• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
স্বস্তি পেল গোটা বিশ্ব

গুহায় আটকে পড়া কিশোররা কেউই প্রশিক্ষিত ডুবুরি ছিল না

আর্ট : রাকিব

মতামত

থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া কিশোরদল উদ্ধার

স্বস্তি পেল গোটা বিশ্ব

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় একটা গুহায় আটকা পড়েছিল একটা ফুটবল দল। ২৩ জুন বিকালে ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১২ ফুটবলার ও তাদের ২৫ বছর বয়সী কোচ উত্তরাংশের প্রদেশ চিয়াং রাইয়ের ‘থাম লুয়াং নায় নন’ গুহায় প্রবেশ করে। কিন্তু প্রবেশের পর প্রবল বৃষ্টিপাতে গুহায় প্রবেশের প্রধান পথ বন্ধ হয়ে যায়। যে গুহায় তারা আটকা পড়েছিল সেটি থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম গুহাগুলোর একটি। এরপর থেকেই তাদের সন্ধানে উদ্ধার কাজ শুরু হয়। থাইল্যান্ডের কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে বলেছিলেন, দলটিকে বের করে আনার ক্ষেত্রে তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাদের নিরাপদে বের করে আনার উপায় খুঁজছেন তারা। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদপত্র ‘চ্যানেল নিউজ এশিয়ার’ খবরে বলা হয়েছিল, গুহার যে চেম্বারে শিশুরা আটকা নৌবাহিনীর একটি দল তাদের ৫০০ মিটারের মধ্যে পৌঁছে তাদের জীবনের স্পন্দন পেয়েছে। দলের সদস্যরা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। উদ্ধারকারীরা টর্চের আলো ফেলে তাদেরকে কার্নিশের খাঁজে বসা অবস্থায় দেখতে পায়। তখন একজন বলে, তারা খুবই ক্ষুধার্ত। তারা জানতে চায় কবে তারা সেখান থেকে বের হতে পারবে। উদ্ধারকারীরা বলে, তাদের অপেক্ষা করতে হবে। এখানে আরো লোক আসবে। তখন একজন কিশোর বলে, ‘ঠিক আছে, কাল দেখা হবে।’ অর্থাৎ ওই কিশোরটির মনে আশার আলো জ্বলেছিল।’ নিখোঁজ হওয়ার নয় দিন পর পাওয়া গিয়েছিল এ সংবাদ।

এটা ছিল সন্ধান পাওয়ার পর প্রথম দিকের খবর। চিয়াং রাইয়ের গভর্নর নারোংসাক অসোত্তানাকর্ন তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ তারা নড়ার মতো শক্তি না পায় আমরা ততক্ষণ তাদের খেয়াল রাখব। তাদের কাছে খাবার আর ডাইভ দিতে জানা ডাক্তারও পাঠানো হবে।’ অন্যদিকে উদ্ধার কাজে বিশেষজ্ঞ পাট মোরেট মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনকে বলেছিলেন, ‘উদ্ধারের আগে তাদের প্রচুর চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। খাওয়ানোর পরিবর্তে তাদের শরীরে প্রচুর পানি প্রবেশ করাতে হবে। তাদের শরীরে তাপ দিতে হবে। এরপরও উদ্ধার পাওয়ার জন্য তাদের ডুবুরির মতো ডুব দিয়ে পানির নিচ দিয়ে আসতে হবে। পানিতে ডুব দিতে তাদের পুরো মুখ ঢাকা মাস্ক অথবা ডাইভে ব্যবহূত হেলমেট পরানো হবে।’

গুহায় আটকে পড়া কিশোররা কেউই প্রশিক্ষিত ডুবুরি ছিল না। তারা সাঁতারও জানত না। গুহাটির এমন এক জায়গায় এই দল ছিল যে পেশাদার ডুবুরিদের গুহার প্রবেশপথ থেকে সেখানে পৌঁছাতে ১১ ঘণ্টা লেগেছিল। পথটা ছিল জায়গা জায়গায় খুবই সরু। তাছাড়া সামনে এগুতে হলে প্রতি মুহূর্তে পাম্প করে পানি সরিয়ে তাদের এগুতে হচ্ছিল।

গুহায় আটকে পড়ার ১০ দিনের মধ্যে দলটির কাছে চিকিৎসকদের পরামর্শমতো সহজে হজমযোগ্য ও উচ্চশক্তির খাবার ও ভিটামিন পৌঁছানো হয়েছিল। যে ডুবুরিরা গিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ডাক্তার ও একজন নার্সও ছিল। তারা গুহায় আটকে থাকা দলটির সঙ্গে দেখা করে। নৌবাহিনীর দুজন চিকিৎসক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পানি না কমা পর্যন্ত ছাত্রদের সঙ্গে থাকতে সম্মত হয়েছিল। গুহার ভেতর বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইন বসানোর চেষ্টাও হচ্ছিল যাতে এই কিশোররা তাদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারে। সন্ধান পাওয়ার আগে গুহার প্রবেশপথে তাদের সাইকেল পাওয়া গিয়েছিল। এরপর খুঁজে পাওয়া যায় তাদের পায়ের জুতা ও ব্যাগ। প্রবল বৃষ্টিপাতে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হতে থাকলে পানি তোলার পাম্প বসানো হয়, রোবট ব্যবহার করা হয়। এরপর তারা পায়ের ছাপ আবিষ্কার করে, কিন্তু ছেলেদের কোনো চিহ্ন পায়নি। যেহেতু বৃষ্টি অব্যাহত ছিল তাই তারা গুহায় ঢোকার অন্য পথ খুঁজতে থাকে। উদ্ধারকারীদের রীতিমতো সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল যাতে ভেতরে পানির উচ্চতা বেড়ে না যায়। এরপর খোঁজা শুরু হয় একটা চিমনি। গুহার উত্তর দিকে একটি প্রাকৃতিক চিমনি আবিষ্কার করা হয়। ২৯ জুন গুহার ভেতরে পানি কমতে থাকে। উদ্ধারকর্মীদের মনে ভেতরে ঢোকার আশা বাড়তে থাকে। এরপর সবাইকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার খবর আসে। এই খবরের অপেক্ষায় থাকা পরিবারগুলোর মুখে হাসি ফোটে।

ওই গুহাটি নিয়মিতই বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে যায় আর সেটি চলে সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাস পর্যন্ত। তাছাড়া গুহাটির মধ্যে বিপজ্জনক করিডোর ও শূন্যমাত্রার দৃশ্যমান পানির কারণে অদক্ষ ডুবুরি নেওয়াও ছিল বিপজ্জনক। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করেছিল ড্রিলিং মেশিন দিয়ে পাহাড়ের গায়ে ছিদ্র করে গুহার ভেতরের পানি বের করে দিতে। কিন্তু শক্ত পাথরের কারণে কাজটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাছাড়া এ কাজ করতে হলে প্রথমে নতুন রাস্তা করতে হতো, যাতে ভারি ড্রিলিংয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া যায়। আগে পুরো গুহাটি জরিপও করতে হতো। যাতে ছিদ্রটা এমনভাবে করা যায় যা কিশোরদল যেখানে আছে সেই অবধি পৌঁছে। উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য গুহার কাছাকাছি একটা অস্থায়ী হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছিল।

নিয়মিত যারা গুহায় যান বা যারা খনিতে কাজ করেন তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর গুহা বা খনি সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা ধারণাও থাকে। বিপদে পড়লে রক্ষা পাওয়ার মোটামুটি একটা ব্যবস্থা তাদের থাকে। এই দলটি একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা গুহায় আটকা পড়েছিল।

গুহায় আটকে পড়লে নিজের সঙ্গে যে জিনিস আছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার এবং জিনিস যেন অপচয় না হয় সেটি দেখতে হয়। নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। বন্যা প্লাবিত হলে কোনো শুকনো জায়গায় থাকতে হয়। শরীর, জামাকাপড় শুকনো রাখতে হয় যাতে ভিজে কোনো অসুখ না হয়। নজর রাখতে হয় যেন শরীর পানিশূন্য হয়ে না যায়। পরিষ্কার পানি না পেলে ময়লা পানিই খেতে হয়। পেট খারাপের ঝুঁকি থাকলেও পানি খেতে হয়। কারণ পানি না খেয়ে পানিশূন্য হয়ে গেলে যে ক্ষতি হয় তার চেয়ে পানি খেয়ে পেট খারাপ হলে যে পানি বেরিয়ে যায় তাতে ক্ষতি হয় কম। অক্সিজেন যাতে পাওয়া যায় সেদিকেও নজর রাখতে হয়। একটা ছোট্ট জায়গায় বেশি লোক হয়ে গেলে সেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেদিকটাতেও খেয়াল রাখতে হয়।

আশঙ্কার কথা এটাই ছিল, বৃষ্টির কারণে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ায় গুহায় বাতাস ঢোকার পথগুলো হুমকির মুখে ছিল। গুহায় আটকে গেলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। একটা গুহায় হয়তো সবই আছে, তাপমাত্রা পানি খাবার কোনো কিছুরই কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু একটা অন্ধকার বদ্ধ জায়গা থেকে বের হতে পারবে কি না এই আশঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকা, মাথা ঠান্ডা রাখা খুবই কঠিন।

গুহায় অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেছেন একজন। তিনি থাইল্যান্ডের নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি ছিলেন। ৩৮ বছর বয়সী এই ডুবুরি আটকে পড়া দলের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দিয়ে ভূমিতে ফেরত আসার পথে চেতনা হারিয়ে ফেললে তার মৃত্যু ঘটে। তার দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফেরত আসার পথে তার নিজের কাছেই যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন ছিল না। তিনি নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু আটকে পড়া দলের উদ্ধার কাজে তিনি স্বেচ্ছায় যোগ দেন।

গুহায় আটকে পড়া দলটিকে উদ্ধারের জন্য প্রায় ১ হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালিয়েছিল। এর মাঝে ছিল ডুবুরি সরকারি কর্মচারী ও বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবী। ভারী বৃষ্টির পর গুহার ভেতরে পানি আরো বেড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় রোববার থেকে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। দক্ষ ডুবুরিরা আটকে পড়া কিশোদের ডুবে যাওয়া সুড়ঙ্গের পানির ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে গুহার প্রবেশ মুখে নিয়ে আসেন। উদ্ধারের আগে ডাক্তাররা পরীক্ষা করে সব কিশোরকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে এই অভিযানের জন্য প্রস্তুত বলে মত দিয়েছিলেন। তাদের পরিবার থেকেও সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে গুহার মুখে জটলা করে থাকা উদ্ধারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে ১৮ জন দক্ষ ডুবুরি পাঠিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু হয়। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে উদ্ধার কাজ। সবচেয়ে বেশি যারা অসুস্থ তাদের আগে বের করে আনা হয়। যেখানে ছেলেরা আটকে পড়েছিল সেখানে যাওয়া এবং সেখান থেকে গুহামুখে আসতে সবচেয়ে দক্ষ ডুবুরিরও ১১ ঘণ্টা সময় লেগেছে। এর মধ্যে কিছুটা হাঁটতে হয়, কিছুটা পানি কেটে হাঁটতে হয়, কিছুটা ডুব সাঁতার দিতে হয়। ছিল অনেক চড়াই উৎরাই। আর পুরো যাত্রাটাই ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকারে।

প্রত্যেক ছেলেকে পুরো মুখ ঢাকা মাস্ক পরতে হয়েছিল। প্রত্যেকের সামনে পেছনে ছিল দুজন ডবুরি গাইড হিসেবে। তারা তাদের এয়ারসিলিন্ডার বহন করেছে। সবচেয়ে কঠিন ছিল মাঝামাঝি জায়গাটা। এটিকে একটা টি-জাংশন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জায়গাটা এতটাই সরু ছিল যে ডুবুরিদের তাদের এয়ার ট্যাঙ্ক খুলে ফেলতে হয়েছিল।

এরপর ক্ষণিকের যাত্রাবিরতির জন্য গুহার মধ্যে একটা ক্যাম্পের মতো বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখান থেকে বাকিটা পথ হেঁটে তাদের গুহামুখে আসতে হয়েছিল। গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে।

সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল থাইল্যান্ডের ওই গুহাটির দিকে। কিশোরদলের উদ্ধারের খবরের জন্য প্রহর গুনছিল পৃথিবীবাসী। তাদের জন্য অহর্নিশ প্রার্থনা করেছে সবাই। তারা নিরাপদ জীবনে ফিরে আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বিশ্ববাসী।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্মসচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads