• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
নারী ও আইন

লোকলজ্জার ভয়ে এদেশে বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা গোপন রাখা হয়

আর্ট : রাকিব

মতামত

নারী ও আইন

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ০৪ জুলাই ২০১৮

ইদানীং সবকিছু দেখে-শুনে আমার কেন যেন বার বার ঘুম পাড়ানো গানের কথা মনে পড়ছে। আমাদের মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য এখনো গুনগুন করে নানা ধরনের গান গেয়ে থাকেন। এসব গান শুনতে শুনতেই শিশুরা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। গানের কথাটা অবশ্য অকারণে মনে পড়েনি। বর্তমান পর্যায়ে আমার কাছে ‘মা’ হিসেবে এসেছে সরকার। শুনে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। কিন্তু লক্ষ করে দেখুন, ধর্ষণ ও ছিনতাই-ডাকাতি থেকে পণ্যমূল্য পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়েই সরকার ওই মায়েদের মতো জনগণকে কেবল ঘুম পাড়ানো গানই শুনিয়ে চলেছে। যেমন এই সময়ে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর নিষ্ঠুর হত্যার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে, যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশ্ন।

আলোচনায় আসছে ছিনতাই-ডাকাতির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর ভূমিকার প্রশ্নও। অন্যদিকে এসব বাহিনী কিন্তু ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছে, এখন নাকি ‘আগের মতো’ ছিনতাই হয় না! পুলিশেরই অন্য এক কর্মকর্তা আবার একধাপ এগিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, ছিনতাই এখন ‘হয় না বললেই চলে!’ এ ব্যাপারে সব কৃতিত্ব যে পুলিশের সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুল হয়নি ওই কর্মকর্তার। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কথাটার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু অত্যন্ত আশংকাজনক। নারীমুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক স্লোগানের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী নির্যাতন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, নারীরা ৩৩ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ধরনগুলোর মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ তো রয়েছেই, রয়েছে যৌতুকের জন্য হত্যার মতো নিষ্ঠুরতাও। সব ঘটনাই অবশ্য প্রকাশ্যে আসে না। কারণ লোকলজ্জার ভয়ে এদেশে বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা গোপন রাখা হয়। 

তা সত্ত্বেও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান উল্লেখ করা দরকার। যেমন ২০১৬ সালে যেখানে ৪০৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, সেখানে পরের বছর ২০১৭ সালে হয়েছে ৭৯৫ জন। তাছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রতিবন্ধীরাও। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান আরো ভীতিকর। সংস্থাটি জানিয়েছে, ৭৯৫ নয়- ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৩৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১৯৩। ২০১৭ সালে নারী নির্যাতন ও শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে বছরজুড়েই। চলতি বছর ২০১৮ সালেও নারী নির্যাতন ও শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে শুরু থেকেই। তুলনামূলকভাবে বেড়েছে ধর্ষণ ও শিশু হত্যার অপরাধও। এমন ঘটনাও রয়েছে, যেখানে তৃতীয় শ্রেণির একজন স্কুলছাত্রী স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের বিকৃত লোভের শিকার হয়েছে।

এভাবেই প্রতিদিন নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা। প্রসঙ্গক্রমে নারী নির্যাতনের অন্য কিছু ধরন সম্পর্কে উল্লেখ করা দরকার। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারীই যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানা গেছে, হয়রানি ও নিপীড়ন যে পুরুষেরা করে, তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশের বয়স ৪১ থেকে ৬০ বছর। ষাটোর্ধ্ব পুরুষেরাও পিছিয়ে থাকে না, তারাও সুযোগ পেলে তার ‘সদ্ব্যবহার’ করে! তবে নারীদের জন্য বেশি বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কমবয়সী যুবক ও পুরুষেরা, যাদের বয়স ২৬ থেকে ৪০-এর মধ্যে। সাধারণ বাস বা গণপরিবহনে তো বটেই, নারীরা যৌন হয়রানির বেশি শিকার হয় টেম্পো এবং টেম্পো নামের হিউম্যান হলারে। সাধারণ বাসের পাশাপাশি রিকশা এবং সিএনজির ক্ষেত্রেও নারীদের অভিজ্ঞতা কমবেশি একই রকম। অর্থাৎ সব যানবাহনেই তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। যাত্রীদের পাশাপাশি রয়েছে যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেল্পারসহ অন্যরাও। তারাও নারীদের নির্যাতন ও উত্ত্যক্ত করে যথেচ্ছভাবে। চলন্ত বাসের ভেতরে ধর্ষণ শুধু নয়, হত্যার ঘটনাও ঘটে মাঝে-মধ্যে। 

এই নির্যাতন ও নিপীড়নের ধরন সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে ওই গবেষণা রিপোর্টে। ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরে স্পর্শ করা ও চিমটি কাটা, শরীর ঘেঁষে বসা বা দাঁড়ানো, কাঁধে হাত রাখা, হাত-বুক বা শরীরের অন্যান্য স্থানে স্পর্শ করা ও চাপ দেওয়ার মতো বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টটিতে। ৮১ শতাংশ নারী জানিয়েছে, সব বুঝেও তারা মানসম্মানের স্বার্থে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়। কারণ প্রতিবাদ জানাতে গেলে অন্য পুরুষ যাত্রীরা নাকি বিকৃত আনন্দের হাসি হাসে। ব্যঙ্গ-তামাশা করে। এসব কারণে গবেষণার জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ২১ শতাংশ গণপরিবহনে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছে। যাতায়াত একেবারে বন্ধও করেছে অনেকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, যানবাহনে নির্যাতন ও হয়রানির এই খবর সব বিচারেই অগ্রহণযোগ্য। গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞদের অভিমতের উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, বেশি বয়স ও শারীরিক কারণে অক্ষমতা, অতৃপ্তি এবং স্ত্রী বা নারীসঙ্গী না থাকাই নাকি এর প্রধান কারণ। রিপোর্টে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে আইনের বিষয়টি। বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনো যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলে যৌন নিপীড়নসহ নারী নির্যাতন শুধু বেড়েই চলছে না, বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের রেকর্ডও স্থাপিত হয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণ থেকে হত্যা ও নানামুখী নির্যাতন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে এত বেশি ও ভয়ংকর ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীরা অতীতে আর কখনো হয়নি। শিশুরাও যে বাদ যাচ্ছে না বরং তাদের ওপর চালানো নির্যাতনও যে ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে— সে সম্পর্কেও গণমাধ্যমে মাঝে-মধ্যে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, দেশে নারী নির্যাতন আসলে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব বিষয়েই ধারণা পাওয়া গেছে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা রিপোর্টে।

বলা দরকার, সবই সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে আসলে দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে। মেয়েরা, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে না, তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে, তারা ধর্ষণেরও শিকার হবে— এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেওয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো লাঞ্ছিত হতে হবে, তার ওপর নেমে আসবে নির্যাতনের খড়গ এবং তাকে ও তার পরিবারকে এমনকি গ্রাম ও এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চালানো হবে— এসবের কোনো একটিও সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, নারীর ওপর এই সর্বাত্মক নির্যাতন ও সহিংসতার খবর শুধু আশংকাজনক নয়, নিঃসন্দেহে আপত্তিকরও। আপত্তির কারণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, কারণ আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগহীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা। প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, অনেক থানা এমনকি ধর্ষণের মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না। মামলা করতে গিয়ে উল্টো হুমকি-ধমকি খেয়েছে এমন নারী ও তাদের স্বজনদের সংখ্যাও কম নয়। একই কারণে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর বা বিচার চাওয়ার ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। যেন সবাই ‘নিয়তি’র ওপর ছেড়ে দিয়েছে সবকিছু! এভাবে অসংখ্য নারীর জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে বহুজনের সাধের সংসার। যৌন নির্যাতনের শিকার কত নারী যে বাধ্য হয়ে বিপথে গেছে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি, তারও কোনো হিসাব নেই।

বলা দরকার, ধরন যেমনই হোক, নারীর ওপর নির্যাতনকারীদের কোনোক্রমেই ছাড় দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা অবশ্যই সরকারকে পালন করতে হবে। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই জঘন্য কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে একটি আইনের খসড়ার কথা বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। আইনটিকে অবিলম্বে প্রণয়ন ও কার্যকর করা দরকার। নারীদের জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন, যাতে নির্যাতিত নারীরা আইনের আশ্রয় নিতে এবং সুবিচার পেতে পারে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত ও শিল্প-কারখানাসহ কর্মস্থলেও নারীদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, লাফিয়ে বেড়ে চলা নারী নির্যাতনের ঘটনায় আর যা-ই হোক, সরকারের ভাবমর্যাদা অন্তত বাড়ছে না।

পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন তথা নারীর ওপর নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হলে নির্যাতনকারী সবার বিরুদ্ধেই আইনত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। একথা বুঝতে হবে যে, দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় এবং যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলেই এমন ঘটনা ঘটতে পারছে। সুতরাং সবার আগে দরকার যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা— যার দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই সরকারের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads