• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ব্রিটিশ ভারতে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকা

ব্রিটিশের রাষ্ট্র তাদের অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

ব্রিটিশ ভারতে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকা

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৭ জুলাই ২০১৮

জাতি ও শ্রেণি প্রশ্নে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকাকে আরো কাছে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করব। তাদের ভূমিকাই প্রধান হতে পারত এবং তেমনটা ঘটলে উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। সেটা ঘটেনি। কারণ অনেক। যেমন ভেতরের তেমনি বাইরের। বাইরে থেকে তাদের ওপর সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় পক্ষের ছিল সমান ক্রোধ, কারণ তারা ব্যক্তিমালিকানায় নয়, বিশ্বাস করে সামাজিক মালিকানায়। ব্রিটিশের রাষ্ট্র তাদের অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। আবুল হাশিম মোটেই কমিউনিস্ট ছিলেন না, ছিলেন ইসলামপন্থি; তাকেও ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট বলা হতো। পার্টিকে নিষিদ্ধ করার আগেও ‘কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ হলেই গ্রেফতার কর’- এই নিয়ম চালু ছিল। কোনো গোলযোগ দেখা দিলেই বলা হতো কমিউনিস্টরা দায়ী। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা কমিউনিস্টরা ঘটিয়েছে বলে প্রচার করে নূরুল আমিন আশা করেছিল যে, পূর্ববঙ্গবাসী আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করবে।

এর পাশাপাশি ভেতরের দুর্বলতা ছিল আরো ক্ষতিকর। এই দুর্বলতার মূল উৎস পার্টির পেটি বুর্জোয়া চরিত্র। পেটি বুর্জোয়ারাই পার্টি গঠন ও পরিচালনা করেছেন। শুরুতেই পার্টির ওপর ওই শ্রেণির চরিত্রটা সংক্রমিত হয়েছিল, পরেও তা রয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়ারাই যে পার্টি তৈরির দায়িত্ব নেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারাই ছিল অগ্রসর, কিন্তু তাদের শ্রেণিচরিত্রে দুটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল, একটি পরাধীনতাজনিত, অপরটি নিজেদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা-উৎসাহিত। পরাধীনতা মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দেয়, পরের ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। পেটি বুর্জোয়াদের মেরুদণ্ড এমনিতেই শক্ত নয়, পরাধীনতা মেরুদণ্ডকে আরো নরম করে দিয়েছে। পরাধীন বাংলার পেটি বুর্জোয়ারাই কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগ নিয়েছেন। ওদিকে আবার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণের কারণে বাংলা তখন অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। প্রধান উদ্যোক্তা মুজফ্ফর আহমদের জন্য কলকাতায় কোনো থাকার জায়গা ছিল না, উপার্জন করতে হতো ছোটখাটো কাজ করে। এমনও দিন গেছে যখন তাকে রাত কাটাতে হয়েছে ছাত্রের বসবার ঘরে। তার সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুল হালীম। তারও থাকার জায়গা ছিল না। আবদুল হালীম অল্প বয়সে যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনে, জেলও খেটেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। সে-সময়ে মার্কসবাদী সাহিত্য পাওয়াই যেত না, দু’একটা এলে কেনার জন্য যৎসামান্য টাকা সংগ্রহ করাটাও কঠিন ছিল। অপুষ্টিতে মুজফ্ফর আহমদ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর ভেতরে থেকেও তারা যে মার্কসবাদী হতে পেরেছিলেন সেখানেই তাদের অসামান্যতা। মার্কসবাদীরা বুর্জোয়াদের হারিয়ে দেয় দুটি বিশেষ ক্ষেত্রে— একটি জ্ঞান, অপরটি নৈতিকতা। ভারতীয় মার্কসবাদীরা জ্ঞানের দিক থেকে বুর্জোয়াদের ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সুবিধা করতে পারেননি। তবে তাদের নৈতিকতা অবশ্যই বুর্জোয়াদের তুলনায় অনেক অনেক উন্নত ছিল, কিন্তু সেখানে আবার পেটি বুর্জোয়া সঙ্কীর্ণতাও ছিল। মুজফ্ফর আহমদের আত্মজৈবনিক বইটিতে দেখা যায় যে, তিনি উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং বৈজ্ঞানিক শ্রেণি ও সমাজ বিশ্লেষণে তেমন আগ্রহী নন, খুব বেশি আগ্রহী, বলা যায় খুঁতখুঁতেই, সাল তারিখে খুঁটিনাটি, শব্দের বানান ও ব্যক্তির পরিচয় দানের ব্যাপারে। ঘটনা পর্যন্ত আসেন; তার চেয়ে বিস্তৃত এলাকায় যান না। এই সঙ্কীর্ণতা, এভাবে ছোট জায়গায় আটকে থাকা, আন্তর্জাতিক হয়েও না-হওয়া, এটা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি ব্যাধি ছিল। শুরুতে ভারতের বাইরে দুই কর্মকেন্দ্র মস্কো ও বার্লিনে অবস্থানকারী মার্কসবাদী নেতাদের এক হতে না-পারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখছেন, “দশজন ফকীর একখানা চাদর পেতে তার ওপরে ঘুমুতে পারেন, কিন্তু দু’জন বাদশাহের জায়গা এক দেশে কি করে হতে পারে?” হয় না। তবে দশজন ফকির কিন্তু আবার বাদশাহদের মতোই একে অপরের নিকৃষ্টতম শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, যদি কেউ দানখয়রাত করতে আসে। ফকির তখন পেটি বুর্জোয়া হয়ে পড়ে। মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিচারণে পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বের যে ব্যক্তিগত কলহের খবর পাই, সেগুলো সংগঠনের বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণের পক্ষে অবশ্যই প্রতিবন্ধক ছিল।

আর ছিল পরনির্ভরতা। পার্টির প্রতিষ্ঠা ১৯২০ সালে, দেশে নয় দেশের বাইরে, সোভিয়েট রাশিয়ার সমর্থন ও অর্থানুকূল্যে। তখন থেকেই এর যে বিদেশনির্ভরতা শুরু পরে তা থেকে আর মুক্তি ঘটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরে এই নির্ভরতা চরম ও সর্বাধিক ক্ষতিকর রূপ ধারণ করে। সমাজতন্ত্রের পিতৃভূমি রক্ষা করার জন্য অবস্থান নিতে গিয়ে শত্রুর শত্রু অতএব মিত্র এই নীতির কবলে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। দেশে যখন ব্রিটিশবিরোধিতা ক্রমশ চরম আকার ধারণ করছে তখনই ঘটল এই ঘটনা, ফলে ‘জনযুদ্ধে’র আওয়াজ দিতে দিতে কমিউনিস্ট পার্টি অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সেটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়নি। পরবর্তীতে চীন-রাশিয়া বিরোধের সময় পার্টি দ্বিখণ্ড হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের লাইন ধরে যে নকশালবাড়ী আন্দোলনের তৎপরতা দেখা গেল সেটাও পরনির্ভরশীলতার গণ্ডির ভেতরেই রয়ে গেল। বাইরে যেতে পারল না।

তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টির যখন গোড়াপত্তন হচ্ছে, তখন দেশের ভেতরেও কমিউনিস্ট মতাবলম্বীরা তৈরি হচ্ছিলেন। পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ, গোয়েন্দারা গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছিল। তার ভেতরেও পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি নামে স্থানীয়ভাবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ হয়ে একটি সংগঠন তারা গড়ে তুলেছিলেন। পরে এর নাম বদল করে রাখা হয় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি। এই পরিবর্তনের তাৎপর্যটা কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মেহনতি মানুষ বলতে প্রধানত কৃষককেই বোঝাত, তারাই ছিল শতকরা ৮০ জন; তাই তাদের কাছেই যাওয়ার কথা উঠেছিল। কিন্তু ধ্রুপদী মার্কসবাদে কৃষকের কথা যেহেতু তেমনভাবে বলা হয়নি, শ্রমিকদের নেতৃত্বে এবং তাদের দ্বারাই বিপ্লব সংঘটিত হবে বলে মতপ্রকাশ করা হয়েছে, তাই ভারতীয় মার্কসবাদীরাও দলের নাম বদলে পেজেন্টসকে সরিয়ে দিয়ে ওয়ার্কার্সকেই প্রধান করে তুলেছেন। লেনিন কিন্তু মার্কসবাদকে তার দেশের বাস্তবতায় স্থাপন করে কৃষককে পাশে টেনে নিয়েছিলেন এবং সেজন্যই তার দেশে বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মাও সে-তুঙ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে নিজের দেশের বাস্তবতায় নিয়ে গিয়ে কৃষককেই সামনে নিয়ে এলেন। ভারতের বিপ্লবীরা তেমনটা করতে পারেননি, শাস্ত্রের এবং সোভিয়েত-দৃষ্টান্তের ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণেই।

পার্টির প্রথম সংগঠক এমএন রায়ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণিরই লোক। সেই শ্রেণির সীমা অনেকটা পার হয়ে তিনি অসাধারণ দুঃসাহস, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন; জ্ঞানে বুদ্ধিতে তিনি বুর্জোয়াদের তুলনাতেও অধিক বুর্জোয়া ছিলেন। কিন্তু পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির লোকদের আত্মসচেতনতা, অহমিকা ও অস্থিরতা যে পরিহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা নয়। ফলে তিনি তার নিজের-গড়া পার্টি থেকে ১৯২৯ সালেই বহিষ্কৃত হন, বহিষ্কৃত না হলে হয়তো নিজেই ছেড়ে দিতেন। পরে তিনি জাতীয়তাবাদী ধারাতে যোগ দেন এবং আরো পরে বিপ্লবী মানবতাবাদ নামে নতুন এক মতাদর্শ প্রবর্তনে সচেষ্ট হন। অনেক বড় মাত্রায় যেন আমাদের অলি আহাদেরই পূর্বসূরি।

এমএন রায়ের বিরুদ্ধে অর্থলোলুপতারও অভিযোগ আছে। আর ছিল অনড় পিতৃতান্ত্রিকতা। মুজফ্ফর আহমদ স্মরণ করেছেন যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে-সাতজনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তাদের ভেতর রায়ের প্রথম স্ত্রী এভলিন ট্রেন্ট ছিলেন একজন। ‘জার্মানী ও প্যারিস হতে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির যে-সব সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে সে-সব এভেলিনের অবদানে ভরা।’ কিন্তু ১৯২৫ সালেই এভেলিন রায়কে ছেড়ে চলে যান। রায় তার স্মৃতিকথায় কোথাও উল্লেখ করেননি যে, এভেলিন নামে কোনো নারী কোনো দিন তার জীবনে এসেছিলেন।

পার্টিগঠনে মাতৃহূদয়ের সংবেদনশীলতা যে কাজ করেনি তা নয়। মাতৃহূদয় অবশ্যই ছিল। মোহাম্মদ তোয়াহা জানাচ্ছেন যে, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় ঢাকার একটি লঙ্গরখানায় কাজ করতে গিয়ে তিনি এক মেয়েকে দেখেন সাদা শাড়ি পরে শানকি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে তার সামনে নিজের মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে।

নেতৃত্বের চরিত্রে যে পিতৃতান্ত্রিকতা ছিল তাতে সন্দেহ নেই। না-থেকে উপায়ও ছিল না। প্রথম কারণ পেটি বুর্জোয়াদের স্বভাবের ভেতর পিতৃতান্ত্রিকতা থাকে। দ্বিতীয় কারণ পার্টিকে কাজ করতে হয়েছে গোপনে, বিরূপ পরিবেশে, শৃঙ্খলার সঙ্গে। মাতৃহূদয়ের চর্চার সুযোগ ছিল সীমিত। ফলে পার্টির কর্মীরা জনগণের কাছে গেছেন, সঙ্গে থেকেছেন, নিজেদের পারিবারিক জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেননি। আত্মত্যাগ সত্ত্বেও তাদের ধরনটা ছিল শিক্ষকের; পিতার মতো, মা-বোনের মতো নয়, সহযোদ্ধারও নয়।

ওদিকে আবার ছিল বুর্জোয়াদের পেছনে না রেখে তাদের পেছনে পেছনে থাকার প্রবণতা। কমিউনিস্টরা সংগ্রাম করবে, আত্মত্যাগ করবে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে না, এমনটাই ছিল মনোভাব। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে কংগ্রেস ও লীগ, এটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য কমিউনিস্টরা কংগ্রেস ও লীগের ঐক্য চেয়েছে, গান্ধী ও জিন্নাহর সমঝোতা কামনা করেছে, কিন্তু নিজেরা যে রাষ্ট্রক্ষমতা করতলগত করবে-এমন ঘোষণা জোরগলায় দেয়নি। এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদীদের অবস্থানটা কিন্তু ছিল পরিষ্কার, তারা রাজনীতি করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। সাধারণ মানুষ ভেবেছে এঁরা লোক ভালো, খুবই সৎ ও ত্যাগী, কিন্তু রাষ্ট্র চালানো সোজা কাজ নয়, এরা পারবে না, রাষ্ট্র চালাবে ওই জাতীয়তাবাদীরাই। ব্রিটিশ আমলে একটা আওয়াজ শোনা যেত, ‘ভাত-কাপড়াকে লিয়ে কমিউনিস্ট, আজাদীকে লিয়ে কংগ্রেস।’ মর্মার্থটা এই যে, রাষ্ট্রক্ষমতা থাকবে দেশের বড় বড় সাহেবদের কাছে আর কমিউনিস্টরা লড়াই করবে মানুষের ভাত-কাপড়ের জন্য; কমিউনিস্টরা যে দেশ স্বাধীন করবে এমন আস্থা কমিউনিস্টরা সে-সময়ে সৃষ্টি করতে পারেনি।

তেভাগা আন্দোলন হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে তেলেঙ্গানাতে, কিন্তু সেগুলো স্থানীয় লড়াই এবং তার ভেতর দিয়ে যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যাবে- এমন সম্ভাবনা ছিল না। ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেল স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে। কিছুই করতে না-পারার ব্যর্থতার বোধ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি এবার আওয়াজ তুলল সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামের। বলল, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ তাদের ইশতাহারে স্বীকার করা হলো যে, ব্রিটিশ শাসনের কালে পার্টি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির ওপর ভরসা করে ভুল করেছিল, তাদের পক্ষে আরো বেশি করে যাওয়া উচিত ছিল শ্রমিক, ক্ষেতমজুর ও গরিব কৃষকের কাছে। তা না করে পার্টি ‘বুর্জোয়া শ্রেণির লেজুড়’ হয়ে পড়েছিল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চার অভাবের দরুন পার্টি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের দিকে নেমে গিয়েছিল।

কিন্তু সেই সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের এই লাইন কার্যকর করার তো উপায় ছিল না। প্রথমত, ব্রিটিশের বিদায় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরকে স্বাধীনতা বলে হই হই প্রচারের প্রভাব জনসাধারণের ওপর গিয়ে পড়েছিল। তারা শ্রেণি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অবস্থায় ছিল না। পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা উৎফুল্ল ছিল উন্নতির রাস্তা খুলে গেছে মনে করে। দ্বিতীয়ত, দেশভাগ হওয়াতে পার্টি নিজেও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্ববঙ্গের দিকেই তাকানো যাক। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা বারো হাজার থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল দুই শ’তে। নেতারা ছিলেন হয় জেলে, নয়তো আত্মগোপনে। সদস্যরা অনেকেই বাধ্য হয়েছেন দেশত্যাগে। সর্বোপরি, বিরোধী-দমনে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট নির্মূলে, নতুন শাসকশ্রেণি ছিল ব্রিটিশ শাসকদের চাইতেও নৃশংস।

গরম লাইন ব্যর্থ হলো, প্রতিক্রিয়ায় ফল দাঁড়াল নরমের চেয়েও নরম লাইনে প্রত্যাবর্তন। পূর্ববঙ্গে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি আবারো চলে গেল বুর্জোয়া নির্ভরশীলতার দিকে। তারা চাপ দিয়েছিল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট গঠনের। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো, কিন্তু একেবারে প্রথম ফলটাই দাঁড়াল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মৌলবাদী নেজামে ইসলামের আত্মপ্রকাশ এবং তাদের আবদারে যুক্তফ্রন্ট থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দেওয়া। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি অবধারিতই ছিল, মাঝখান থেকে ক্ষতিটা হলো কমিউনিস্টদের।

এরপর কমিউনিস্ট পার্টি মস্কো-পিকিংয়ে ভাগ হয়ে গেছে। মস্কোপন্থিরা ঝুঁকেছে আওয়ামী লীগের দিকে আর পিকিংপন্থিরা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসার জন্যই যে জাতি প্রশ্ন মীমাংসা করাটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল, তাদের একাংশ সেটা অনুধাবনে অসমর্থ হওয়ার দরুন কার্যকর রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলো। একাত্তরের যুদ্ধে মস্কোপন্থিরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে যুদ্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। মধ্যস্থতার জন্য অনুরোধ জানাতে তাদের দুই নেতা দিল্লিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন, কিন্তু তাতেও সুফল পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিকিংপন্থিরা আর দৃশ্যমান থাকেনি। তাদের নেতাদের কেউ কেউ কারাগারে চলে যান, কর্মীদের মধ্য থেকে অনেকেই রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হন। মস্কোপন্থিরা তৎপর হয়ে পড়েন সরকারের সঙ্গে মিলে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠনে। ওদিকে হাজার হাজার তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং হানাদারদের নৃশংসতা দেখেছে, তারা অস্থির হয়ে উঠেছিল সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার জন্য। কমিউনিস্ট পার্টিকে সামনে পেলে তারা তাতেই যোগ দিত। মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিই তখন দৃশ্যমান; কিন্তু তারা তরুণদের ডেকে নেওয়ার পরিবর্তে নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের ভেতরে জাতীয় বুর্জোয়াদের খোঁজ পাওয়া যাবে, এই দুরন্ত আশা নিয়ে ঐক্য জোট গঠনে।

ওদিকে আবার নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটায় মস্কোপন্থি কমিউনিস্টদের একাংশ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই বিলোপবাদী হয়ে পড়ল। তার আগে ১৯৭৫ সালে তো গোটা পার্টি চলে গিয়েছিল বাকশালে, গোছগাছ করে। তারপর একই ধারায় তারা জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচিতে এবং এরশাদের দ্বারা আয়োজিত নির্বাচনেও যোগ দিয়েছে। সাধারণভাবেই সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে জনমনে বিরাজমান সংশয় ও আগ্রহের অভাব পুষ্টি পেল।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তরুণদের জন্য উন্নতির নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করে দিয়েছিল। এর ফলে অনেক মেধাবানই বিদেশে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। দেশে থাকলে এরা হয়তো বামপন্থি আন্দোলনকে বেগবান করত। ছাত্রজীবনে বামপন্থি আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল হতাশাগ্রস্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় তাদের অনেকেই জাতীয়তাবাদীদের দলে গিয়ে শামিল হলো; কেউ গেল বিএনপিতে, কেউ আওয়ামী লীগে। মস্কো-পিকিং বিভাজনের সূত্রপাত ঘটেছিল প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নে; দ্বিখণ্ডিকরণে যে দুজন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমনকি তারাও, উভয়েই মিলেছেন গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে— অধিক অনলবর্ষী গেলেন আগে, কম অনলবর্ষী কিছুটা পরে। পেটি বুর্জোয়া আকাঙ্ক্ষা একবার ঘাড়ে চড়লে আর কি নামে?

সবকিছু মিলিয়ে শ্রেণিব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের, সেটি শক্তিশালী হতে পারেনি। অর্থনৈতিক উন্নতিটা ঘটছে মেহনতিদের শ্রমে ও ঘামে এবং পুঁজিবাদী কায়দায়, তাই শ্রেণি বৈষম্যও বেড়েছে এবং বাড়ছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads