• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি

শিক্ষিত থেকে অর্ধশিক্ষিত, সবাই এসেছে ইন্টারনেট সেবার আওতায়

আর্ট : রাকিব

মতামত

প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি

  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৮

ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে গায়ে। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ লাভ করছে দ্রুতলয়ে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। প্রযুক্তির উষ্ণ আবহাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে বাংলার শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। শিক্ষিত থেকে অর্ধশিক্ষিত, সবাই এসেছে ইন্টারনেট সেবার আওতায়। স্বল্প মূল্যে ক্রয় করা যাচ্ছে ইন্টারনেট প্যাকেজ। শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিতরাও প্রযুক্তির এই সুবিধার শীতল জলে অবগাহন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু যথাযথ সচেতনতার অভাবে অনেকে জেনে না জেনেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনছে নিজেই। সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। এসব ব্যবহারকারীর কেউ কেউ জানেই না সাইবার অপরাধে হতে পারে সর্বাধিক ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। সঙ্গে গুনতে হতে পারে এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬- যা পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এ রাখা হয়েছে সাইবার অপরাধের বিচারের বিধান। উল্লেখ্য যে, এ আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্কের পর ওই ধারাটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তদুপরি অন্যান্য ধারায় বিচারের সুযোগ রয়েছে সাইবার অপরাধের।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা অনলাইন গণমাধ্যমে কাউকে নিয়ে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারো নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট দিলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে কিংবা শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তা সাইবার অপরাধ হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যম হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। এ ছাড়া অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তা-ও সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

এবার দেখা যাক কোন অপরাধে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৪ থেকে ৬৭ নম্বর ধারায় অপরাধের দণ্ড সংক্রান্ত বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আইনের ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি, অনিষ্ট সাধন যেমন ই-মেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা ইত্যাদি অপরাধ করলে সর্বাধিক ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বাধিক ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। আইনের এই বিধান অনুযায়ী উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) প্রদানের বিধানও রয়েছে। আইনের ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধের কথা। এখানে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ করলে সর্বাধিক তিন বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বাধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ক্ষতি করার উদ্দেশে এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা এর উপযোগিতা হ্রাস পায় অথবা কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, তবে এটি হবে হ্যাকিং অপরাধ। এর শাস্তি সর্বাধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি সর্বাধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা। উভয় (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) দণ্ড দেওয়ার বিধানও এই আইনে রয়েছে। নানাবিধ সমালোচনা ও বিতর্কের পর এই ধারাটি আইনে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার।

আইনের ৫৮ ধারায় লাইসেন্স সমর্পণে ব্যর্থতার দায়ে সর্বাধিক ছয় মাস কারাদণ্ড ও সর্বাধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে বলে উল্লেখ রয়েছে। আইনের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা এর বিধি বা প্রবিধান প্রতিপালন নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রক, আদেশ দিয়ে বা কোনো সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বা তার কোনো কর্মচারীকে আদেশে উল্লিখিত মতে কোনো বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বা কোনো কার্য করা হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলে কোনো ব্যক্তি যদি ওই নির্দেশ লঙ্ঘন করেন, তাহা হলে ওই লঙ্ঘন একটি অপরাধ হবে। এই অপরাধে সর্বাধিক এক বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এই আইনে।’

আইনের ৬০ নম্বর ধারায় জরুরি পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রকের নির্দেশ অমান্যে সর্বাধিক ৫ বছর কারাদণ্ড অথবা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনের ৬১ ধারায় সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশের অপরাধে সর্বাধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনের ৬২ ধারায় সর্বাধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট প্রাপ্তিতে মিথ্যা প্রতিনিধিত্ব বা তথ্য গোপন সংক্রান্ত অপরাধে।

আইনের ৬৩ ধারায় গোপনীয়তা প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধে কেউ জড়ালে তাকে সর্বাধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ৬৪ ধারায় সর্বাধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড প্রদানের কথা বলা হয়েছে ভুয়া ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধে। ৬৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রতারণার উদ্দেশে ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধে সর্বাধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড প্রদানের কথা বলা হয়েছে।

আইনের ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কারও কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে, অপরাধকারী যে দণ্ডে দণ্ডিত হবেন, ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধে সহায়তার জন্য কম্পিউটারের মালিকও সমান সাজা পাবেন।’ ৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীনে থাকা কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ওই অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কোম্পানির এমন প্রত্যেক পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে গণ্য হবে। তবে ওই অপরাধ কোনো ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে প্রমাণ হলে অথবা ওই ব্যক্তি অপরাধ রোধ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন প্রমাণ হলে তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবেন।

বলা হয়ে থাকে প্রতিটি জিনিসেরই সুবিধা-অসুবিধা আছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটির যেমন সুফল রয়েছে, একই সঙ্গে এর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। অসাবধানতাবশত কোনো অপরাধের জন্য কাউকে কঠিন সাজার মুখোমুখি করা সম্ভব এই আইনে। সুতরাং অনলাইন ব্যবহারে সচেতনতার বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন যে, এই আইনে কিছু শূন্যতার কারণে কেউ চাইলে আইনের অপব্যবহারও করতে পারেন। ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি। অতএত, আসুন প্রযুক্তি ব্যবহারে আরো সচেতনত হই, চোখ-কান খোলা রেখে প্রযুক্তি ব্যবহার করি। নিজেদের নিরাপত্তা বলয় নিজেরাই তৈরি করি।

মো. মাঈন উদ্দিন

প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads