যকলাপ নিয়ে চিন্তিত। সন্তানরা কী করছে সে বিষয়ে নজর রাখার জন্য প্রায় ৭২ শতাংশ অভিভাবকই তাদের টিনএজ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফেসবুকে ‘বন্ধু’ হিসেবে যুক্ত আছেন। এদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে ছয়জনই স্বীকার করেছেন, তারা তাদের সন্তানের অজান্তেই তাদের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করেন। এভিজির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২১ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের ফেসবুক প্রোফাইলে অবমাননাকর বার্তা বা অ্যাবিউজিভ মেসেজ পেয়েছেন। এ ছাড়াও ১৪ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা এ জাতীয় বার্তা তাদের টিনএজ ছেলেমেয়ের মোবাইল ফোনেও পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬১ শতাংশ মা-বাবাই সন্তানের ওপর নজরদারি করতে তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চোখ রাখেন। কেননা, ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৮ শতাংশই ইন্টারনেটে ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের সাইটে সক্রিয়।

এই ফেসবুকে আমরা অনেক বন্ধুর সৃজনশীল পোস্টগুলো দেখে অভিভূত হই। কী অসাধারণ সংগ্রহ এবং আইডিয়া তাদের! মুহূর্তে যেন মনকে নিয়ে যায় দুরন্ত শৈশবে, বাঁধভাঙা কৈশোরে, উদ্দীপিত যৌবনে। আমাদের বোধ এবং ভাবনার দরজায় যেন কড়া নাড়ে একেকটি ছবি। কখনো একটি ছোট্ট কথা অনেক কথার মালা হয়ে অনেক চেনা বিষয়কে নতুন করে চিনিয়ে দেয়। গ্রাম বাংলা, আমাদের চিরায়ত সভ্যতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে বিরাট প্লাটফরম হিসেবে কাজ করছে এই ফেসবুক। পাশাপাশি অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকেও মুক্ত থাকতে পারছি না আমরা। অশ্লীলতা, ধর্মান্ধতা এবং অপপ্রচারের কালো থাবা থেকেও রক্ষা পাচ্ছেন না ফেসবুক ইউজাররা। অন্যায়ের প্রতিবাদে এবং ব্যাপক জনমত সৃষ্টিতেও অতুলনীয় এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এবার ফেসবুকের একটি আজব সত্য ঘটনা শুনুন। রয়টার্স জানিয়েছে, নিজের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ফেসবুকের মাধ্যমে ১৬ বছরের এক ডাচ তরুণী আমন্ত্রণ জানায় প্রায় ৩০ হাজার ফেসবুক বন্ধুকে। এই আমন্ত্রণ বিরাট বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ডাচের ছোট্ট হারেন শহরে। মাত্র ১৮ হাজার অধিবাসীর এই ছোট্ট শহরে আমন্ত্রিত হয়ে হাজার তিনেক বন্ধুর আগমনে শহরের পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তত ৬০০ দাঙ্গা পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছে। ডাচ তরুণীর আমন্ত্রণপত্রটি ‘প্রাইভেট’ অপশন সেট করতে ভুলে যাওয়ার কারণে আমন্ত্রণটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩০ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটায়।

ফেসবুক এখন কেবল সামাজিক যোগাযোগ নয়, চাকরির বাজারেও সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের গবেষণায় ফেসবুক অ্যাপ ইকোনমি নামে নতুন অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই লাখ মানুষ কর্মক্ষম হয়ে উঠেছে ফেসবুকের কল্যাণে। অপরদিকে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রকট আকার ধারণ করছে পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমেরিকান একদল আইনজীবী পরিবারতন্ত্রের ধসের কারণ হিসেবে সরাসরি ফেসবুককেই দায়ী করেছেন। তারা বলেন, এখনকার ২৫ শতাংশ বিচ্ছেদ ঘটছে ফেসবুকের কারণে। আবার স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটিতেও আঘাত করছে ফেসবুকের ব্যবহার। এর ফলে স্বামী-স্ত্রী সন্দেহবাতিক হয়ে উঠছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ল্যারি রোজেন এক বিবৃতিতে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার মানুষের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার পরিসরকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন ঘটনাও দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহার করছে ঠিকই কিন্তু তার ব্যক্তিগত কিছু যেগুলো নিতান্তই জীবনের জন্য প্রয়োজন সেগুলোর কথা ভুলে যাচ্ছে সে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মনোচিকিৎসক দল তরুণ-তরুণীর ওপর চালানো জরিপে দেখে, যারা নিয়মিত ফেসবুকে ঢুঁ মারছে তাদের ধূমপান করার প্রবণতা অনিয়মিতদের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। এরা অ্যালকোহল, গাঁজাসহ অন্য মাদক গ্রহণেও ঝুঁকে পড়ছে। এ ধরনের প্রবণতা বাড়ার কারণ হচ্ছে, সাধারণত এ সাইটগুলোতে কোনো ধরনের সুপরিকল্পিত নিয়মনীতি থাকে না। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্পর্ককে এ ধরনের কমিউনিকেশন আরো সহজ-সাবলীল করে তুলেছে। উইল্টারশায়ারের সেন্ট ম্যারিস ক্লেইন বিদ্যালয়ের হেলেন রাইট নামে এক শিক্ষিকা ডেইলি মেইলকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সেলিব্রেটিরা উঠতি বয়সী মেয়েদের নির্দয় বানাচ্ছে। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত এসব সাইটের বিভিন্ন পোস্ট, স্ট্যাটাস, মন্তব্য, টুইট, অসংলগ্ন আলাপ, বিকৃত ভাষার ব্যবহার, বন্ধুদের দীর্ঘ তালিকা তরুণীদের মূল্যবোধকে সহজেই পরাস্ত করছে।

অন্যদিকে ফেসবুক ব্যবসায়ীদের কাছে পছন্দের বিজ্ঞাপন প্রচারমাধ্যম। কোন ব্র্যান্ড ঠিক কতটা জনপ্রিয়, তারও একটা হিসাব পাওয়া যায় এখান থেকে। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, যে ব্র্যান্ডে যত বেশি সংখ্যক ‘লাইক’ পড়ে, সেই ব্র্যান্ড ততটাই জনপ্রিয় বলে গণ্য করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিও এক ধরনের পরোক্ষ বিজ্ঞাপন। আরো বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীর নজর কাড়তে ফেসবুকে নিজেদের জনপ্রিয়তম ব্র্যান্ড হিসেবে দেখাতে এক মাত্র ভরসা ‘লাইক’ বোতাম। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, বিজ্ঞাপনের জন্য ‘লাইক’ বোতামটির অসাধু ব্যবহার করছে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নানা রকম ভুয়া উপায়ে তারা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছে ফেসবুকে। অনেক সময় আবার ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে একই ব্যক্তিকে দিয়ে একাধিক বার ‘লাইক’ করানো হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডকে। তাতেই বেড়ে যাচ্ছে লাইকের সংখ্যা। ফলে বাড়ছে ভুয়া জনপ্রিয়তা। গবেষণা সংস্থা ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস’-এর তথ্য বলছে, ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোতে অধিক সময় কাটানো তরুণদের জন্য স্থায়ী হতাশা বা মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। ফেসবুক কেন মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা তৈরি করছে, সে বিষয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তারা দেখেছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বেশি সময় পার করা মানেই মনের বিষণ্নতা বেড়ে যাওয়া। গবেষণার ফল বলছে, জীবন নিয়ে বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীই হতাশ। অধিকাংশের ধারণা, তাদের চেয়ে বন্ধুরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন। এ কারণে হীনমন্যতায় ভোগেন তারা। এ মনোভাব তাদের আরো বেশি করে অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে উৎসাহ জোগায়। আরেকটি জরুরি খবর দিয়ে লেখাটি শেষ করব। এত দিন মা-বাবা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা যে কথাটি বলতেন, এখন তার সঙ্গে একমত গবেষকরাও। অহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক জানান, যারা নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করে, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্টে তারা এগিয়ে থাকে। আমেরিকান এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে বার্ষিক সভায় উপস্থাপিত রিপোর্টে বলা হয়, গবেষণাটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর করা হলেও, শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ওই একই। এই সংস্থার গবেষক আরিন বলেছেন, ‘প্রতিটি প্রজন্মেই থাকে ধ্বংসাত্মক একটি কাল যন্ত্র। এই যুগে যা ফেসবুক নামে এসেছে। এটা অন্যসব ধ্বংসাত্মক রূপ থেকে ভিন্ন রূপে এসেছে।’ যাই হোক আমরা ফেসবুক থেকে ভালো কিছু শিখতে চাই, শেখাতে চাই। জানতে চাই, জানাতে চাই।

এস এম মুকুল

সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads