• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
কিছু রাজনৈতিক আলাপ

প্রতীকী ছবি

মতামত

কিছু রাজনৈতিক আলাপ

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ঠিক বিষয়টি এই মুহূর্তে আমার কাছে তেমন পছন্দের নয়। কারণ, একই আলাপ আর কত! কিন্তু চোখের সামনে যা টগবগ করে ফুটছে তা আর বাদ যায় কী করে। ক’দিন আগে দেশের দক্ষিণে বরিশাল যেতে হলো। সেখানে ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা আর যাওয়ার সময় কুষ্টিয়া, মাগুরা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গৌরনদীর পথে পথে প্রচুর ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন চোখে পড়ল। সর্বত্রই প্রায় সরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থী-সমর্থকদের প্রচার-প্রচারণার ঢাক যেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পদ্মা সেতুর জন্য প্রস্তুতকৃত সংযোগ সড়ক-পয়েন্টের বিশাল কর্মযজ্ঞও চোখে পড়ল। বেশ আধুনিক যন্ত্রপাতির কী এক যজ্ঞ। এসব দেখে নিজেকে এদেশের নাগরিক বলে যেন বিশ্বাস করাই কঠিন মনে হলো। হায়রে দেশ! নদীবিধৌত এ বাংলায় সত্যিই এখনো মাছের দেশ নদীর দেশ বলে টের পাই- যখন ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বাগেরহাট দিয়ে ফিরছিলাম। এখনো বুঝি এসব এলাকায় জনসংখ্যা কম (উত্তরাঞ্চলের চেয়ে)। এখানকার সংসারের লোকজন কেউ বোধ করি ঢাকা প্রবাসী কেউবা মধ্যপ্রাচ্যে। পাকা রাস্তা সংলগ্ন প্যাচপ্যাচে কাদা, পড়ো বাড়ি, পুরনো টিনের চাল, ছাপরার ঘর, জঙ্গল আর ডুবন্ত পানির ভেতরে বনবাদাড়ে আচ্ছন্ন মানবেতর জনজীবন চোখে পড়ল। যা হোক, এর ভেতরে, প্রার্থীদের নাম প্রচার অব্যাহত আছে—  ফেরিঘাটে, বাজারে, বোটে, লঞ্চে সর্বত্র। এগুলোর একটা সমাজ বিশ্লেষণ আছে। সেটা তৈরি করতে মন চায়, কিন্তু এজন্য সময় দরকার। আর এটা সে সময়ও নয়। তবে একটি জিনিস সাবলীল মনে হলো— প্রচার, ব্যানার যাই হোক, ব্যাপারগুলো জনতার ভেতর সমর্থন বা অসমর্থনজ্ঞাপক তেমন কিছু নয়, যেন সব আরোপিত। মানুষের তাতে তেমন দৃকপাত বা আগ্রহ নেই। এক ধরনের গতানুগতিক যাপিত জীবন নিয়েই তারা ব্যস্ত এবং জীবন্ত। এসবের ভেতরে হয়তো অন্য চিত্র আছে, কিন্তু সাংবাদিকসুলভ দৃষ্টিতে তেমনই মনে হয়েছে। দিন বদলের বিষয়টি এখন পুরোটাই জনতার কাঁধে। খেটে খাওয়া, পরিশ্রমী, রাতজাগা মানুষ এখন প্রচুর। সবাই আত্মোন্নয়নে কাজ করছে। এর ভেতর থেকে কেউবা দেশের জন্য কাজ করে। কিন্তু রাজনীতি অনেকটা আপ্ত প্রলাপের মতো, ওদের কাছে। কেউ কেউ বিরক্ত, বিব্রত, এড়িয়ে যায়, সরিয়ে রাখে বা অপছন্দ প্রকাশ করে। কারণ, এ সমাজে মাস্লম্যান, মিথ্যাচার, প্রতারক, গলাবাজ, স্তাবক, তোষামোদকারী, ভণ্ড, অসততা একদম রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে রাজনীতির মধ্যে বসে গেছে, তা নিয়ে আবার আলাপ কী! আগ্রহই বা কী? যারা করার তারা করুক, আমরা নেই। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। এ রকম ব্যাখ্যা গোচরে-অগোচরে প্রায় সবার। এমনকি মূর্খ-অশিক্ষিত রাজনীতি না-বোঝা সাধারণ মানুষেরও। মুখবুজে তারা রাজনীতিকে যে অবজ্ঞা করছে, সেটা বড় অভিজ্ঞতাসূচক এবং স্থির সিদ্ধান্তশীল ভাবের প্রকাশক বলেই মনে হয়। তারা কম বোঝে বা বেশি বোঝে তা নয়, কিন্তু তাদের প্রকাশটা অনেকটা এমনই। এসব অভিজ্ঞতার অনুসিদ্ধান্ত এমন যে, মাসলম্যান, গলাবাজ, কর্তৃত্বপ্রবণ, মিথ্যাচারকে দেখতে দেখতে তাদের যে অপচয় ঘটে গেছে, ওসব আর তারা ধারণ করতে রাজি নন। আর ব্যক্তি হিসেবে (এখনকার সমাজ যেহেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক) একা আপাতত এই নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। একা তো লড়া যায় না! একক হয়ে কিছু করাও কঠিন। ফলে এড়িয়ে চলা। গা বাঁচিয়ে চলা। নিজের কাজ নিজে করা। সময় আসুক তখন দেখা যাবে! এই হচ্ছে একটা প্রতীকী কেসস্টাডি।

আসলে যেটি বলতে চাই এবং দুঃখ করেই বলি, আমাদের রাজনীতিটা তৈরি হলো না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি তো বহু দূরের কথা। স্রেফ যে রাজনীতিটা মানুষের বিশ্বাস স্থাপন করায়, নির্বাচনের উৎসব তৈরি করে, ভালো-মন্দ বুঝতে শেখায়, জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, প্রতিদিনের জীবনে যার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থাকে প্রাণান্ত— তা তৈরি হয়নি। এখনো হলো না, এত বছর পরও। এর কারণ কী? পেছনের কারণগুলো আবার চলে আসে। একাত্তর সালে লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি। তারা কেউ এমন দেশের কথা ভাবেননি। দুটো বিষয় : যে কর্মযজ্ঞ দেখে বিস্মিত হই (ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, কিংবা যোগাযোগের জন্য বড় বড় স্থাপনা), আবার প্রকৃত রাজনীতিটা পজেটিভভাবে সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার জন্য তীব্র হতাশা। এ দুটো ব্যাপারই একাত্তরে ভাবাটা বেশ অস্বাভাবিক ছিল। সেই অস্বাভাবিকত্বটাই এখন স্বাভাবিক। লোকসংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে। শিক্ষিত বেকার বেশুমার। দুর্নীতি প্রবল। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। চীনের চেয়েও এখন বাংলাদেশে ধনীর প্রবাহ দ্রুত বাড়ছে। গা শিউরে ওঠার মতো বিষয়! ব্যাংক, ব্যবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র চরমরকম বেপরোয়া অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন সামনে নির্বাচন। এই নিয়ে চলছে আরেক জুয়া। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। অভাবিত হয়ে ভাবছে, ‘সতিই কী বিচিত্র এই দেশ!’

প্রাত্যহিক সংবাদ এখন ‘বৃহত্তর ঐক্য’। কিছু রাজনীতিবিদ নির্বাচন এলেই কাজ পেয়ে যান যেন। সেই কাজ চলছে। তারা নাকি নতুন কিছু দেবেন। এ ঐক্যটার দর্শন কী সেটা সবার আগে প্রশ্ন। নির্বাচন সামনে রেখে যে ঐক্য, নতুন কিছু করার যে ঐক্য সেটা অনেককাল এদেশের মানুষ শুনে এসেছে। আর এ মুখগুলোকে এদেশের মানুষ চেনে। প্রশ্ন হলো আস্থাটা কোথায় আটকাবে, কীভাবে আটকাবে। সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়ার পর্যায়— অনেক কারণে ক্ষীণ। কারণ, গত দশ বছর তারা ক্ষমতায়। সেটা লাভ-ক্ষতি, দোষ-গুণ সযত্নে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু যারা গণতন্ত্র আর জন-অধিকারের প্রশ্নে ভাব মারছে তারা আসলে বিকল্প কী করতে চাচ্ছে। তারা এতদিন করেনি কেন, এতকাল কোন কোন কাজ করেছে, দেশবাসীকে সেসব বিষয়ে পরিষ্কার প্রত্যুত্তর দিতে হবে। নইলে তারা আস্থায় আসবে কী করে! আমরা জানি, তারা আস্থাশীল ব্যক্তি কেউই নয়। এমনকি যেভাবে তারা ভোট চাইছে সেভাবে ভোট হলেও তারা নির্ধারিত আসনে জিততে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। কারণ, দল পাল্টে পাল্টে দল গড়া, তারপর হঠাৎ নির্বাচনের আগে জমে বসা, প্রেস কনফারেন্স করা— এসব রীতি বার বার ভোট এলেই মানুষ দেখে। এর ফল বেশিদূর যায় না। আদতে মার্কা তো দুটো। ফলে দুই মার্কার গণতন্ত্র অনেকটা গলগ্রহ। এই গলগ্রহ থেকে এদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না (টানেলের শেষ মাথায়ও না)। ফলে গণতন্ত্র পিছিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি নেই। ধনী বাড়ছে। দরিদ্র বাড়ছে। মানুষ শুধু অনাগ্রহী রাজনীতির অন্ধকার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আরো গভীর করে দেখলে, মাটি-মানুষের রাজনীতি পিছিয়ে পড়ছে, বিনাশ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বলছিলাম দুই মার্কার রাজনীতির কথা। রাজনীতির বৈচিত্র্য নেই। কেন নেই; সেটি কেউ তৈরি হতে দিতে চায় না। অনাধুনিক ও সামন্ত মানসিকতাই তার ফল। সত্যজিৎ রায়ের সেই হীরক রাজার দেশের ‘মগজ ধোলাই’— বিরোধী কথা বলার লোক তৈরি হতে না দেওয়া। আর হীরক রাজার মূর্তি স্থাপনের যে উৎসব সেখানে সব স্তাবকদের আসার পথ সুগম করা। এই যখন অবস্থা, তখন হঠাৎ কেউ কেউ ক্ষমতার গেমে জয়লাভের আসায় নিউইয়র্ক, লন্ডন, ভারত প্রভৃতি দেশে হরহামেশাই যাওয়া শুরু করেন। এক্ষুণি একটি দলের মহাসচিব স্রেফ এই কাজেই নিউইয়র্কে। এগুলোর ফল যাই হোক, এ যে দেশপ্রেমের নমুনা নয়, জনগণের রাজনীতির অংশ নয়, মাটি-মানুষের রাজনীতির অংশ নয়— এটা নিশ্চিত। এদেশের জনগণের সঙ্গে, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের সঙ্গে এর কোনো সংস্রব নেই। ঠিক লুটপাটের রাজনীতি কায়েমই এর লক্ষ্য। যারা ধনীর প্রবাহে আছেন, সেই প্রবাহ আরো দ্বিগুণ করে তোলারই অংশ। যারা দুর্নীতি করছেন সেই দুর্নীতিবাজদেরই আরো দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলারই অংশ। কারণ ক্ষমতার, দুর্নীতির, ধনিক শ্রেণির কোনো দল নেই। যখন যার তখন তার। যখন যেদিকে সুবিধা পাবে, তখন তাদের। ফলে, এটা কখনই সঠিক নির্বাচন, গণতন্ত্র, সাধারণ মানুষের পক্ষের রাজনীতি নয়। সেটি যে দলই করুক। প্রকৃত অর্থে, দেশের মানুষের ভাগ্য বদলের রাজনীতি করতে হবে। তাদের নিয়েই তা করতে হবে। সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শর্টকাট কোনো পথ নেই। সেটা ভেতরে-বাইরে দর্শনভিত্তিক হতে হবে। বছরজুড়ে করতে হবে। রাজনীতিতে মানুষদের আগ্রহী করতে হবে। অধিকারের সচেতনতার পথে সাধারণ মানুষকে শামিল করতে হবে। এটিই রাজনীতিবিদদের কাজ। মহাত্মা গান্ধী কী করেছিলেন? কীভাবে গোটা ভারতে তার কার্যক্রম চলেছে, তাদের রাজনৈতিক লোভ বা ক্ষমতার মোহ তো ছিল না! সেজন্যই সেটা সম্ভব ছিল। লাখ লাখ মানুষকে তাদের পেছনে শামিল হতে দেখা গেছে। সেই যুগে সেটা সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন তা কেউ পারছেন না কেন! প্রশ্নটা বাস্তব-অবাস্তব মেশানো হলেও, সত্যটা অস্বীকার করার মতো নিশ্চয়ই নয়। যা হোক, এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে যে বিদেশমুখী অবস্থা সেটা আসলে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারই অংশ। এ থেকে বেরুনো যাবে কবে? আদৌ কি সম্ভব? একটা বৃত্তে আটকে গেছে যেন আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সময়গুলো। এ থেকে বেরুতে হবে কিন্তু বেরুনো আপাতত মনে হয় সহজ নয়। কারণ হলো, নির্ধারিত দর্শনের বাইরে লিগ্যাসি-প্রবণ রাজনীতির প্রতি আসক্তি ও অনুরক্ততা। সেটি ক্ষতির কারণ। এ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত নয়, কিন্তু মুক্তির পথ ক্রমশ তৈরি হচ্ছে; যুগ ও জাতির প্রয়োজনেই। বাংলাদেশে সেটি আরো একটি জেনারেশনের পর হয়তো আসতে সক্ষম হবে। যা হোক, নির্বাচন নিয়ে যে জুয়া এতে যে সাধারণ মানুষের সংস্রব নেই, সেটি প্রায় সবাই বলে চলেছেন, কিন্তু দেশটা তো আমাদের সবার। একে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। দেশপ্রেম ও নতুন প্রজন্মের অনুরক্তি দিয়েই তা সম্ভব। সেটি যে দলই ক্ষমতায় আসুক, যেভাবেই আসুক, তাদের নেতৃত্বকে তা উপলব্ধি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের ধারণা, বর্তমান সরকারও সে বিষয়টি গত দশ বছর দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতায় অনুধাবন করেছে। আসন্ন নির্বাচনের ভেতর দিয়ে তাদের কর্তৃত্ব যদি আবার প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তারা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের পথেই হাঁটবে; এটা অবশ্যই প্রত্যাশিত। নচেৎ চলতি ধারায় কোনো কিছুই রক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ, সভ্যতার ইতিহাস ফিরে আসে, নিজে নিজেই, নিজের প্রয়োজনে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads