• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
সত্য যে কঠিন...

উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য জীবন্ত আদর্শ সামনে রাখতে হবে

প্রতীকী ছবি

মতামত

সত্য যে কঠিন...

  • আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • প্রকাশিত ২৪ জুন ২০১৮

উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য জীবন্ত আদর্শ সামনে রাখতে হবে এবং আদর্শ-অভিমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অবলম্বন করে সামনে এগোতে হবে। আদর্শ কী, তা নিয়েও ভাবতে হবে। আদর্শের স্বরূপ বুঝতে হবে। মানুষ জন্মগতভাবে যে জীবন ও জীবন-পরিস্থিতি লাভ করে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। সে উন্নততর জীবন ও উন্নততর পরিবেশ আকাঙ্ক্ষা করে। ক্রমে অনেকে তাদের চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তি দিয়ে সম্ভবপর সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে উন্নত অবস্থার রূপ কল্পনা করে। উন্নত অবস্থায় মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও আনন্দের বিষয়ও থাকে। প্রকৃত-বাস্তবে অবস্থান করে মনে মনে তারা সৃষ্টি করে অভিপ্রেত কল্পিত-বাস্তব। কল্পিত-বাস্তবে মানুষ পৌঁছতে চায়। বহুজনের অভিপ্রেত এই কল্পিত-বাস্তব কখনো কখনো সর্বজনীন কল্যাণকামী কোনো কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রচেষ্টায় বিপুল অধিকাংশ লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য ও কাম্য রূপ নেয়। এভাবে মানুষের মনের জগতে যে বাস্তব রূপ নেয়, তাই আদর্শ। আদর্শ বাস্তব নয়, কল্পিত; আদর্শকে মানুষ বাস্তবায়িত করতে চায়। যারা সর্বজনীন স্বার্থকে কম গুরুত্ব দিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে, তারা সর্বজনীন আদর্শের বাস্তবায়নে বাধা দেয়। তাতে সর্বজনীন কল্যাণ ও আদর্শ বাস্তবায়নের পথে বিঘ্নসঙ্কুল ও সংঘাতময় হয়। ন্যায়-স্বার্থের সঙ্গে হীন-স্বার্থের বিরোধ চলে- তাতে জয়-পরাজয় ঘটে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার সাধনা ও সংগ্রামের ধারায় নানা জটিলতা আছে, উত্থান-পতন আছে, পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশ আছে। উপযোগবাদ, দৃষ্টবাদ, বিবর্তনবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি এভাবেই সৃষ্ট আদর্শ। সর্বজনীন কল্যাণে আদর্শ অবলম্বন করে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। এর বিপরীত দিকও আছে। সর্বজনীন কল্যাণের বিরুদ্ধে হীন-স্বার্থবাদীরা কাজ করে চলে। গোটা ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় হীন-স্বার্থবাদীরা সংখ্যায় অল্প হয়েও প্রবল আর জনসাধারণ সংখ্যায় অনেক বেশি হয়েও দুর্বল। জনসাধারণ প্রবল হয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ঐক্যের জন্য দরকার হয় আদর্শ, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কর্মনীতি। সেই সঙ্গে দরকার হয় মহান নেতৃত্ব। জনসাধারণকে উদ্যোগী হয়ে মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়, মহান নেতৃত্ব আপনিতেই হয় না। যে জনসাধারণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনসাধারণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে। জনচরিত্র উন্নত হলে নেতৃত্বের চরিত্রও উন্নত হয়, আর নেতৃত্বের চরিত্র উন্নত হলে জনচরিত্রও উন্নত হয়।

সবসময় ইতিহাসের চর্চা করতে হয়। মহান নতুন যুগ সৃষ্টির জন্য ভবিষ্যতের পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেও পরিবর্তন করতে হয়। মনকে প্রচলিত ধারণায় আচ্ছন্ন রেখে উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির দিকে এগোনো যায় না। প্রত্যেক জেনারেশনকেই তার ইতিহাস নতুন করে জানতে হয়, রচনা করতে হয়। ভালো জীবনযাপনের জন্য আদর্শ চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস চর্চাও অপরিহার্য।

চারপাশে কখনো কখনো ভুল, মিথ্যা ও অন্যায়ের ছড়াছড়ি দেখা যায়। সামাজিক পরিবেশকে যথেষ্ট ভালো অবস্থায় কদাচিৎ কোথাও পাওয়া যায়। আজকের পৃথিবীতে আমরা সে রকম অবস্থা পাচ্ছি না। হীন-স্বার্থপরতা, জুলুম-জবরদস্তি, সামাজিক শিথিলতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, হত্যা-আত্মহত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, গণহত্যা ও নিরাপত্তাহীনতা সবার জীবনকেই অস্বাভাবিক করে রেখেছে।

বাংলাদেশে প্রবলদের দিক থেকে অপব্যবস্থা, দুর্নীতি ও জুলুম-জবরদস্তি আর দুর্বলদের দিক থেকে অপরাধ ও সন্ত্রাস অনেক বেড়ে গেছে। ক্লিনহার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদির নামে বিনাবিচারে হত্যা করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের ও অপরাধীদের। এতে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। বিপুল অধিকাংশ মানুষ দুর্বল, নির্জীব, নিস্পৃহ, প্রতিবাদহীন, সাহসহীন, শান্তিপ্রিয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই।

রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন উন্নত করে অন্যায় কমালে এবং ন্যায় বাড়ালে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাতে অপরাধ কমবে এবং সন্ত্রাস দূর হবে। জীবন অনেক ভালো, অনেক সুন্দর, অনেক সমৃদ্ধ ও সম্প্রীতিময় হয়ে উঠবে।

ধর্মের নামে মিথ্যা ও অনাচার, গণতন্ত্রের নামে মিথ্যা ও অনাচার, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যা ও অনাচার জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিকৃত করে। ধর্মের অলৌকিক বিষয়গুলোকে আলাদা করে রেখে ধর্ম ও আদর্শকে তুলনা করলে প্রকৃতিগত দিক দিয়ে দুটোকে এক রকম মনে হয়। স্থান-কাল-পাত্রের পার্থক্য দুই ক্ষেত্রেই আছে।

আজকের পৃথিবীতে কার্যকর কোনো আদর্শ নেই, নীতি নেই, পরিকল্পনা নেই, কর্মসূচি নেই। হীন-স্বার্থবাদীরা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদকে জনগণের জন্য অর্থহীন করে ফেলেছে।

অত্যুন্নত প্রযুক্তি নিয়ে সবাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছে- বিচার-বিবেচনা নেই, পরিণামদর্শিতা নেই। এই অবস্থা থেকে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল অবস্থায় উত্তরণের জন্য দরকার নৈতিক জাগরণ এবং আদর্শ ও কর্মসূচি উদ্ভাবন। কর্মসূচি অবলম্বন করতে হবে। মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে।

আদর্শের কথাটা আবার একটু বলি। আদর্শ বাস্তব নয়। আদর্শ হলো অভীষ্ট কল্পিত উন্নত বাস্তব। অস্তিমান বাস্তবে অবস্থান করে সবচেয়ে উন্নত যে বাস্তবে মানুষ উত্তীর্ণ হতে চায়, আদর্শ হলো সেই বাস্তব। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র- এগুলো বাস্তব নয়, আদর্শ। সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে সুন্দর যে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা মানুষ কামনা করে, তারই কল্পিত রূপ হলো গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র- যা দার্শনিকদের রচনায় এবং অনেকের চিন্তায় ও আবেগে আছে। বাস্তবতাবর্জিত উদ্ভট কল্পনা নয়; বাস্তবভিত্তিক বাস্তবায়নসম্ভব কল্পনা। বিকাশশীল মানুষই এগুলোকে বিকশিত করে। কল্পনা ও আদর্শ ছাড়া জীবন অর্থপূর্ণ হয় না। ভালো জীবন ও ভালো পরিবেশের জন্য সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি এসবের গভীর উপলব্ধি ও অবলম্বন দরকার। নানা দল-মত থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, সেই সঙ্গে সবার মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও সম্প্রীতির মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।

তবে এটাও বুঝতে হবে যে, হীন-স্বার্থবাদী প্রবলেরা আদর্শের ধার ধারে না। আদর্শ জনগণের ব্যাপার; জনগণ জাগ্রত ও সক্রিয় থাকলে, জনগণের থেকে জনগণের কল্যাণে কাজ করার নেতৃত্ব থাকলে আদর্শ কার্যকর থাকে। জনগণ ঘুমিয়ে পড়লে আদর্শ অকার্যকর হয়ে যায়। হীন-স্বার্থবাদীরাও আদর্শের কথা প্রচার করে, একটু বেশি করেই প্রচার করে। তারা এটা করে জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের অনুচিত স্বার্থ হাসিল করে নেওয়ার জন্য। হীন-স্বার্থবাদীদের পরাজিত রেখেই আদর্শকে কার্যকর রাখতে হয়।

Honesty is the best policy. Live and let other live. Love and be loved. To know all is to pardon all. জীবনযাত্রায় এসব নীতি সবাইকেই অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সবার মধ্যে এসব নীতির উপলব্ধি না থাকলে শান্তি থাকে না, সংঘাত-সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিগ্রহ বিরাজ করে।

মানবজাতি এখন মূলত সংঘাত-সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয় (১৯৯১) পর্যন্ত কালে হীন-স্বার্থবাদীদের চিন্তা ও চেষ্টা যাই হোক, সাধারণভাবে মানবজাতির মধ্যে প্রগতির চেতনা ও আগ্রহ ছিল। এখন তা নেই। এভাবে চলবে না; প্রগতির উপলব্ধি এবং উন্নত নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির চিন্তা, আবেগ, কর্মসূচি ও কর্মনীতি অবশ্যই আবার দেখা দেবে।

কর্তব্য পালন না করে কেউ উন্নতি করতে পারে না। উন্নতি আপনিতেই হয় না। উন্নতি সাধন করতে হয়। কেবল চিন্তা নয়, চিন্তার সঙ্গে কাজ চাই। আদর্শ, কর্মসূচি, কর্মনীতি ও কাজ উন্নতির ও ভালো জীবনযাপনের অপরিহার্য অবলম্বন। এসবকে বিবেচনায় না নিয়ে কেবল অর্থবিত্ত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তি অর্জন করে সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর জীবন-যাপন সম্ভব হয় না। সুস্থ, স্বাভাবিক সুন্দর জীবনযাত্রার জন্য একসঙ্গে অনেক কিছু করতে হয়। সমাজে মিথ্যার প্রবণতা প্রবল হলেও লোকে সত্যই অবলম্বন করতে চায়। মনে হয়, জনসাধারণের চেতনাপ্রবাহে সব সময়েই সত্যের প্রতি আকর্ষণ ফল্গুধারার মতো বহমান থাকে। সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব থাকলে মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেও সত্যের পক্ষে থাকে। সত্য কথাটির নানা অর্থ আছে, সত্য নিয়ে নানা বিতর্ক ও বিভ্রান্তিও আছে। কোন অর্থে সামাজিক ও জাতীয় জীবনে সত্য কথাটিকে আমাদের গ্রহণ করা উচিত, বর্তমান বিভ্রান্তির মধ্যে তা নির্ণয় করা সহজ কাজ নয়। যারা সমাজের অভিভাবক ও নেতা, তাদের কর্তব্য সবচেয়ে কল্যাণকর ধারণাটিকে নিজেদের মনে ও জনমনে জাগরূক রাখা। কিন্তু তারা কায়েমি-স্বার্থের ধারক-বাহক হলে তা হয় না। জনগণের ভেতর থেকে জনগণের দ্বারা গঠিত, জনকল্যাণে কাজ করার মতো নেতৃত্ব লাগবে। ভালো জীবনের দাবিতে সর্বাবস্থায় মানুষের মনে সত্যের ধারণা জাগরূক ও সত্যের প্রতি আকর্ষণ থাকতে হবে। সত্যের অর্থ নানা দিক দিয়ে সন্ধান করা যায় এবং সে-অনুসন্ধানের প্রয়োজনও আছে। এখানে নানা দিকে চিন্তাকে ছড়িয়ে না দিয়ে কেবল মূল দিকটিতে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মনোগ্রামে (১৯২১) লেখা ছিল, TRUTH SHALL PREVAIL. বাংলায় লেখা হতো, সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। সত্য বলে বোঝানো হতো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের সমন্বিত এক সত্তা। সে এক কল্পিত ধারণা- কল্পিত সত্তা। তা সত্ত্বেও লোকের বিশ্বাস ছিল যে, সব ভুল-ভ্রান্তি, অন্যায়-অবিচার ও ক্ষয়-ক্ষতি অতিক্রম করে অতি মন্থর গতিতে মানুষ এগিয়ে চলছে সত্যের দিকেই। অসত্য-অবলম্বীরা সাময়িকভাবে প্রবল হতে পারে, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় অনিবার্য। সত্য-অবলম্বীদের বিজয় অপ্রতিরোধ্য। সত্যের এই উপলব্ধি অস্তিমান ছিল মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত সত্তায়- প্রত্যেকের ও সকলের চেতনায়। হীনস্বার্থবাদীরা থাকত এর বাইরে, ইংরেজিতে truth-এরও এ রকম অর্থই করা হত। ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী- এ কথাটিও এদেশে চালু ছিল। লোকমুখে শোনা যেত, ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজে। এতে ধর্ম বলেও বোঝানো হতো পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের সমন্বয়ে সৃষ্ট পরম সত্তা। এক্ষেত্রে সত্য ও অসত্য এবং ধর্ম ও অর্ধম ছিল আন্তরিক বোধের ব্যাপার, বাইরে থেকে আরোপিত শাস্ত্রীয় কিংবা পার্বণিক ব্যাপার নয়। সত্য ও ধর্ম কথা দুটো ছিল সমার্থক। মানুষের নৈতিক চেতনাকে কার্যকর ও অপরাজেয় রাখার জন্য সত্য ও ধর্ম কথা দুটোতে সমাজ চূড়ান্ত গুরুত্ব দিত।

ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে জনগণের নেতা গান্ধী প্রচার করেছিলেন সত্যাগ্রহ এবং সেই সঙ্গে অহিংসা, সর্বোদয় ও অসত্যানুসারীদের সঙ্গে অসহযোগ। এ এক পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন, সমাজদর্শন, রাষ্ট্রদর্শন। সত্যাগ্রহের সত্যও সর্বজনীন পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের সমন্বয়ে উদ্ভাবিত পরম সত্তা। সত্যকে গান্ধী ঈশ্বরও বলেছেন। সত্য, ধর্ম, ঈশ্বর গান্ধীর কাছে ছিল এক ও অভিন্ন। গান্ধী তার জীবনব্যাপী কর্মধারাকে বলেছেন, My-experiment with truth.

সামাজিক জীবনে সত্য নির্ণয়ের একটি উপায় গণতন্ত্রের পদ্ধতি। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন নয়, আরো অনেক কিছু। গণতন্ত্রের জন্য দরকার সর্বোদয় অর্থাৎ নির্যাতিত-নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিতসহ সবার জাগরণ, উত্থান ও উন্নতি। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে চালানো হচ্ছে গণতন্ত্রবিরোধী সব কার্যক্রম।

গান্ধী মনে করতেন, মানুষ বুদ্ধিমান, বিবেকবান, চিন্তাশীল, কর্মঠ প্রাণী। তিনি আরো মনে করতেন, মানুষের নৈতিক চেতনা বিকাশশীল- জেনারেশনের পর জেনারেশনের চেষ্টার মধ্যদিয়ে মানুষ ক্রমেই পাশবিক প্রবণতা পরিহার করে মানবীয় গুণাবলিতে ঋদ্ধ, অহিংস ও সর্বজনীন কল্যাণে আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং সর্বজনীন কল্যাণের মধ্যেই সে নিজের কল্যাণও দেখবে। গান্ধীর ধারণা হয়েছিল যে, ক্রমে মানুষ হয়ে উঠবে নিরন্তর প্রগতিশীল। তার বিশ্বাস ছিল- সত্য, কিংবা ধর্ম, কিংবা ঈশ্বরকে অবলম্বন করে এগোতে এগোতে মানুষ পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করবে। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে মানুষ সত্যের পথ পরিহার করে চলবে এবং নৈতিক চেতনা হারিয়ে ফেলবে- এটা ভাববার সামর্থ্য গান্ধীর ছিল না।

গান্ধী রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। তার চিন্তায় ও আচরণে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। সেটা মুখ্য নয়, তার চিন্তার ও আচরণের মহান দিকটাই মুখ্য এবং সেটাই জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার মনোগ্রাম থেকে TRUTH SHALL PREVAIL বাতিল করে যখন একের পর এক ভিন্ন কথা গ্রহণ করতে লাগল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতিও বদলে যেতে লাগল। বাইরে জনজীবনেও ঘটে চলল পরিবর্তন। সত্যাগ্রহ, সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়সন্ধিৎসা, ন্যায়নিষ্ঠা, দূরদর্শিতা, সর্বজনীন কল্যাণবোধ কমে যেতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয় তার ঘোষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ল।

দুনিয়া পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে মানুষকে প্রগতির নীতি অবলম্বন করে চলতে হয়।

প্রগতি ও পরিবর্তন এক নয়। প্রগতি হলো এমন সামাজিক গতি, যা উন্নতির জন্য মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। প্রগতি স্বতঃস্ফূর্ত নয়, অর্জনসাপেক্ষ। প্রগতির কর্মনীতিতে ও কার্যক্রমে পর্যায়ক্রমিক উদ্দেশ্যনির্ণয় ও উদ্দেশ্যনিষ্ঠা থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে প্রগতির অর্থ নানাভাবে নির্ণয় করা হয়। এখানে আমরা সমাজপ্রগতি ও জীবননীতির কথা বলছি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ন্যাটো, জি-সেভেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালনায় বিশ্বায়ন নিয়ে মানবজাতি এখন প্রগতির পথে চলছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ও বহুত্ববাদ দুনিয়ার শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষের জন্য অকল্যাণকর।

এখানে আমি সত্যের কেবল একটি অর্থের কথাই বললাম। হীনস্বার্থবাদীরা নানারকম বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রচারে তৎপর আছে। মনে রাখতে হবে, হীনস্বার্থবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা সর্বজনীন কল্যাণের পরিপন্থী।

আমরা যদি সত্যকে জনসাধারণের নৈতিক চেতনার ওপর ভিত্তিশীল সর্বজনীন পরম ন্যায়, পরম কল্যাণ ও পরম সুন্দরের সমন্বয়ে সৃষ্ট পরম সত্তা রূপে হূদয়ঙ্গম করি এবং সত্যনিষ্ঠ হই- গান্ধীর ভাষায় সত্যাগ্রহী হই, কেবল তাহলেই সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী হবে। সত্যকে অবলম্বন করার এবং জয়ী করার স্থায়ী চেষ্টা সমাজে, জাতীয় জীবনে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় দরকার। প্রকৃতি বিকাশশীল, সমাজ বিকাশশীল, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশশীল। এ-অবস্থায় সত্যের ধারণাকেও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিশীলিত ও বিকশিত করা যেতে পারে। তবে তার প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হতে পারে, ঘন ঘন হবে না। জাতীয় জীবনে দরকার সর্বজনীন নৈতিক অনুশীলন। গণতন্ত্রের মর্মে সত্যকে অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। সত্যের ধারণাকে আমাদের প্রয়োজনে আমাদের নৈতিক সামর্থ্যের দ্বারা আমাদেরকেই সৃষ্টি করে নিতে হবে।

TRUTH SHALL PREVAIL, সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী- এই কথাটিকে বাংলাদেশে এবং দুনিয়াব্যাপী সব জাতির মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার জন্য দুনিয়াব্যাপী মানুষের নৈতিক চেতনার জাগরণ ও উন্নতি দরকার। তা করা না গেলে জুলুম-জবরদস্তি, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা, নিরাপত্তাহীনতা, অপব্যবস্থা ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেই থাকতে হবে।

দুনিয়া বিভক্ত হয়ে আছে প্রবল ও দুর্বলে- জালেম ও মজলুমে। মজলুমরাও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে কর্মসূচি, কর্মনীতি ও কার্যক্রম অবলম্বন করে- নেতৃত্ব সৃষ্টি করে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে। যে গণতন্ত্রে সত্যের ঘোষণা থাকে না, সতকে অবলম্বন করা হয় না, জনগণের জন্য তা অবশ্যই গণতন্ত্র নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠাকালীন মোটো ত্যাগ করেছে সত্যকে ত্যাগ করেছিল বলেই। সত্যকে পরম লক্ষ্য জ্ঞান করে সে চলতে পারেনি, চলতে চাইছে না, চলা সম্ভবপর মনে করছে না। দেশ-দুনিয়া বদলে গেছে। আজ পরিবর্তিত বাস্তবতায় নৈতিক শক্তি নিয়ে মানুষ যদি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারে- ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’ ‘TRUTH SHALL PREVAIL’. তাহলে সবাই শান্তিপূর্ণ সম্মানজনক জীবনের অধিকারী হবে। তাতে সে সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি, গোটা মানবজাতির প্রতি, সেই সঙ্গে নিজের প্রতি, আস্থা ও বিশ্বাস উপলব্ধি করবে এবং তার প্রকাশ ঘটবে ব্যক্তিজীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রব্যবস্থায়। সত্য তখন হয়ে উঠবে এক পরম মানুষীশক্তি, মানুষের শক্তি- ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের শক্তি। ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’- এই বোধ নিয়ে যদি মানুষ চলতে পারে, তাহলে ঈশ্বর মানুষের সত্তায় মানুষীশক্তি রূপে দেখা দেবে। মানুষ ভাবতে পারবে ঈশ্বর জনগণের অন্তর্গত এক পরম শক্তি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব জনগণের বাইরে নয়। সত্যের এ রকম প্রতিষ্ঠার জন্য জনসাধারণকে সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ভালো জীবনযাপনের জন্য সত্যের আন্তরিক উপলব্ধি, সত্যে দৃঢ় আস্থা ও অটল বিশ্বাস অপরিহার্য। এর জন্য প্রত্যেক জাতির এবং গোটা মানবজাতির নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক চেতনার পুনর্গঠনের সঙ্গে দরকার আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থারও সংস্কার। সত্যের উপলব্ধি ছাড়া প্রবল ও দুর্বলের আচরণ স্বাভাবিক হবে না- সমাজ হয়ে থাকবে জালেম ও মজলুমের সমাজ। জুলুম-জবরদস্তি ও যুদ্ধবিগ্রহই থাকবে সমাজের গতিনির্ধারক।

 

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads