• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
রেমিট্যান্স প্রবাহে চাই নতুন গতি

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম রেমিট্যান্স

সংগৃহীত ছবি

মতামত

রেমিট্যান্স প্রবাহে চাই নতুন গতি

  • প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রেজাউল করিম খোকন

বাংলাদেশ ব্যাংক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো সহজ করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আগ্রহী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দুই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন সহজিকরণের ব্যাপারে অনুমোদন দিচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডসহ আরো কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যে এই দুই দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী কাজ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জাপান থেকে রেমিট্যান্সের হার ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম রেমিট্যান্স। তবে এখন পর্যন্ত অল্প কয়েকটি দেশ থেকেই আসছে সিংহভাগ রেমিট্যান্স। কাতার, ওমান, বাহরাইন, যুক্তরাজ্য, হংকং, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অন্যতম উৎস বলে বিবেচিত। সরকার বিভিন্নভাবে এমন অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও তা পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ অর্থের ৫৫ ভাগই এসেছে চারটি দেশ থেকে। আর এর সঙ্গে আরো দুটি দেশ যোগ করলে তা মোট রেমিট্যান্সের ৭০ ভাগ হয়।

এদিকে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৪১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা, জুলাইয়ের তুলনায় যা ৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। আর আগের বছরের একই মাসের সমান। এর আগে টানা দুই অর্থবছর কমার পর গত অর্থবছর রেমিট্যান্সে ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে এবারো আগের চেয়ে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করা যায়।

অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ২৭৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ১৯ কোটি ডলার বা ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। মোবাইলে হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে বেড়েছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এর ধারাবাহিকতায় দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ২০১৫-১৬ ও ১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমার পাশাপাশি আমদানি ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ব্যাপক চাপ পড়ছে।

গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) দেশে ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়, যা আগের অর্থবছরর চেয়ে ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গত অর্থবছরে  রফতানি বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ওই অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার। আর পরপর দুই অর্থবছর কমার পর গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ওই অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। একদিকে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কাঙ্ক্ষিত হয়নি, অন্যদিকে দেশে ডলারের দামও বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, গত অর্থবছর ২৩১ কোটি ডলার বিক্রির পরও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দর প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সায় উঠেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমে ৩২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। গত কয়েক মাসে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। তবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও কুয়েত থেকে দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৫৫ শতাংশ এসেছে। এ সময়ে বরাবরের মতো সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এদেশ থেকে এসেছে ২৫৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২৪৩ কোটি ডলার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি ডলার। এ তিন দেশ থেকেই মোট রেমিট্যান্সের ৪৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ এসেছে। এরপর কুয়েত থেকে এসেছে ১২০ কোটি ডলার। এ চার দেশ থেকে এসেছে ৫৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ১১০ কোটি ৭২ লাখ ডলার এবং যুক্তরাজ্য থেকে ১১০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এই ছয়টি দেশ থেকে মোট রেমিট্যান্সের ৭০ শতাংশ এসেছে।

এই ছয়টি দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ওমান থেকে। এই দেশটি থেকে ৭ হাজার ৯৫ কোটি ৮১ লাখ ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে গত অর্থবছরে। কাতার থেকে এসেছে ৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ইতালি থেকে ৬৬ কোটি ২২ লাখ ডলার এবং বাহরাইন থেকে এসেছে ৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার।

কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্স না বাড়লেও রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দিন দিন জনশক্তি রফতানি কমে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ২৫০ জন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। আগের বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ৫ লাখ ২০ হাজার ৪৯০ জনশক্তি পাঠানো হয়। বাংলাদেশ থেকে যত জনশক্তি রফতানি হয় তার বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮৮০ জনশক্তি রফতানি হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৩ জন। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৬ শতাংশ কমেছে।

দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানিতে আস্থার প্রতীক ছিল উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত জিসিসির ছয়টি দেশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভিসা জটিলতা, কূটনৈতিক ব্যর্থতাসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে এ শ্রমবাজার। ফলে প্রতিবছর কমছে জনশক্তি রফতানি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি জনশক্তি রফতানি কমেছে। সৌদি আরবের নতুন আইন, নানা চেষ্টা সত্ত্বেও আরব আমিরাতের বন্ধ শ্রমবাজার খুলতে না পারা ভাবিয়ে তুলেছে প্রবাসীদের। একমাত্র আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা মালয়েশিয়ায়ও তৈরি হয়েছে নতুন আশঙ্কা। এত কিছুর পরও থেমে নেই জনশক্তি রফতানি নিয়ে এজেন্সিগুলোর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-হানাহানি আর বিদেশ গমনেচ্ছুদের সঙ্গে প্রতারণা।

এক সময় কুয়েত ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাজার। অথচ এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বাজারটি। এ ছাড়া ছোট হয়ে এসেছে সৌদি আরবের শ্রমবাজার। লিবিয়ার দুয়ারও বন্ধ। ইরাকও প্রায় বন্ধের মতোই। অথচ জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে অতীতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শেষে একমাত্র মালয়েশিয়ার বাজার ছিল চাঙা। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অহেতুক শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব, আরেক পক্ষের বাজার কুক্ষিগত রাখার ইচ্ছা প্রায় নষ্ট করে ফেলেছে এই শ্রমবাজারকে। কোনো ধরনের প্রতারণার ঘটনা না ঘটিয়ে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে যখন গতি বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, তখন বায়রার দুই পক্ষের হানাহানিতে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিই বন্ধ হয়ে গেল। এখন পুরনো পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় গিয়ে আবার প্রতারিত হয়ে বাংলাদেশিদের রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণভোমরার ভূমিকা পালনকারী এই খাতে প্রাণসঞ্চার করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর দুয়ার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এখন কার্যত বন্ধ। চলতি বছর বিদেশগামী ১০ লাখ কর্মীর ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য পুরনো বাজার মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। সেগুলোতেও বিরাজ করছে নানা ধরনের সঙ্কট।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে নতুন কোনো স্থায়ী বাজার সৃষ্টি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এই দীর্ঘসময়ে পুরনো বাজারগুলোও স্বাভাবিক করতে পারেনি সরকার। ফলে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আমাদের জনশক্তি রফতানি খাত। 

এ ছাড়া প্রতিবছরই অনেক প্রবাসী দেশে বিনিয়োগ করতে আসেন। কিন্তু নানা সমস্যা দেখে তারা বিনিয়োগ না করে হতাশ হয়ে ফিরে যান। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বেগবান করতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য সরকারকে দ্রুত এবং কঠোরভাবে সব অনিয়ম দুর্নীতি রোধ করতে হবে।

লেখক : ব্যাংকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads