• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ভিক্ষানৃত্যম ও ক্লাসিক্যাল আর্ট

ইতিহাস ও অর্থনীতির জগতে ভিক্ষুক ও ভিক্ষার বিশাল গুরুত্ব রয়েছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

ভিক্ষানৃত্যম ও ক্লাসিক্যাল আর্ট

  • সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
  • প্রকাশিত ৩০ মে ২০১৮

আমাদের হূদয়বতী ও হূদয়বান পাঠিকা-পাঠকগণ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের খবর’-এর নবম পৃষ্ঠায় ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে একটি ফিচারধর্মী রচনা নিশ্চয় পড়ে থাকবেন। না পড়লেও ক্ষতি নেই, রচনাটি দেখে থাকলেও চলবে। ভিক্ষুকদের নিয়ে কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হলেই বা কী আর না হলেই কী!

ভিক্ষুকদের নিয়ে যে যাই-ই ভাবুন না কেন... ইতিহাস ও অর্থনীতির জগতে ভিক্ষুক ও ভিক্ষার বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। স্বাধীনতার পর কেউ কেউ আমাদের অর্থনীতির দুরবস্থা দেখে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলত; আরো কী সব কথাবার্তা বলাবলি করত, সেসব কথা ভাবলে আজ আমাদের একটু-আধটু লজ্জাও হয়। বলা হতো আমরা নাকি ভিক্ষুকের...ইত্যাদি। ওই সব মুখে আজ ঝামা ঘষে দিয়েছি। আর কিছুদিন পর হয়ত আমরাই ওদের ভিক্ষুক বলে উল্লেখ করব। তবে অন্যদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবশত কোনো দরিদ্র বা ভিক্ষুককে কোনো প্রকার উপাধি প্রদান করতে চাই না। একইভাবে ভিক্ষুকদের প্রতি নির্মম ভাষা ও নির্দয় ব্যবহারকেও আমরা সমর্থন করি না।

বিষয়টি দুঃখের হতে পারে, আবার সুখেরও হতে পারে যে, পৃথিবীর প্রায় সব ধর্ম, ইতিহাস, নৈতিকতা ও সমাজতত্ত্ব ভিক্ষাকে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ভিক্ষাকে একটা ‘বৃত্তি’ রূপে ঘোষণা করে সমাজেও এর বিরুদ্ধে এক ধরনের নেতিবাচক ভাবের সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেক দল তো একেবারে ‘বিপ্লবী’ ভাষায় ভিক্ষাকে ‘পাপ’ পর্যন্ত বলতে কোনো দ্বিধা করেনি। ভিক্ষা করাকে পাপ-পুণ্যের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমরা ভিক্ষা ও ভিক্ষুককে পুরোপুরি অস্বীকার বা অগ্রাহ্য কোনোটাই করতে পারি না।

আবার ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ভিক্ষুকদের নিজেদের অভিমত তো রীতিমতো অতি উচ্চাঙ্গের। একজন ভিক্ষুক জানালেন, এ বড় নেশার বিষয়, ছাড়তে পারেন না। আরেকজন বলেন, বড় শ্রমের কাজ। ভিক্ষা যে একটি শ্রমসাধ্য, আয়াসসাধ্য কর্ম- এই অভিনব ধারণা তেমন করে কেউ বলতে পারেননি। তাপদগ্ধ রাজধানীর উত্তপ্ত মধ্যদুপুরে ঘর্মাক্ত দেহে অতিশয় বিরক্ত যাত্রী বা পথচারীর কাছে ভিক্ষা চাওয়া এবং অতঃপর সেই ভিক্ষা পাওয়া কি এতই সহজ কাজ? ট্রাফিকজ্যামে আটকে থাকা ক্ষুব্ধ যাত্রীর হূদয়ে করুণা বা বেদনার ঢেউ তুলে ভিক্ষালাভ তো রীতিমতো একটি ক্লাসিক উপার্জনের পর্যায়ে পড়ে। গভীর দুঃখের বিষয় এই যে, অর্থনীতিবিদরা আয়সৃষ্টিকারী এই আর্থনীতিক কর্মযজ্ঞটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী মুজবুক খানদার অবশ্য ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে আবিষ্কার করেছেন ফলিত শিল্পকলার এক ঐতিহাসিক অবদান। তিনি মনে করেন, মানবসভ্যতার সুপ্রাচীন অভিযাত্রার সঙ্গে ভিক্ষারও রয়েছে একটি ঐতিহাসিক বিকাশ ও সম্পর্ক। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, নৃত্যকলা ও নাট্যশাস্ত্রের আজকের পরিণতির পেছনে ভিক্ষা করার শিল্পনৈপুণ্যের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লক্ষ করলে দেখবেন, একজন ভিক্ষুক মাথা নুইয়ে, ঘাড় কাত করে, দেহটাকে কিছুটা ঝাঁকিয়ে কী এক অসম্ভব নতজানু ভঙ্গিতে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৃত্যশৈলীতেও আপনি এত নিপুণ দেহকৌশল দেখতে পাবেন কি না, সন্দেহ রয়েছে। এ-কথা বললে বড় বেশি বলা হবে না যে, ভিক্ষাকলা থেকেই জগতের সর্বপ্রকার নৃত্যকলার উদ্ভব ঘটেছে। পঙ্গু, অর্ধপঙ্গু, বিকলাঙ্গ, ভুয়া, কৃত্রিম যত প্রকার শারীরিক বিকৃতি আছে প্রায় সবই ভিক্ষুকদের মধ্যে দেখা যায়। এ-সব ভিক্ষুক নিজ নিজ দেহবিকৃতির বিচিত্র চিত্র তুলে ধরে ভিক্ষা চাওয়ার সময় যে ভঙ্গি করে তা হতে পারে এক মৌলিক নৃত্যছন্দ বা নৃত্যমুদ্রা। খানদারের প্রস্তাব : ওড়িশী, কথক, মণিপুরি, ভরতনাট্যম ইত্যাদি নৃত্যরীতির সঙ্গে যুক্ত করা হোক অনন্য সাধারণ নৃত্যরূপ, ভিক্ষানৃত্যম।

আর এ তথ্য প্রকাশ করা অতি আবশ্যক যে, নাট্যশাস্ত্র তথা অভিনয় শিল্পের সৃষ্টিই হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে। ভিক্ষুকদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত, করুণ দৃষ্টিতে একবিন্দু দয়া পাওয়ার আকুতি আর জীবনের ব্যর্থতার গ্লানি তুলে ধরার অভূতপূর্ব দৃশ্য- সব মিলিয়ে অভিনয় শিল্পের এক চূড়ান্ত প্রকাশ। ব্রেখট কিংবা শেকসপিয়র বা রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে ভিক্ষা শিল্পকলার প্রতি দৃষ্টি দিলে তাদের নাটকগুলোর চরিত্র হয়তবা আরো বাস্তব ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠত। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি বিশ্বব্যাপী নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসের কোথাও ‘অভিনয়কলায় ভিক্ষুক অবদান’ নিয়ে আলোচনা করা হয়নি; এমনকি টু শব্দটিও করা হয়নি। অথচ ভিক্ষুকদের এতদসংক্রান্ত ভূমিকা ঐতিহাসিক মূল্যায়নের দাবি রাখে।

এবার সঙ্গীতের প্রসঙ্গ যদি বলি তো পাঠক আমাদের বক্তব্য বিশ্বাসই করবেন না। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের সময় ভিক্ষুকগণ সম্মিলিতভাবে, একক কণ্ঠে, কখনোবা দ্বৈতকণ্ঠে বিভিন্ন সুর, তাল ও লয়যোগে ভিক্ষা-সঙ্গীত গেয়ে বেড়ান। এ রকম সঙ্গীত পৃথিবীর অন্য কোথাও গীত হয় বলে আমরা শুনিনি। বাংলার ভিক্ষুকগণ এই সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আমাদের ধারণা- একটি ঘরানারই সৃষ্টি করেছেন। আর সে কী বিস্ময়কর সুর ও বাণী। শুনলে পকেটের সব টাকা ফকিরের থালায় কখন যে চলে যায়... আপনি বুঝতেই পারবেন না। ভিক্ষা-সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় আপনি হারিয়ে যাবেন ইহলোক ছেড়ে পরলোকে। অতঃপর ঘরে ফিরবেন শূন্যহাতে। তখনো আপনার কানে ভেসে আসছে ভিক্ষুক ঐকতান— একটা ট্যাকা দেবেন বাবা আমারে, হাজার টাকা পাইবেন আপনি হাশরে। এ বিশ্বে কে ভিক্ষুক নয়? এ জগৎ ভিক্ষুকময়। তুমি ভিক্ষুক, আমি ভিক্ষুক, মনুষ্যমাত্রেই ভিক্ষুক। মানুষ তো কোন ছার, প্রাণিকুলের সকলেই ভিক্ষুক। বৃক্ষকুলেও ভিক্ষুকের অভাব নেই। মানুষের কথাই বলি। এই যে তোমরা প্রেম প্রেম করে সংসার উথাল-পাতাল করে চলেছ; এর মূলে ওই ভিক্ষা, প্রেমভিক্ষা। শ্রীমতী রাধিকা দেবীর প্রেমভিক্ষা নিয়ে তোমাদের আহ্লাদের সীমা নেই। এই নিয়ে কয়েক হাজার বইপুস্তক লেখা হয়ে গেছে। রাধাপ্রেমের বিচিত্রসব বর্ণনা শুনে মনে হয় এর চেয়ে বড় প্রেমভিক্ষা বুঝি এ পৃথিবীতে আর সৃষ্টি হয়নি। শ্যাম, শ্যাম করতে করতে রাধা সংসার ছেড়ে যমুনার দিকে ছুটে যাচ্ছেন আর শ্যামরূপী কৃষ্ণপ্রেমিক একখানা বাঁশি হাতে নিয়ে বাজিয়েই চলেছেন। রাধা কেঁদে কেঁদে আকুল, কেষ্ট পাত্তাই দিচ্ছেন না। তাই বলে হূদয়ঘটিত ভিক্ষাবৃত্তি অনুশীলন করার কোনো বাসনাই কি আপনার মনেপ্রাণে একটি বারের জন্যও দোলা দিয়ে যায়নি!

এসব জাগতিক প্রেমভিক্ষার পর্ব। পরজগতের জন্যও কি ভিক্ষা প্রার্থনার সুযোগ থাকবে? স্রষ্টা; সেই পরম মহানকে যিনি যে নামেই ডাকুন না কেন, তাঁর কাছে দয়া ও করুণা ভিক্ষা করেন না...এমন ধার্মিক পৃথিবীতে একজনও পাওয়া যাবে না। দেব-দেবতা থেকে শুরু করে আমাদের মতো অধম মানুষ পর্যন্ত সেই অচিনপরমের নিকট ভিক্ষা চেয়ে চেয়ে নাকের জল চোখের জল একাকার করে ফেলি। শাস্ত্রে আছে ঠিকঠাকমতো চাইতে পারলে ঈশ্বরও একেবারে উজাড় করে ভিক্ষা দেন। তাঁর ‘দয়া’ শব্দটি এখানে ‘ভিক্ষার’ সমার্থক।

ঘরে ঘরে ভিক্ষার ছড়াছড়ি। পত্নীর প্রণয় চেয়ে সকাতর অসহায় স্বামীর প্রেমভিক্ষাসহ আশ্রয় ও অনূভূতি ভিক্ষার দৃশ্য কোনো পতিমহাশয়কে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। বধূশাসিত সংসারে স্বামীগণ একমাত্র জীবিকা ‘ভিক্ষা’ দ্বারা জীবন চালিয়ে যান। পতিজীবন নির্বাহের নাকি এটাই উত্তম ব্যবস্থা।

তবে ভিক্ষুক নামক এক অসাধারণ সৃষ্টিশীল প্রজাতির টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে পথের ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে (লক্ষ করলে দেখবেন...আগের চেয়ে ভিক্ষুকসংখ্যা অনেক কমে গেছে)। মুজবুক খানদার জানালেন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ এবং তারপর মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দিকে ছুটে যাচ্ছি। অতএব, আমাদের সড়ক ও মহল্লা ভিক্ষুকেরাও এই অভিযাত্রার অংশীজন হিসেবে ভিক্ষা করতে অস্বীকার করবেন... এটাই অর্থনীতির সাধারণ রীতি। জনাব খানদারের কথায় নিশ্চয় যুক্তি আছে। কিছুদিন আগে জনৈক ভিক্ষুককে পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিলে তিনি তা গ্রহণে আপত্তি করেন। স্যার, আমরা আর দ্যাশ তরতর কইর্যা আগাইতেছে; আপনে অ্যাহনো পাঁচটেহা কোমরে লইয়া ঘুরতাছেন।

কুড়ি টাকার একখানা নোট দিয়ে কোনমতে পালিয়ে এসেছি।

লেখক : রম্য লেখক

salehmahmoodriadh@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads