• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
জাতীয় ঐক্যের আকাশে কালো মেঘ

প্রতীকী ছবি

মতামত

জাতীয় ঐক্যের আকাশে কালো মেঘ

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সর্বত্র এখন একই আলোচনা। সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য হবে কি? যদি হয়, তাহলে তার ফল কী হবে? কথিত সে জাতীয় ঐক্য দেশের চলমান রাজনীতি তথা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে? এই জাতীয় ঐক্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে প্রকৃতই কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে, নাকি তা পর্বতের মূষিক প্রসবের নতুন উদাহরণ হয়ে থাকবে?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে এখন। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো নির্বাচনের ফল নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার লক্ষ্যে নতুন জোট গঠন বা জোট সম্প্রসারণের তৎপরতা শুরু করেছে অনেক আগেই। ক্ষমতাসীন মহাজোট আবারো জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে- এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সিদ্ধান্তের পর এতে পরিবর্তন আসতে পারে। নির্দলীয় সরকার এবং দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবি পূরণ না হলে যদি বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে। আর যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে চায়। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তার দল আর গৃহপালিত বিরোধী দল থাকবে না। তারা সরকার গঠন করতে চায়। জাতীয় পার্টির পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সেটা না বললেও চলে। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে- এমন একটি দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারলেই এরশাদ এবং তার দলের সরকার গঠনের ইচ্ছা পূরণ হতে পারে। আর অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এরশাদের জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধবে।

এ রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যেই এখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ‘জাতীয় ঐক্য’। সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপি আওয়ামী লীগের বিপরীতে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি ঐক্য মোর্চা গঠনের কথা বলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। তবে তাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি। দলটির পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েক নেতা এই নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেও তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেনি। এরই মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বি. চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির আ স ম আবদুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গঠন করেন যুক্তফ্রন্ট। তারা ঘোষণা দেন, যুক্তফ্রন্ট দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করবে এবং এ ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলবে।

সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সবচেয়ে উদগ্রীব বিএনপি। তারা মনে করছে, যদি এ ঐক্য গঠন করা যায়, তাহলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল করায়ত্ত করা অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে। বি. চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টকে কীভাবে ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে বিএনপি নেতারা এখন গলধঘর্ম। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই নিয়ে মহাসচিব মির্জা আলমগীর ডা. বি. চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। এমনই একটি বৈঠকে বি. চৌধুরী তনয় ও বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী বৃহত্তর ঐক্য হলে যুক্তফ্রন্টকে দেড়শ’ আসন দিতে হবে বলে দাবি করেন। তার এ দাবির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে চারদিকে গুঞ্জন শুরু হয়। অনেকেই মাহীর এ দাবিকে ‘ভাজা মাছের ঝোল’ চাওয়ার মতো বিএনপির সঙ্গে ঐক্য না করার অজুহাত হিসেবে ধরে নেন।

গত ৯ সেপ্টেম্বর দৈনিক সমকালের ‘বিএনপিতে ক্ষোভ, শরিকদের বিরোধিতা’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ার শর্ত হিসেবে যুক্তফ্রন্টের দেড়শ’ আসন এবং দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবিকে জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় মনে করছে ২০-দলীয় জোটের শরিকরা। এ বিষয়ে ক্ষোভ রয়েছে বিএনপিতেও। জাতীয় ঐক্যের জন্য শীর্ষ নেতৃত্ব কিছুটা ছাড় দিতে চাইলেও জোটে দলটির শরিক ও তৃণমূল নেতারা বলছেন, যুক্তফ্রন্টের এ দাবি অবান্তর। এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরোয়ার পত্রিকাটিকে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে সরাতে সব দলের ঐক্য জরুরি। কিন্তু কোনো দলকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর নয়াপলটনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে নিজেরা কিছু ছাড় দিয়ে হলেও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য শিগগিরই হবে। যদি কিছু ত্যাগ স্বীকার না করি, তাহলে জাতীয় ঐক্য কখনই হবে না।’ একই দিনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, ‘বিএনপিকে অধিকতর কৌশলী ও বাস্তববাদী হতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যে কোনো লাভ হবে না। বিএনপি একটি শক্তিশালী দল। দলটিকে পুনর্গঠন করে এ দেশে যেকোনো কাজ করা সম্ভব।’

এদিকে পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তফ্রন্টের চার শরিক ও অন্য দলগুলোকে কাছে টানা এবং আওয়ামী লীগকে দূরে রাখতেই বিএনপি নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। আর সে জন্যই যুক্তফ্রন্ট ১৫০ আসন এবং রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করলেও বিএনপি তা সরাসরি নাকচ করছে না। তবে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এ নমনীয়তা মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, বিএনপির নমনীয়তার সুযোগে অবাস্তব সব দাবি করছে নাম সর্বস্ব দলগুলো, যা বিএনপির জন্য বিব্রতকর। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, যারা ১৫০ আসন দাবি করছেন তাদের ১৫০ জন কর্মীও নেই।

গত ৯ সেপ্টেম্বরের বাংলাদেশের খবরের ‘জাতীয় ঐক্যে শনির দশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার আগেই সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখাদেখি শুরু হয়েছে। কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে চাচ্ছেন, কেউ রাষ্ট্রপতি। আবার ক্ষমতার সময়সীমাও নির্ধারণ করা হচ্ছে। এমন হিসাবনিকাশকে সামনে রেখে ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শরিকরা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে আসন্ন নির্বাচনে পরাভূত করতে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার কথা বিএনপি বেশ আগে থেকেই বলে আসছিল। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোনো দল কথিত জাতীয় ঐক্যে শামিল হতে এগিয়ে আসেনি। গত বছর বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং আ স ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়। এরপর অনেক দিন জাতীয় ঐক্যের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি বিএনপি নেতাদের বক্তৃতায় এর প্রয়োজনীয়তার কথা ছাড়া। বলা হয়েছিল খুব দ্রুত জাতীয় ঐক্যের রূপরেখা দেবেন এর উদ্যোক্তারা। এখন শোনা যাচ্ছে, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে যুক্তফ্রন্ট যে সমাবেশ করতে যাচ্ছে, সেখান থেকে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও এর সাংগঠনিক রূপরেখা ঘোষণা করা হতে পারে। সে সমাবেশে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ নেবে এবং সরকারবিরোধী একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা দেবে।

এ প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত কতটা সাফল্যের মুখ দেখবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেননা, বিএনপি নেতৃত্বের একটি অংশ এতে উৎসাহ দেখালেও অপর একটি অংশ অনীহা প্রকাশ করছে। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা ক্ষোভের সঙ্গেই বলছেন যে, বি. চৌধুরী আহূত জাতীয় ঐক্যে শামিল হতে বিএনপির অতি আগ্রহ দলটির জন্য অসম্মানজনক। কারণ আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপির সমকক্ষ আর কোনো রাজনৈতিক দল দেশে নেই। যদি কোনো বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতেই হয়, তাহলে তা হতে হবে বিএনপির নেতৃত্বে এবং বিএনপির মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে। কিন্তু এখন যেটা হতে যাচ্ছে, সেখানে বিএনপি যুক্তফ্রন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যোগদানে ইচ্ছুক একটি দল হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা এটাও বলছেন যে, বিএনপির এখন প্রধান দাবি তাদের দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। অথচ জাতীয় ঐক্যের নেতারা আগেই বলে দিয়েছেন যে, তাদের মঞ্চ থেকে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ব্যাপারে কোনো দাবি জানানো যাবে না। এতে বিএনপির ভেতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীরা বলছেন, ঐক্য করে যদি দলের মূল দাবির (চেয়ারপারসনের মুক্তি) কথা বলা না যায়, তাহলে সে ঐক্য করে কী লাভ? বিএনপি তো কোনো সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল বা ব্যক্তির ক্ষমতায় যাওয়ার বাহন হতে পারে না।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, যুক্তফ্রন্ট আহূত জাতীয় ঐক্য শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। বিএনপির যে অংশটি জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে অতি আগ্রহী তাদের সম্পর্কে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতোমধ্যেই সন্দেহ অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। তারা সন্দেহ করছেন, এ তৎপরতা ভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কি না। এক্ষেত্রে সে ফর্মুলার শিকার হতে পারেন জিয়া পরিবারের দুই উত্তরাধিকার বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তারা এও বলছেন যে, জাতীয় ঐক্যের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য যদি মহৎ হতো, যদি দেশে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা ও সুষ্ঠু নির্বাচন মূল উদ্দেশ্য হতো, তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি প্রশ্নে শুরুতেই ‘অ্যামবার্গো’ দিয়ে বসতেন না। এ বিষয়ে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের বক্তব্য পরিষ্কার- বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করতে যাদের আপত্তি, তাদের সঙ্গে তারই নেতৃত্বাধীন বিএনপির ঐক্য হতে পারে না। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে জামায়াতে ইসলামী থাকলে সে ঐক্যে তিনি থাকবেন না। ফলে ১৯ বছরের পথচলার সঙ্গী জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত ওই বৃহত্তর ঐক্যে শামিল হবে বলে মনে হয় না।

রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছেন, জাতীয় ঐক্য নিয়ে শুরুতেই যে জটিলতার আলামত দেখা দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত এর ভাগ্যে কী আছে বলা মুশকিল। যে কালো মেঘ জাতীয় ঐক্যের আকাশে জমতে শুরু করেছে, তা আরো ঘনীভূত হয়ে প্রবল ধারায় নেমে এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় কি না সেটাই ভাবনার বিষয়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads