• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
হালদা রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি

বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত পরিবেশগত

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

হালদা রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি

  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০১৮

হালদা পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। পৃথিবীর আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদী থেকে সরাসরি ডিম আহরণের নজির নেই। এ কারণে হালদা নদী বাংলাদেশের জন্য এক বৈশ্বিক উত্তরাধিকারও বটে। অর্থনৈতিকভাবে হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি। জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদার নদীটি অবহেলিত ও দূষণযুক্ত নদীর তালিকাভুক্ত।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় প্রায় ৮০০ নদীর মধ্যে চট্টগ্রামের ছোট্ট একটি নদী এই হালদা। ছোট ও অখ্যাত এ নদী এখন সাদা সোনার (মৎস্য) উৎস কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার পাহাড়ি ক্রীক থেকে সৃষ্ট হালদাছড়ি, মানিকছড়ি খালের সঙ্গে মিশে হয়েছে হালদা খাল। অতঃপর ফটিকছড়ি ধুরং খালের সঙ্গে মিলিত হয়েই হালদা নদীতে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট নামক স্থানে কর্ণফুলী নদীতে এসে একাকার হয়ে গেছে হালদা।

বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলত পরিবেশগত। বর্ষা মৌসুমে নদীর পরিবেশগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত, উজানের পাহাড়ি ঢল, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলা পানিসহ নদীর ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেদিক থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য নদ-নদী থেকে স্বতন্ত্র এটি। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রজননের সময় হচ্ছে মে-জুলাই। কিছু ব্রুড (মা-বাবা মাছ) সারা বছর স্থায়ীভাবে হালদা নদীতে থাকে আর কিছু ব্রুড মার্চ-এপ্রিলের দিকে হালদার সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলো থেকে স্থানান্তর হয়ে প্রজননের জন্য হালদা নদীতে আসে। প্রজনন শেষে আবার আগের আবাসিক নদীতে ফিরে যায়।

হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন এবং পরিচর্যা প্রযুক্তি স্থানীয়দের সম্পূর্ণ নিজস্ব। স্মরণাতীত কাল থেকে ধর্মীয় অনুভূতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সংমিশ্রণের এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়ে আসছে।

স্থানীয় জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের এ নিজস্ব পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খনন করা মাটির গর্তে (কুয়ায়) ডিম ফোটানো হয় এবং চারদিন লালন করে রেণু পোনা তৈরি করা হয়। বংশপরম্পরায় ডিম সংগ্রহকারীরা এ প্রযুক্তি এখনো ব্যবহার করে আসছে। স্থানীয় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকেন এই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় ডিম ধরার প্রস্তুতি। এ সময় পুকুর তৈরি, কুয়া খনন, নৌকা মেরামত ও পার্টনার সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। মে-জুলাই মাসে ডিম সংগ্রহের পর রেণুর পরিচর্যা ও পোনা বিক্রি চলতে থাকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত। স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা বছরের এই ৭-৮ মাস কর্মব্যস্ত দিন অতিবাহিত করেন। হালদা নদী থেকে প্রাপ্ত ডিম, উৎপাদিত রেণুর পরিমাণ এবং এখান থেকে উৎপাদিত মাছের হিসাব করলে দেখা যায়, এক বছরের চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। শুধু  চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের গর্ব হালদা নদী। বৃহৎ রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিগনি মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এটি। এখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।

যুগ যুগ ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদন করে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। মুক্তার দানার মতো সাদা এ ডিম দেশের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। হালদা নদী শুধু সাদা সোনা খ্যাত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নয়, এটি বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস। পানির বিশেষ গুণগতমান ও পরিমাণের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে শহরের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে। এ নদীর পানিতে হেভি মেটালের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম হওয়ায় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসেবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কক্সবাজার ও সুন্দরবন ছাড়া এদেশে আরো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যা নিয়ে আমরা বিশ্বদরবারে ঐতিহ্যের দাবি জানাতে পারি। চট্টগ্রামের হালদা নদী তেমনি এক সম্পদ। বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী হালদা নদী জাতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে। হালদা নদীকে জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। হালদা নদীর পানি বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিল্প কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য, ব্রিক ফিল্ডের দূষণ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকজনিত দূষণ। নদীর উপকূলে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে বেশকিছু দূষণকারী শিল্পকারখানা। কারখানা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য মাদার্শা ইউনিয়নের মাদারী খাল ও মেখল ইউনিয়নের চ্যাংখালী খাল হয়ে হালদা নদীতে পড়ছে। এতে নদীর পানি দূষণ, মূল্যবান মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট এবং আহরিত ডিমের রেণু উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হালদার প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের আরেকটি কারণ হচ্ছে এর ৩৬টি শাখা খাল, নদী ও ছড়াগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইস গেট নির্মাণ, বাঁধ তৈরি এবং রাবার ড্যাম নির্মাণ। এছাড়া উজানে হালদার অবস্থান পাহাড়ি এলাকায়। এখানে জুম চাষ, পাহাড়ের বৃক্ষ নিধন, জমি চাষ ইত্যাদি কারণে প্রচুর পলিমাটি পাহাড়ি ঢলে ভেসে এসে হালদার তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

এই নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রজনন স্থান হচ্ছে নদীটির বিশেষ ধরনের বাঁক। এ বাঁকগুলোকে অক্সবো বাঁক বলে। নদীর এসব বাঁক পানির ওলট-পালট, স্রোতের গতিধারা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক অনুঘটক উৎপন্ন করে মাছের প্রজননের বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং ডিম নিষিক্ত করতে সহায়তা করে। তা ছাড়া এ বাঁকগুলোতে পানি ঘূর্ণনের কারণে গভীর স্থানের সৃষ্টি হয়, যাকে কুম বা কুয়া বলে। সৃষ্ট এসব কুম বা কুয়া হালদা নদীতে মাছের প্রজনন ও প্রজননকালীন বিভিন্ন নদী থেকে এসে ব্রুড মাছ অবস্থান করার বিশেষ স্থান। মূলত বাঁকগুলো হালদা নদীতে মাছের প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে প্রায় ১০০ বছরে হালদা নদীর এগারোটি বাঁক পর্যায়ক্রমে কেটে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে হালদার ভাটি এলাকায় আটটি এবং উজান এলাকায় তিনটি বাঁক কেটে দেওয়া হয়েছে। এই বাঁকগুলো কেটে দেওয়ায় প্রায় ১২৩ কিলোমিটার নদীর দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার কমে ৯৮ কিলোমিটার হয়েছে। ভাটি এলাকার অক্সবো বাঁকগুলো কেটে দেওয়ার কারণে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সরাসরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। উৎস এবং ভাটি এলাকার বাঁকগুলো কাটার ফলে নদীর গতি পরিবর্তন এবং দৈর্ঘ্য হ্রাস পাওয়ার মাধ্যমে নদীর ভৌত রাসায়নিক ও পরিবেশগত পরিবর্তন সাধিত হয়। নদীর বিভিন্ন অংশের এ বাঁকগুলো ক্রমান্বয়ে কেটে দেওয়ায় হালদার নিরাপদ মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হালদা রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ না নিলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। এশিয়ার সর্ববৃহৎ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীকে বিপর্যয় থেকে রক্ষার্থে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

আলতাফ হোসেন

প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads