• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
জ্ঞানের জন্য চাই অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন

ক্ষমতার দাপটে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

জ্ঞানের জন্য চাই অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৮

খবর এসেছিল রুপার। না, রুপা আত্মহত্যা করেনি। উচ্চশিক্ষিতা দুঃসাহসী মেয়ে, রাতের বেলা বাসে করে যাচ্ছিল কর্মস্থলে। সহযাত্রীরা একে একে নেমে গেছে। একা পেয়ে বাসের তিনজন হেলপার চলন্ত বাসে তাকে ধর্ষণ করে। বাসে ড্রাইভার ছিল, দেখেও দেখেনি। সুপারভাইজর ছিল; নাকি সে ঘুমাচ্ছিল। বাঁচার জন্য রুপা কান্নাকাটি করেছে, টাকা সেধেছে। তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা ছিল, ধর্ষকরা সেটা নিয়ে নিয়েছে; মোবাইল ছিল, সেটাও নিয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ করতে ভোলেনি। কাজ শেষে ঘাড় মটকে রুপাকে তারা মেরে ফেলে; গৃহস্থ যেমন মারে পোষা মুরগিটাকে; তারপর জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় ঝোপের ভেতর। হেলপারের কাজ হেলপ করা, নারী যাত্রীদের ব্যাপারে তাদের কাজ উল্টো রকমের। সুপারভাইজর যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখবে। সে চোখবুজে পড়ে ছিল। ড্রাইভারের দায়িত্ব সার্বিক নিরাপত্তাদানের; সে বাসের গতি কমিয়ে দিয়েছিল, ধর্ষকরা যাতে মরা মেয়েটির লাশ ফেলে দিতে পারে। এরা সবাই একদিকে, এদের ক্ষমতা আছে, এরা বেটাছেলে। ব্যবস্থাটা বেটাছেলেদের পক্ষে, মেয়েদের বিপক্ষে। জানা গেছে, বাসটির মালিক একজন মহিলা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এসব ক্ষেত্রে কর্মচারী মালিকের চেয়ে ক্ষমতাশালী যদি সে বেটাছেলে হয়। ক্ষমতার দাপটে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, ঘটতে থাকবে; যত দিন না ব্যবস্থাটা বদলাচ্ছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া চাই, কিন্তু তাতে কুলাবে না। চলন্ত বাসে একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিল ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। তাতে সমস্ত ভারত কেঁপে উঠেছিল। ঝাঁকুনি-দেওয়া প্রতিবাদ হয়েছে। একই ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটছে, একই ব্যবস্থার অধীনে; কিন্তু এখানে প্রতিবাদ নেই। দুর্দশায় আমরা ভিন্ন নই, প্রতিবাদে ভিন্ন। দুর্দশাকে আমরা মেনে নিয়েছি। আমাদের অবস্থান অনেক নিচুতে। রুপা হত্যার দিনেই শ্রীপুরে পাঁচ বছরের নাতনিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে তার আপন নানা (সমকাল, ০৫-০৯-১৭)।

অসুখের বিস্তার বাড়ছে, বাড়তেই থাকবে, যদি না পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পাল্টা ব্যবস্থা দুঃখ প্রকাশ ও নিন্দাজ্ঞাপন নয়; পাল্টা ব্যবস্থা পুকুরের পচা পানি বদলে ফেলা। দেশে এমন রেকর্ড-ভাঙা বন্যা ঘটেছে; এই প্লাবন তবু নামে, দূষিত পুকুরের পানি নামে না, সে আরো পচতে থাকে। তাকে বদলানোর ব্যবস্থা করা চাই। খুচরো অপরাধীদের শাস্তি চাই, কিন্তু মূল অপরাধীকে যেন না ভুলি, তাকে বদলে ফেলে নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বপালনকে যেন অবজ্ঞা না করি।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম দৌরাত্ম্য এখন বাংলাদেশে। এখানে কোনো মানুষই সন্তুষ্ট নয়। এমনকি বিত্তবানরাও নয়। তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, কিন্তু সে গাড়ির গতি নেই, রাস্তায় বের হলেই আটকা পড়তে হয়, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মতোই; যেন শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি। আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা শহর ইতোমধ্যে বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। জরিপ বলছে, বসবাসযোগ্যতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বের ১৪০টি রাজধানী শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান একেবারে সর্বশেষে নয়, তবে খুবই কাছাকাছি। স্থান তার ১৩৭তম; সর্বনিম্নে রয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, যেখানে এখন ভয়াবহ একটি যুদ্ধ চলছে। ঢাকায় যুদ্ধ নেই, কিন্তু যুদ্ধাবস্থার বিড়ম্বনাগুলো সগৌরবে বিরাজ করছে। এর মধ্যেই উন্নতির গল্প শোনা যায়। শোনানো হয়। বলা হয় আয় বাড়ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরার মধ্যেও অর্থনীতির যেটুকু উন্নতি তার রহস্যটা পুঁজিওয়ালাদের তৎপরতার জমা-খরচের খাতাতে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে মেহনতি মানুষের শ্রমের অলিখিত দিনলিপিতে। জরিপ বলছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। উন্নতির সৌধ যখন মেহনতি মানুষের বুকের পাঁজরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবার ভরসা পায়, তখন সে শনৈঃ শনৈঃ উপরমুখো হবে না কেন?

মানুষ এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। মুক্তির জন্য সে লড়েছে। কিন্তু সে লড়াই সমাজের কাঠামোতে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি। সমাজকাঠামো রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। রাষ্ট্রের আয়তন বিলক্ষণ ছোট হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরকার শোষণ-নিপীড়ন এক চুলও কমেনি, উল্টো বেড়েছে। বাড়তে পেরেছে, কারণ মুক্তির আন্দোলন সমাজতন্ত্রীরা করছে ঠিকই, বস্তুত তারাই ছিল চালিকাশক্তি, কিন্তু শাসনক্ষমতা রয়ে গেছে পুঁজিবাদীদের হাতেই। পুঁজিবাদে দীক্ষিত জাতীয়তাবাদীরা বেশে ও ছদ্মবেশে সামনে থেকেছে আন্দোলনের এবং জনগণের আন্দোলনে-অর্জিত সুফল তারা মহানন্দে নিজের গোলায় তুলেছে। আত্মত্যাগ জনগণের, স্ফীতি পুঁজিবাদীদের। সব সুবিধা ধনীদেরই।

বিশ্বজুড়ে এখন পুঁজিবাদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য। মানুষের সভ্যতা অপেক্ষায় আছে মৌলিক পরিবর্তনের। সে পরিবর্তন পুঁজিবাদের ভেতরে থেকে আসাটা একেবারেই সম্ভব নয়। নৈতিক জোর হারিয়ে পুঁজিবাদ এখন পৈশাচিক শক্তি দেখাচ্ছে। মুখোশ বদলাচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না, মুখটা তার অনেক অনেক বড়, মুখোশগুলোর তুলনায়। সে মুখ অত্যন্ত বীভৎস। রক্তরঞ্জিত।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব দেশে মানুষ এখন লড়ছে। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদকে ভেঙে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে মানুষের পরিত্রাণ নেই; শিশুরা নিরাপত্তা পাবে না, দুর্বলের ক্রন্দন থামবে না, অন্ধকার ঘুচবে না; মানুষ উৎপাটিত হবে জন্মভূমি থেকে পরিণত হবে ভিক্ষুকে; প্রকৃতি বিপন্ন হতেই থাকবে, এবং প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে মানুষের ওপর, যেমনটা নেওয়া ইতোমধ্যেই সে শুরু করেছে। বাঁচার জন্যই পৃথিবীটাকে বদলানো চাই। লড়াইটা বাংলাদেশেও চলছে। কিন্তু তাকে তীব্র, সুসংগঠিত ও ক্রমাগ্রসরমাণ করা দরকার। এগোতে হবে, পরিত্রাণের লক্ষ্যে।

এ বছর অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে। উদ্যাপন বিশ্বের সর্বত্র হবে, বাংলাদেশেও হবে। অক্টোবর বিপ্লবের মূল কথাটা ব্যক্তি মালিকানাকে হটিয়ে দিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। সেটা যে অলীক কোনো সুখ-কল্পনা নয়, বাস্তবে যে তাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব- তার পথও ওই বিপ্লব দেখিয়েছে। সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের। শিক্ষা এটাও যে, আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু অভাব ঘটবে না সাংগঠনিক শক্তির। এর বাইরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অনুনয়-বিনয়, আবেদন-নিবেদন, কান্নাকাটি, মাঝেমধ্যে মিছিল-মিটিং করাতে কুলাবে না। ঘরে বসে কটুকাটব্য করা, কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভে সুবিধা হলেও সমাজ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে না। পরীক্ষিত সত্যটা তো এই যে, স্টিম ছাড়তে দেওয়ার বন্দোবস্ত বিপ্লবকে সহায়তা দেয় না, বাধাগ্রস্তই করে।

কুকাজে বিপর্যস্ত বিশ্বে সবচেয়ে বড় ও ভালো কাজ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনায় সচেষ্ট হওয়া। এই কাজের জন্য মানুষ প্রস্তুত আছে, কিন্তু এই কাজে মানুষকে ডাক দেবার মতো রাজনৈতিক আন্দোলন এবং সংগঠন নেই। জীবিকার জন্য কাজ করাটা অপরিহার্য কর্তব্য; পুঁজিবাদী বন্দোবস্তে তেমন কাজেরও অভাব। আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ এখন বেকার। এই বেকাররা কুকাজ করে। অপরাধী হয়, মাদকাসক্ত হয়, আত্মহত্যা করে, জঙ্গিও হয় কেউ কেউ। মানুষকে কাজ দেওয়া চাই, ভালো কাজ—যেমন জীবিকার কাজ, তেমনি জীবনের কাজ। জীবনের কাজটা হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বদলানো।

দু’শ বছর আগে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য যখন প্রত্যক্ষ হওয়া শুরু করেছে, তখন জনাথন সুইফটের পক্ষে কী করণীয় তা ঠিক করাটা সহজ ছিল না; কিন্তু ফরাসী বিপ্লব, প্যারি কমিউনের প্রতিষ্ঠা, অক্টোবর বিপ্লব এবং চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর মুক্তিকামী মানুষের জন্য করণীয়টা কী তা তো আর না-জানার কথা নয়। করণীয়টা জানতে না-পারাটা আসলে মস্ত বড় ব্যর্থতা।

ইতিহাসের অগ্রগমনে সমাজে বদল এসেছে। ব্যক্তিমালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত অতীতের দাস ও সামন্ত সমাজ বদলেছে, ব্যক্তিমালিকানার পুঁজিবাদী সমাজও বদলাবে; সামাজিক মালিকানার নতুন মানবিক বিশ্বের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী; প্রশ্ন হলো সেটা কত দ্রুত ঘটবে এবং কী রকমভাবে ঘটবে। নৈরাজ্যের ভেতর দিয়ে ঘটবে নাকি সৃষ্টিশীল ও পূর্বপ্রস্তুতির পথে ঘটবে। এই প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে মানুষের কাজের ওপর; সারা বিশ্বের এবং প্রতিটি দেশের। আমাদের দেশেরও। ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার এ লড়াইটা সহজ নয়। পুঁজিবাদ অনেক দক্ষ ও চতুর। তার শিকড় চলে গেছে সমাজের গভীরে, কায়েমি হয়ে রয়েছে অর্থনীতিতে, প্রবেশ করেছে মানুষের মস্তিষ্কে। পুঁজিবাদ ছাড় দেয়, সুবিধা দেয়, দলে টেনে নেয়, ভয় দেখায়; দমন-পীড়ন, গুম-খুন, সবকিছু করে। তার আছে সামরিক বাহিনী, হাতে রয়েছে মারণাস্ত্র। রয়েছে মাদক; আয়ত্তে রয়েছে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত শত্রুতা, নারীবিদ্বেষে প্রচারের কায়দা-কৌশল যন্ত্রপাতি। আছে মিডিয়া। মিডিয়া এখন অনেক আধুনিক ও ভীষণ চটপটে। এখন সে সর্বত্রগ্রাসী ও সর্বক্ষণ কর্মরত। মিডিয়ার ক্ষমতা অপরিসীম। রাতকে সে দিন এবং দিনকে সে রাত করতে পারে। সে কাজ করে পুঁজিবাদীদের হয়ে। তার সমস্ত প্রচারণা পুঁজিবাদের পক্ষে। কারণ পুঁজিবাদীরাই মিডিয়ার মালিক।

পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যে মানুষের স্বপ্নগুলোর অধিকাংশই এখন ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত এবং ভারাক্রান্ত। তার জায়গায় সমষ্টিগত মুক্তির স্বপ্নকে সামনে আনা চাই। পদক্ষেপ চাই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের। নইলে দুঃস্বপ্নের রাজত্ব শেষ হবে না। শেষ রাতটাই সবচেয়ে অন্ধকার থাকে, কিন্তু সামাজিক শেষ রাত্রি যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, কাজ চাই সে জন্য। এই কাজের একটি শর্ত জ্ঞানের চর্চা। জ্ঞান ভিন্ন বিজয় দ্রুত হবে না। বিকাশশীলও হবে না।

সমাজ-বদলের কঠিন কাজের সময় জ্ঞানের কথাটা যেন না ভুলি। ভ্রান্ত জ্ঞান বিপথগামী করার জন্য সব যুগেই তৎপর ছিল, অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে তার তৎপরতা মারাত্মকরূপে বৃদ্ধি ঘটেছে। জ্ঞান কেবল বই থেকে আসে না, আসে অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলন থেকেও।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads