• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
কিশোর আন্দোলন এবং কিছু কথা

সর্বশেষ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি স্কুল-কলেজের কিশোর বালক-বালিকাদের আন্দোলন

আর্ট : রাকিব

মতামত

কিশোর আন্দোলন এবং কিছু কথা

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১২ আগস্ট ২০১৮

এদেশে আস্তে আস্তে আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। অনেক ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। মিটিং মিছিল হরতাল মানববন্ধন আরো অনেক কিছু। রাজনৈতিক আন্দোলনে লাগাতার হরতাল-অবরোধে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে দেশ। জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। মানুষ দু-একদিন সহানুভূতি দেখালেও ব্যক্তিজীবনে দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে ওঠে। তখন পক্ষে যে ক’জন থাকে, বিপক্ষে থাকে তার চারগুণ। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে অনেকেরই। সেটা হওয়া অস্বাভাবিকও নয়। রাস্তায় আটকে পড়ে রোগীর মৃত্যু, অসুস্থজনকে হাসপাতালে নিতে অসুবিধা, অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসব সমস্যাসহ নানা ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয়। আর এসব বাদ দিলেও দৈনন্দিন জীবনযাপনেও প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় জনগণকে। রাস্তায় বাস রিকশা গাড়ি পাওয়া যায় না। যদিও বা দু-চারটি পাওয়া যায়, একটির পেছনে ছুটে আসে বিশজন। ভাড়া বেড়ে যায় হুড়হুড় করে। তারপরও বেশি দামে নেওয়া যানবাহন আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এদেশে সংঘটিত বেশ কয়েকটি আন্দোলন জনগণের সহানুভূতি কেড়েছে। এটা শুরু গণজাগরণ মঞ্চ দিয়ে। পরের দিকে গণজাগরণ মঞ্চের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, প্রথম দিকে এ মঞ্চের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসাধারণ।

যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদেরের মামলায় রায় হওয়ার পর যাবজ্জীবনের স্থলে তার ফাঁসির দাবিতে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। প্রথমে শাহবাগকে কেন্দ্র করে কিছু যুবক এ আন্দোলন শুরু করলেও আস্তে আস্তে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে সেই ’৭১ সালের মতো। বিদেশেও গণজাগরণ মঞ্চের শাখা খোলা হয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে সাড়া দিয়ে সবাই জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে, মোমবাতি প্রজ্বলন করেছে, নীরবতা পালন করেছে, নাম স্বাক্ষর করেছে। খেয়ে না খেয়ে ছেলেরা পড়ে ছিল আন্দোলনে। আর দেশের মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে খাবার দিয়ে, পানি দিয়ে। সবাই গিয়ে বসে থেকেছে রাস্তায়, গান গেয়েছে, স্লোগান দিয়েছে, কবিতা পড়েছে। এদেশে এটা ছিল এক অদ্ভুত শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় আমরা প্রত্যক্ষ করি আরেকটি সুশৃঙ্খল আন্দোলন- ‘কোটা আন্দোলন’। কোটা আন্দোলনে বিরোধী পক্ষ যতটা সোচ্চার হবে ভেবেছিলাম তা হয়নি। কারণ বোধহয় এটাই যে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসছে। আর শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিল চায়নি, চেয়েছে সংস্কার। যা খুবই ন্যায্য দাবি। এ দাবির সঙ্গেও একাত্মতা ঘোষণা করেছিল দেশের অধিকাংশ মানুষ। তারা এ দাবির মধ্যে অযৌক্তিক কিছু দেখেনি।

সর্বশেষ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি স্কুল-কলেজের কিশোর বালক-বালিকাদের আন্দোলন। শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুজন শিক্ষার্থীকে ফুটপাথে উঠে পিষে ফেলে ‘জাবালে নূর’ পরিবহনের একটি বাস। দুটি বাসের মধ্যে চলছিল কমপিটিশন। ছেলে-মেয়ে দুটির রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকে ফুটপাথে। আর সে কথা নৌপরিবহনমন্ত্রীর গোচরে আনলে তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলেন, ‘ভারতের মহারাষ্ট্রে প্রতিদিন ৩৫ জন করে অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তারা তো এত হইচই করে না।’ একে তো সহপাঠীদের মৃত্যু, তার ওপর মন্ত্রীর এই মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্ররা। একে একে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। একসময় প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও নেমে আসে রাজপথে। তারা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এই ইস্যুতে ৯টি দাবি তুলে ধরে সরকারের কাছে। নিজেরাই নেমে পড়ে রাস্তা সুশৃঙ্খল করার কাজে। সঙ্গে সঙ্গে এই কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ওপর পুলিশ চড়াও হয়। শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলনে তারা হামলে পড়ে। শিশুদের গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা, মেয়েদের বুট দিয়ে লাথি মারা, ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে পিটানোসহ এমন কোনো অন্যায় নেই যা তারা করে না। এ ঘটনাগুলো দ্রুত চলে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর খবরের কাগজে। আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে দেশবাসী শিশুদের ওপর এই অমানবিক আচরণ আর মন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদে। সিংহভাগ মানুষ দিতে থাকে সমর্থন, কেউ সরবে কেউ নীরবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওই মন্ত্রীকে তিরস্কার করেছেন। এই তিরস্কারে কী হবে! অঘটন তিনি তো আজ প্রথম ঘটালেন না। একের পর এক ঘটিয়ে চলেছেন। তিনি কী এতটাই অপরিহার্য যে, তাকে ছাড়া মন্ত্রিসভা অচল! কী তার কন্ট্রিবিউশন এদেশের জন্য? অন্য দেশ হলে তো মন্ত্রী নিজেই পদত্যাগ করতেন।

আমাদের দেশে গাড়ির পাল্লা কোনো নতুন বিষয় নয়। ফিটনেসবিহীন অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি অতি কমন ঘটনা। জানা গেছে, ‘জাবালে নূরে’র কোনো রুট পারমিট ছিল না। রুট পারমিট ছাড়াই পরিবহনটি এত বছর ধরে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। বিআরটিএ নাকি তাদের লাইসেন্স বাতিল করেছে। লাইসেন্স এখন বাতিল করে লাভ কী! বাচ্চা দুটির জীবন কি তাতে ফিরে আসবে? দিয়ার বাবা কি ফিরে পাবে তার মেয়েকে? বাস্তবায়ন করতে পারবে তার মেয়েকে ম্যাজিস্ট্রেট বানানোর স্বপ্ন? করিমের বাবা কি আর কোনোদিন করিমকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে! প্রিয়াংকা এখনো ধুঁকছে সিএমএইচে। তার ব্রেনে হেমারেজ হয়েছে। সে আদৌ ভালো হবে কি-না, হলে কবে হবে কে জানে!

ঘাতক চালকরা গ্রেফতার হয়েছে। ওরকম গ্রেফতার কত হয় আবার জামিনে বেরিয়েও যায়। এরাও যাবে। তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কমিটিও কত শত হয় বছর বছর। তার কয়টাই বা রিপোর্ট দেয় আর কয়টাই বা বাস্তবায়ন হয় আর জনতা তার কতটুকুই বা জানতে পারে।

কিশোররা ঢাকা শহরের রাস্তায় বসে বসে স্লোগান দিয়েছে। গাড়ির রুট পারমিট আর ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখেছে। চালকের লাইসেন্স দেখেছে। যাদের কাগজপত্র সঠিক পেয়েছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছে। যাদের পায়নি তাদের গাড়ি আটকে তুলে দিয়েছে পুলিশের কাছে। এই আন্দোলনে দেশের একটি গোপন চিত্র উদঘাটিত হয়েছে দেশবাসীর সামনে। আমরা জানতে পেরেছি, এদেশের মন্ত্রী, বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিজিবি, দুদক, ডিবি, সাংবাদিকরা লাইসেন্সবিহীন গাড়িতে বছরের পর বছর চলাচল করেন। এদের অনেকের সামনে পেছনে পুলিশ থাকে, জাতীয় পতাকা থাকে, সিটি বাজিয়ে এদের চলাচলের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে পুলিশ। আমরা আমজনতা খাবি খাই। আর এরা বিনা লাইসেন্সে বিনা পারমিটে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘোরেন। এরা উল্টো রাস্তায় চলেন। এরা সংসদে, সমাবেশে, টক শোতে নীতি-আদর্শ-শৃঙ্খলার অমিয় বাণী উচ্চারণ করেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। অথচ এদেরই ভেতরে এত্তো এত্তো গলদ!

শিক্ষার্থীরা অনেক মন্ত্রীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। তারা হেঁটে বা অন্য গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন। এদেশের ট্রাফিক পুলিশের কোনো সাহস নেই ভিআইপিদের কাগজপত্র চেক করার। এই শিক্ষার্থীরা তা করেছে। কোনো গাড়ি তারা ভাঙচুর করেনি। এমনকি অসুস্থ মানুষের হাত ধরে রাস্তা পার করে দিচ্ছে এমন ছবিও এসেছে পত্রিকায়। তারা যেভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল করেছে, রাস্তা সুশৃঙ্খল রেখেছে- আমি কখনোই তা দেখিনি। রাস্তাকে তিনভাগ করে একভাগে রিকশা, একভাগে বাস, আরেক ভাগে প্রাইভেট কার সিএনজির লেন করেছে তারা। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ইমারজেন্সি লেনও করেছে। জনগণ মাইলের পর মাইল হাঁটছে, হেঁটেছে। অশেষ দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করেছে, কষ্ট পাচ্ছে। তবু বাচ্চাগুলোর ওপর তাদের কোনো রাগ নেই। সবাই এ বাচ্চাগুলোকে সমর্থন করেছে, তাদের উৎসাহ দিয়েছে, তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এই কষ্ট তারা মেনে নিয়েছে। তারা এসে দাঁড়িয়েছে বাচ্চাগুলোর পাশে, যেমন— বাবা-মা দাঁড়ায় সন্তানদের পাশে। খাবার আর পানি দিয়েছে। অন্যদিকে চালকরাও হাসিমুখে একবাক্যে তাদের কাগজপত্র শিক্ষার্থীদের দেখিয়েছে। কারো মুখে বিরক্তি দেখিনি। এমনকি রিকশাওয়ালাও বলেছে, ‘এবার দ্যাশটা ঠিক হইব। পোলাপান ঠিক কাজটাই করতাছে।’

পুলিশ প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলেও পরবর্তী সময়ে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের সবক’টি দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজকে পাঁচটি বাস উপহার দিয়েছেন। দিয়া ও করিমের বাবাকে ২০ লাখ করে টাকা দিয়েছেন। তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। তবে পরিতাপের কথা এই যে, ২ আগস্ট থেকে আন্দোলনে ঢুকে পড়ে তৃতীয় পক্ষ। গাড়ি ভাঙচুর হয়, যা শিক্ষার্থীরা করেনি কিন্তু দোষ হয় তাদের। অন্যদিকে ঢাকার রাস্তা থেকে বাস উধাও হয়ে গেছে। অশেষ দুর্গতিতে পড়ে জনগণ। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বরাবরের মতো সেই একই রাজনীতি! শ্রমিকরাও নেমে পড়ে জায়গায় জায়গায়। আন্দোলনটি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয় দেশবাসীর মনে। ফেসবুকে একের পর এক নিউজ ভাসছে জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। এক পক্ষ এগুলো ছড়াচ্ছে, অন্য পক্ষ বলছে গুজব। ‘গুজবে কান দেবেন না’। ফেসবুক লাইভে এসে বিবৃতি দেওয়া মডেল কাজী নওশাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি পরে তার বক্তব্য ভুল নিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের সব দাবি বাস্তবায়নের আবারো আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি। সুতরাং একের পর এক পরস্পরবিরোধী খবরে বিভ্রান্ত দেশবাসী। আসল চিত্রটি পাওয়ার আশায় দিন গুনছি আমরা। চাইছি নিরাপদ, নিরুদ্বিগ্ন সড়ক।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্মসচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads